ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

কৃষি

দেশের প্রথম বাণিজ্যিক ঘোড়ার খামার ময়মনসিংহে

মো. আমান উল্লাহ আকন্দ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৪১ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৮, ২০২৩
দেশের প্রথম বাণিজ্যিক ঘোড়ার খামার ময়মনসিংহে

ময়মনসিংহ: দেশের প্রথম বাণিজ্যিক ঘোড়ার খামার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ময়মনসিংহের সদর উপজেলার বেগুনবাড়ি কোকিল গ্রামে।  

এতে স্থানীয় বাসিন্দাদের মাঝে বিস্ময় সৃষ্টির পাশাপাশি হাতছানি দিয়ে উঠেছে বাণিজ্যিক উৎপাদনে সম্ভাবনার নবদিগন্ত।

তার এই খামারের নাম  ‘সঞ্জু হর্স ফার্ম’।   

খামারের মালিক মো. শরীফুল ইসলাম সঞ্জু (৩৪)। অতীশ দীপঙ্কর বিবিদ্যালয় থেকে বিবিএ পাশ করা যুবক তিনি।  

এছাড়া স্থানীয় বীরমুক্তিযোদ্ধা মরহুম নূরুল ইসলাম মাস্টারের ছেলে তিনি।  

বর্তমানে তার খামারে রয়েছে সিন্দি, মারোয়াড়ি ও নোকড়া জাতের চোখ জুড়ানো ৭টি ঘোড়া। প্রতিটি ঘোড়ার মূল্য ২ থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত।  

জানা যায়, ছোট বেলা থেকেই ঘোড়দৌড় বা রেস খেলা খুব ভালো লাগত শরীফুল ইসলাম সঞ্জুর(৩৪)। আর এ কারণেই ২০০৭ সালে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হয়ে মায়ের কাছ থেকে দুই লাখ টাকা নিয়ে একটি ঘোড়া কিনে শুরু করেন রেস খেলা। এতে তিনি সফল হয়। দেশের নানা প্রান্তে অনুষ্ঠিত রেস খেলায় অংশ নিয়ে তিনি অর্জন করেন পুরস্কার ও অর্থ। তবে কয়েকদিন পর হঠাৎ তার সেই প্রিয় ঘোড়াটি অসুস্থ হয়ে মারা যায়। এতে সঞ্জু মর্মাহত হলেও স্বপ্ন তাকে আরও বড় কিছু করার আত্মবিশ্বাস জোগায়।

এরপর ২০২১ সালে ভারতের রাজস্থান ও পাঞ্জাব প্রদেশ থেকে আবারও সিন্দি, মারোয়াড়ি ও নোকড়া জাতের কয়েকটি ঘোড়া কিনে শুরু করে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ‘সঞ্জু হর্স ফার্ম’ নামে দেশের প্রথম ঘোড়ার খামার। বর্তমানে ওই খামারে ২ জন শ্রমিক নিয়মিত এই ঘোড়াগুলো পরিচর্যা করছে।    

ফলে প্রতিদিনই এলাকাবাসী ছাড়াও দেশের নানা প্রান্ত থেকে লোকজন আসছে এই ঘোড়ার খামার দেখতে এবং কিনতে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও আনসার একাডেমিতে এই খামারে ঘোড়া বিক্রি হয়েছে। এছাড়াও শখের বশে সমাজের উচ্চবিত্তরাও কিনে নিচ্ছে এসব ঘোড়া। এতে সে বেশ লাভবান বলেও জানান সঞ্জু।  

সরেজমিনে মঙ্গলবার (১৮ অক্টোবর) সকালে এই ঘোড়ার খামার দেখতে যায় বাংলানিউজের ময়মনসিংহ জেলা প্রতিনিধি। এ সময় খামারের আদ্যোপান্ত নিয়ে কথা হয় খামারি শরীফুল ইসলাম সঞ্জুর সঙ্গে।  

তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ঘোড়া পালনের কারণে প্রথমদিকে এলাকার মানুষ আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করত, টিপ্পনি কাটত। কিন্তু এখন অনেক দূরদূরান্ত থেকে লোকজন আসে এই খামার দেখতে। তা দেখে গ্রামের মানুষরা অবাক হয়, মুগ্ধও হয়।  

ঘোড়া প্রভুভক্ত প্রাণী উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ঘোড়াকে আপনি যা শেখাবেন, তাই সে শিখবে। ফলে এই ঘোড়া নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন রয়েছে। কিন্তু দেশে ঘোড়ার চাহিদা থাকলেও নেই খামার। ফলে প্রতি বছর বিদেশ থেকে ঘোড়া আমদানি করতে হয়। আর এ কারণেই আমি এই খামারেই ঘোড়া উৎপাদন করতে চাই। এতে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করাও সম্ভব। এক্ষেত্রে সরকারি সহযোগিতা অপরিহার্য।    

এ সময় তিনি আক্ষেপ করে বলেন, এক সময় ঘোড়দৌড় ছিল গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যের খেলা। কিন্তু বর্তমানে রেস করার জন্য ভালো ঘোড়া দেশে পাওয়া যায় না। অথচ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান যে রেসকোর্স মাঠে ৭ মার্চের ভাষণ দিয়েছিলেন, সেই মাঠটি ছিল ঘোড়া দৌড় বা রেস খেলার জন্য। তবে ১৯৪৯ সালে এই মাঠে ঘোড়দৌড় বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর থেকেই কদর কমতে শুরু করে ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতার। এতে সুস্থ বিনোদনের সুযোগ কমে যাওয়ায় মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে গ্রামের তরুণরাও। ফলে মাদকমুক্ত সমাজ গঠনে সরকার চাইলে আবারও জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে দেশে ঘোড়দৌড় আয়োজন করা সম্ভব। এছাড়া ঘোড়া দৌড় আন্তর্জাতিক মানের একটি খেলা। সারাবিশ্বে এই খেলার কদর রয়েছে। সেই সঙ্গে চিকিৎসা বিজ্ঞানেও ঘোড়ার দৌড় বা রাইডিং স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী বলেও প্রমাণিত।  

খামারের শ্রমিক রোকনুজ্জামান বাংলানিউজকে বলেন, ছোলা বুট, ধানের কুড়া, খড় ও সবুজ ঘাস ঘোড়ার প্রধান খাবার। ফলে সময় মেনে খাবার দিলে ঘোড়া পরিচর্যায় কোনো সমস্যা হয় না। এক্ষেত্রে ঘোড়ার লাথি এবং কামড় থেকে সাবধান থেকেই এসব করতে হয়। তবে আমাদের ঘোড়াগুলো পোষা হওয়ায় এ ধরনের কোনো সমস্যা আমাদের হয় না।  

এ সময় কথা হয় খামার দেখতে আসা স্থানীয় বাসিন্দা মো: সাদেক আলীর সঙ্গে।

তিনি বাংলানিউজকে বলেন, এই খামারের ঘোড়াগুলি সিনেমার ঘোড়ার চেয়েও সুন্দর। আগে এসব ঘোড়া সিনেমায় দেখলেও এখন এসব ঘোড়া আমাদের এলাকাতেই লালন পালন হচ্ছে। এ কারণে দেশের অনেক স্থান থেকে মানুষ এই খামার দেখতে আসে।  

তবে এই খামারে আসা-যাওয়ার সড়কটির বেহাল দশা। সংস্কারের অভাবে এই সড়কটিতে চলাচলে অনেক কষ্ট। ফলে সড়কটির সংস্কার এখন এলাকাবাসীর দাবিতে পরিণত হয়েছে।  

জানতে চাইলে জেলার অতিরিক্ত প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা: রাহেলা পারভীন রুমা বাংলানিউজকে বলেন, ওই ঘোড়ার খামারের সাথে প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাদের নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। প্রয়োজনীয় ওষুধ ও সেবা আমরা দিয়ে যাচ্ছি। তবে প্রাণিসম্পদের নিবন্ধনে ঘোড়ার বিষয়টি উল্লেখ না থাকায় বন ও পরিবেশ বিভাগ নিবন্ধন বিষয়টি দেখবে বলে মনে হয়।  

যেভাবে যেতে হবে খামারে 

দেশের এই ঘোড়ার খামারটি দেখতে হলে আসতে হবে ময়মনসিংহ জেলার সদর উপজেলার ২ নং কুষ্টিয়া ইউনিয়নের ৮ নং ওয়ার্ডের কোকিল গ্রামে। এক্ষেত্রে ময়মনসিংহ শহর থেকে টাউন হল হয়ে মুক্তাগাছা সড়কের বেগুনবাড়ি মোড়ে পৌঁছতে হবে। এরপর রিকশা বা অটোরিকশা যোগে বাইগুনবাড়ি রেলওয়ে স্টেশনের পাশ দিয়ে সামনে এগিয়ে গেলেই দেখা মিলবে ছবির মত আঁকা গ্রাম কোকিল। এই গ্রামেই মরহুম বীরমুক্তিযোদ্ধা নূরুল ইসলাম মাস্টারের বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত দেশের প্রথম ঘোড়ার খামার ‘সঞ্জু হর্স ফার্ম’।  

বাংলাদেশ সময়: ১৬৩৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৮, ২০২৩
এসএএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।