ঢাকা, শনিবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

কৃষি

ইউটিউব দেখে ড্রাগন ফল চাষে সফল মাদ্রাসা শিক্ষক

শরীফ সুমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৪৩ ঘণ্টা, জুলাই ২৩, ২০২৩
ইউটিউব দেখে ড্রাগন ফল চাষে সফল মাদ্রাসা শিক্ষক

রাজশাহী: দেশে অপার সম্ভাবনার নতুন দুয়ার খুলে দিয়েছে ভিনদেশি ‘ড্রাগন ফল’। ড্রাগন ফল এখন কৃষক বা কৃষি উদ্যোক্তাদের কাছে একটি আশাজাগানিয়া ফল ও ফসল।

বিদেশি এ রঙিন ফলটি এখন কমবেশি অনেকের কাছেই খুব জনপ্রিয় ও আকর্ষণীয় ফল। যদিও সব মহলে খুব বেশি একটা পরিচিত হয়ে ওঠেনি এ সুস্বাদু রসাল ফল। এরপরও ইউটিউব দেখে নিতান্তই শখের বসে ড্রাগন ফল চাষ করে অবিশ্বাস্য সফলতা পেয়েছেন একজন মাদ্রাসা শিক্ষক।

কৃষি কর্মকর্তাদের ভাষ্যানুয়ায়ী দেশে ড্রাগন ফলের চাষ এখন আধুনিক কৃষির আশীর্বাদ হিসেবেই ধরা হচ্ছে। দেশের মাটিতে স্ট্রবেরি, মাল্টা, কমলা ও রাম্বুটানের মতই স্বাদ ও পুষ্টিগুণে ভরপুর এ ফল চাষ হচ্ছে বিভিন্ন অঞ্চলে। বলা যায় এগুলোর অনেক আগেই দেশের মাটিতে পরীক্ষামূলকভাবে ড্রাগন ফলের চাষ শুরু হয়। আশানুরূপ সফলতা পাওয়া দ্রুতই ড্রাগন ফলের প্রচার ও প্রসার ঘটে।

এখন বাণিজ্যিক দিক বিবেচনায় এর গুরুত্ব অনেক বেশি। বলা যায়, এককালীন বিনিয়োগ করে প্রায় দুই যুগ ধরে আয়ের উৎস গড়া যায় এ ড্রাগন ফলের বাগান থেকেই। মাত্র এক বিঘা জমি থেকেই প্রতি বছর কমপক্ষে পাঁচ লাখ টাকা আয় করা সম্ভব এ ফল চাষে। আর খরা প্রবণ বরেন্দ্র অঞ্চলে ক্যাকটাস প্রজাতির ফল চাষে সফলতার উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে।

যদিও এটি কৃষকদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে এখনও সেভাবে উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। তবে ব্যক্তিগতভাবে রাজশাহী অঞ্চলে এ ফল চাষ শুরু করেছিলেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তৎকালীন অতিরিক্ত উপ-পরিচালক মঞ্জুরুল হক। মূলত তার হাত ধরেই রাজশাহী অঞ্চলে ড্রাগন ফল চাষের সূচনা হয়।

কৃষকদের উৎসাহিত করতে নিজে ‘কৃষক’ হয়ে ২০১৬ সালে ২১ কাঠা জমিতে মেক্সিক্যান ফল ‘ড্রাগন’ চাষ করে সবাইকে অনেকটা চমকে দিয়েছিলেন তিনি। এরপর অনেকেই এখন তার কাছ থেকে ড্রাগনের চারা সংগ্রহ করে নিজেরাই চাষাবাদ শুরু করেন। অনেকটা এভাবেই ড্রাগন ফল বাগান ছড়িয়ে পড়ে রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে।

আর ইউটিউব দেখে ড্রাগন ফল চাষে উদ্বুদ্ধ হন রাজশাহীর আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী মাদ্রাসার শিক্ষক মোফাক্কার হোসেন। এক রকম শখের বসেই কৃষিবিদ মঞ্জুরুল হকের কাছ থেকে ড্রাগন ফলের চারা সংগ্রহ করে রাজশাহীর পবা উপজেলার বারনই নদীর তীরে থাকা পূর্ব পুঠিয়াপাড়া গ্রামের তিন বিঘা জমিতে গড়ে তোলেন স্বপ্নের ড্রাগন ফল বাগান।

পবা উপজেলার বারনই নদীর তীরবর্তী এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানকার প্রায় জমিতেই ড্রাগন চাষের পাশাপাশি শাক-সবজি চাষের কৌশল অবলম্বন করে কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন। প্রথমে একজন করছেন। এরপর তার সফলতা দেখে অন্যজন আগ্রহী হয়ে উঠছেন। এভাবে চক্রাকারে বাড়ছে দুই ফসলি আবাদ। আর তাদের সবার জন্য অনুকরণীয় হয়ে উঠেছেন শিক্ষক মোফাক্কার হোসেন।

তার বাগান ঘুরে দেখা যায়, সবুজ ক্যাকটাসের মতো কাঁটাযুক্ত প্রতিটি গাছেই ঝুলে আছে অসংখ্য ফুল ও ফল। কিছু ফল পেকে লাল টুকটুকে। আর কিছু ফল পাকার অপেক্ষায়। এছাড়া একই সঙ্গে গাছে হলদে রঙের ফুলও শোভা ছড়াচ্ছে।  

শিক্ষক মোফাক্কার হোসেন জানান, ক্যাকটাস প্রজাতির গাছ হওয়ায় এর জন্য বরেন্দ্র অঞ্চলের মাটি খুবই উপযোগী।

রাজশাহীর পবা উপজেলার বারনই নদীর তীরে থাকা পূর্ব পুঠিয়াপাড়া গ্রামের তিন বিঘা জমিতে তাই ড্রাগন ফলের চাষ করে এরই মধ্যে পেয়েছেন সফলতা। এরই মধ্যে তিনি অন্য কৃষি উদ্যোক্তাদের কাছে হয়ে উঠেছেন মডেল। পেশায় মাদ্রাসা শিক্ষক হয়েও ড্রাগন ফল চাষে নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন এ অঞ্চলে। পেয়েছেন নতুন পরিচিতিও।

জমিতে বেড তৈরি করে ড্রাগন চারা রোপণ করতে হয়। বেড তৈরি থেকে শুরু করে চারা রোপণ ও গাছের পরিচর্যায় এ পর্যন্ত তার প্রায় পাঁচ লাখ টাকারও বেশি খরচ হয়েছে। এ ক্ষেত সঠিকভাবে পরিচর্যা করলে প্রায় দুই যুগ টিকবে এবং দেবে ফল। আর এখানে সার প্রয়োগ, সেচ খরচ ও শ্রমিক খরচ বাদে প্রতি মৌসুমে কমপক্ষে দুই লাখ টাকা আয় হবে বলে জানিয়েছেন কৃষি কর্মকর্তারা।

বর্তমানে তার বাগানে লাল ও সাদা দুই প্রকারে ড্রাগন ফল রয়েছে। প্রতিটা গাছেই ড্রাগন ফল ধরেছে। যত দিন যাবে ততই বাড়বে ফলন। এরই মধ্যে তার বাগানের ড্রাগন ফল বাজারজাত করা শুরু করেছেন। বাজারে এখন মৌসুমে ফল ভরপুর থাকায় প্রতি কেজি ড্রাগন পাইকারি ২৫০ থেকে ৩০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ড্রাগন চাষের প্রথমে পরিচর্যাজনিত সমস্যার কারণে অল্প ফল পেলেও এবার গোটা ড্রাগনের বাগান জুড়ে মন জুড়ানো ফুল আর ফুল এসেছে। ফুল ফোটার ৩০ দিন পরই ফল তোলার উপযুক্ত হয়।

শিক্ষক মোফাক্কার হোসেন জানান, তিন বিঘা জমিতে আগে পেঁপে বাগান ছিল। ওই পেঁপে বাগান থেকে পাওয়া পুঁজি দিয়েই তৈরি করেছিলেন ড্রাগন ফলের এ বিশাল বাগান। তবে বাণিজ্যিকভাবে নয়, ইউটিউব দেখে শখের বসেই এ ড্রাগন ফল চাষে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। আর শুরুর গল্পটি রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক মঞ্জুরুল হকের হাত ধরেই। বর্তমানে তার বাগানে ৪৬০টি খুঁটি রয়েছে। প্রতিটি খুঁটিতে চারটি করে ড্রাগন ফলের গাছ রয়েছে। দৈর্ঘ্য-প্রস্থে ১০/৮ ফুট দূরত্বে এ ড্রাগন ফলের গাছগুলো লাগাতে হয়। এ গাছ যে কোনো মাটিতেই জন্মায়। তবে উঁচু জমি হতে হবে। পানি জমে থাকে এমন জমিতে ড্রাগন ফল চাষ করা যায় না। আর একেকটি মাতৃ গাছ থেকে এক বছরের মাথাই ফল পাওয়া যায়।

শিক্ষক মোফাক্কার হোসেন জানালেন এর চাষপদ্ধতি খুবই সহজ। জৈব সার ছাড়া আর অন্য তেমন কিছুই লাগে না। বিভিন্ন ভাগে এর ফল আসে এবং সংগ্রহ করা যায়। একবার ফল সংগ্রহ করলে তার কিছু দিনের মধ্যেই আবারও ফুল চল আসে। এভাবে প্রায় বছর জুড়েই ফল উৎপাদন ও সংগ্রহের কাজ চলে। আর তিনি ড্রাগন ফলের বাগানে সাথী ফসল হিসেবে এর আগে পর পর দুই বছর বাঁধাকপি চাষ করেছেন। এবার রোপণ করেছেন পেয়ারার চারা। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও কৃষি কর্মকর্তারা এরই মধ্যে তার ড্রাগন বাগান পরিদর্শন করেছেন বলেও জানান এ শিক্ষক।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (ডিডি) মোজদার হোসেন বলেন, পবার কৃষক মোফাক্কার হোসেন ড্রাগন ফল চাষে সফল হয়েছেন। তিনি একই জমিতে একই খরচে দুই-তিন জাতের ফসল উৎপাদন করার জন্য এখন ওই এলাকার বেকার যুবকদের কাছে উদাহরণ এবং অনুপ্রেরণার এক নাম। মোফাক্কার এ নতুন চাষাবাদ পদ্ধতি নিয়ে স্থানীয়ভাবে তরুণ চাষিদের মনে শক্তি যুগীয়েছেন। তার দেখাদেখি এখন অন্যরাও সাথী ফসল চাষ শুরু করেছেন। তারা কৃষি বিভাগ থেকে এজন্য সব ধরনের পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন বলেও উল্লেখ করেন।

ড্রাগন ফলের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি: ড্রাগন ফল চীনাদের কাছে পিতায়া নামেও পরিচিত। এর বৈজ্ঞানিক নাম হালো ‘ক্যারিয়াস আনডেটাস’। এটি এক ধরনের ক্যাকটাস প্রজাতির ফল। আর দেশে এ ফল মূলত ড্রাগন ফল হিসেবেই পরিচিত। এ ফলটি একাধিক রঙের হয়ে থাকে। তবে লাল রঙের ড্রাগন ফল বেশি দেখা যায়। সাধারণত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ক্যারিবিয়ান, অস্ট্রেলিয়া, মেসোআমেরিকা এবং বিশ্বের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ও উপক্রান্তীয় অঞ্চলে এ ড্রাগন ফলের চাষ বেশি হয়।

ড্রাগন ফলের উপকারিতা: বেশ কিছু প্রয়োজনীয় অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট পাওয়া যায় এ ড্রাগন ফল থেকে। এগুলো মানবদেহের সুস্থতার জন্য খুবই অপরিহার্য। এ ফল ফাইবার সমৃদ্ধ ও ফ্যাট ফ্রি। ফলে নিশ্চিন্তে ডায়েট লিস্টে রাখা যায় ড্রাগন ফল। প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ‘সি’ মেলে ফলটি থেকে। তাই নিয়মিত খেলে বাড়ে শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা। শরীরের জন্য ক্ষতিকর ও উপকারী ব্যাকটেরিয়ার সঠিক নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে ড্রাগন ফল। আয়রনের চমৎকার উৎস রঙিন এ ড্রাগন ফল। রক্তশূন্যতার সমস্যা দূর করতে চাইলে প্রতিদিনই এ ফল খেতে পারেন। মরণব্যাধি ক্যানসারের ঝুঁকি কমাতে সহায়তা করে ড্রাগন ফল।

এছাড়া ড্রাগন ফল রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে বিশেষ ভূমিকা। রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করায় ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমে। বিটা-ক্যারোটিন সমৃদ্ধ ফলটি নিয়মিত খেলে দৃষ্টিশক্তি ভালো থাকে ও ছানি পড়ার ঝুঁকি কমে। এছাড়া ড্রাগন ফলের ছোট কালো বীজেও রয়েছে অসাধারণ ভেষজ গুণ। ওমেগা থ্রি এবং ওমেগা নাইন ফ্যাটি অ্যাসিড থাকায় এগুলো হার্টের জন্য খুবই উপকারী।

বাংলাদেশ সময়: ১৭৪৩ ঘণ্টা, জুলাই ২৩, ২০২৩
এসএস/আরআইএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।