বরগুনা: বরগুনার আমতলী উপজেলার গুলিশাখালী ইউনিয়নের বাইনবুনিয়া গ্রামে ইউটিউব দেখে প্রথমবারের মতো বিষমুক্ত কুল চাষ শুরু করে নতুন দিগন্তের সূচনা করেছেন আবু বক্কর সিদ্দিক রাসেল নামে এক বেকার যুবক।
পরিত্যক্ত ৫ একর জমিতে কাশ্মিরী আপেল কুল, বাওকুল, বলসুন্দরী ও ভরতসুন্দরী নামে চার জাতের কুল চাষ করে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছেন।
বরগুনা জেলার আমতলী উপজেলার গুলিশাখালী ইউনিয়নের গোছখালি এলাকার বেকার যুবক আবু বক্কর সিদ্দিক রাসেল। কাজ করতেন ওয়ার্ল্ড ফিস নামে একটি বেসরকারি উন্নয়ন দাতা সংস্থায়। ঢাকার সরকারি বাংলা কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অর্নাসসহ এমএ এবং বেসরকারি প্রাইম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি করা রাসেল ২০২০ সালের করোনা পরিস্থিতিতে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে বেকার হয়ে পড়েন। বেকারত্ব থেকে মুক্তি পেতে কৃষিক্ষেত্রে কিছু করা যায় কিনা ভাবতে থাকেন রাসেল। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করেন এবং তার পরামর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে নেমে পড়েন কৃষিকাজে। কিন্তু নিজেদের পর্যাপ্ত জমি না থাকায় ৫ একর জমি বার্ষিক চুক্তিতে ইজারা নেন তিনি। বাড়ির পাশের ওই জমি লিজ নিয়ে সেটি উঁচু করে শুরু করেন মাল্টা চাষ। কিন্তু সুবিধা করতে পারেননি। লোকসানে পড়তে হয় তাকে। এতে কিছুটা মনোবল হারিয়ে ফেলেন রাসেল। কেটে যায় একটি বছর। তবে কৃষি কর্মকর্তার পরামর্শে এবং ইউটিউব দেখে এবার তিনি নেমে পড়েন কুল চাষে।
২০২১ সালের শুরুতে কুষ্টিয়ার মেহেরপুর এলাকার একটি বাগান থেকে সংগ্রহ করেন কাশ্মিরী আপেল কুল, বল সুন্দরী ও ভরত সুন্দরী প্রজাতির কুল গাছ। গাছগুলো রোপণের পর নিজেই পরিচর্যা শুরু করেন। সঠিক পরিচর্যায় গাছগুলো বেড়ে উঠে এ বছর ফল ধরেছে সব গাছে। ২০২২ সালের সিত্রাং এ কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পরও গাছে গাছে দুলছে লাল আভা ছড়ানো থোকায় থোকায় কুল। পাকতে শুরু করেছে সপ্তাহ দুয়েক আগে থেকে। বিক্রিও শুরু করেন তিনি। আকার ও স্বাদে ভালো হওয়ায় বাজারে রাসেলের বাগানের কুলের চাহিদাও খুব বেশি। প্রথমে ১২০ টাকা কেজি করে বাজারে বিক্রি শুরু করেন তিনি। এখন ১০০ টাকা দরে বাজারে কুল বিক্রি করছেন রাসেল। এর মধ্যে কিছু কুলগাছ বারোমাসি ফলন দেয় আবার কিছু মৌসুম ভিত্তিক। ফলে সারা বছই তার বাগানে কুল পাওয়া যায়। মৌসুম ভিত্তিক গাছগুলোতে দুমাস আগে থেকে পাকতে শুরু করে কুল। এ বছর কম করে হলেও ১০ টন কুল বরই উৎপাদন হয়েছে তার বাগানে। এতে তিনি আয় করবেন প্রায় ১০ লাখ টাকা।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, রাসেলের বাগান জুড়ে কুল গাছ। লাল সাদা আর মেরুন রঙের বাহারি ফলে ভরে গেছে বাগান। কর্মচারীরা ব্যাগ ভর্তি করে বিক্রির জন্য গাছ থেকে পাড়ছেন পাকা কুল। পাখির কবল থেকে কুল রক্ষার জন্য পুরো বাগানের আকাশ জুড়ে টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে জাল। এসময় কথা হয় বাগান মালিক রাসেলের সঙ্গে।
রাসেল বলেন, তার বাগানের কুল বিষমুক্ত। গাছে ফুল আসার পর প্রথম একবার নিম পাতা থেকে উৎপাদিত জৈব বালাইনাশক ব্যবহার করেছি। আর কোনো ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করা হয়নি। এজন্য আমার বাগের কুলের চাহিদা অনেক বেশি। সেই সঙ্গে বিষমুক্ত ফল পেয়ে উপকৃত হচ্ছেন সাধারণ ক্রেতারা। চলতি মৌসুম শুরু থেকেই পাইকারি ব্যবসায়ীরা আমার বাগান থেকেই বড়ই কিনে নিয়ে যান। বর্তমানে আমার বাগানের খবর ছড়িয়ে পড়ায় এখন ঢাকা, বরিশাল, পটুয়াখালী এবং আমতলীর পাইকারি ফল ব্যবসায়ীরা ফল কেনার জন্য ভিড় করছেন।
প্রতিদিন রাসেলের বাগান থেকে ৩-৪ মণ কুল সরবরাহ হচ্ছে বিভিন্ন ব্যবসায়ীর কাছে। এভাবে প্রতিদিনই বাগান থেকে কম বেশি কুল কিনে নেন পাইকাররা। আগামী বছর থেকে তিনি কমপক্ষে ২৫ লাখ টাকা কুল বিক্রির আশা করছেন।
আমতলী উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা সি এম রেজাউল করিম জানান, রাসেল চাকরি হারিয়ে একসময় বেকার হয়ে পড়েছিলেন। আমাদের পরামর্শে কুলবাগান তৈরি করে তিনি এখন স্বাবলম্বী। কোনো ধরনের রাসায়নিক সার বা কীটনাশকের ব্যবহার না থাকায় এবং তার কুলের আকার ও স্বাদ ভালো হওয়ায় বাজারে চাহিদাও বেশি। রাসেলই প্রথম এই এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে কুল চাষ শুরু করেন। তার সাফল্যে ওই এলাকার আব্দুল আওয়াল ওরফে খোকন মৃধা, হানিফ মৃধা, আল আমিন খান, হারুন মৃধাসহ কয়েকজন বেকার যুবক নেমে পড়েছেন কুল চাষে। এভাবে অনেক বেকার যুবক নিজেদের কর্মসংস্থান তৈরি করতে সক্ষম হচ্ছেন। সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে এ কুলের আবাদ করলে চাষিরা একদিন অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে উঠবে। অপরদিকে পুষ্টিকর ফলের চাহিদাও পূরণ হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১০৪৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৮, ২০২৩
আরএ