ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

কৃষি

কষ্টই তাদের সুখ

মান্নান মারুফ, সিনিয়র স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫৫৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ২১, ২০১৬
কষ্টই তাদের সুখ ছবি: নূর-বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: কেউ মালিক, কেউ বা ভ্যান চালক। এরপরও তাদের আরেকটি পোশাকি পরিচয় আছে, তা হচ্ছে রাজধানীর বিভিন্ন কাঁচাবাজারের বিক্রেতা।

রাতভর ভ্যানে করে সবজি নিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে নিয়ে যান খেটে খাওয়া এসব মানুষ। পরে সকাল থেকে তা ভ্যানে কিংবা দোকানে বসে বিক্রি করেন।

আর তাতে যা আয় হয়, তা দিয়েই চলে সংসার। ‘কাঁচা’ টাকা নিয়ে ঘরে ছেলে-মেয়েদের মুখে হাসি দেখে নির্ঘুম রাতের নির্জলা কষ্টের কথাও ভুলে যান তারা।

বলছি রাজধানীর বিভিন্ন কাঁচাবাজারের খুচরা সবজি বিক্রেতাদের কথা। যারা নিত্যদিন রাতেই ভিড় করেন রাজধানীর পাইকারি বাজার কারওয়ান বাজারে।

অন্যান্য দিনের মতো বুধবার (২০ এপ্রিল) দিনগত রাতেও সেখানে গিয়ে তাদের জড়ো হতে দেখা গেলো। উদ্দেশ্য সবজিসহ  অন্যান্য খাদ্যপণ্য সংগ্রহ করা।

মোহাম্মদপুর থেকে ভ্যান নিয়ে কারওয়ান বাজারে এসেছেন নড়াইলের বরকত আলী। নিজেই বিক্রেতা, তিনি আবার চালকও।

এরইমধ্যে নানা ধরনের সবজি দিয়ে বোঝাই করেছেন তার ভ্যান। জানালেন, পটল, ঢেড়স, ডাটা, পুঁইশাক, চিচিঙ্গা, করলাসহ বিভিন্ন ধরনের শাক-সবজি কিনেছেন তিনি। সবজি ভর্তি বস্তা ভ্যানে তুলেছেন। এবার অপেক্ষা গন্তব্যে রওনা দেওয়ার।

‘রাইত ১-২টার দিকে কারওয়ান বাজার থাইক্যা মোহাম্মদপুর কাঁচাবাজারের দিকে রওনা দিবো,’ বলেন বরতক।
 
তার ভাষায়, প্রত্যেকদিনই এইহান থাইক্যা মাল কিনি। আইজকে কিনছি সাড়ে ৩হাজার টাকার। এইগুলা বেইচ্যা প্রায় দেড়-দুইহাজার টাকা লাভ অয়, তা দিয়াই খায়া পইড়া চলি। বেশ ভালা কইরাই চইল্যা যায় আমাগোর সংসার।

খুচরা বিক্রেতারা জানান, রাজধানীর সব কাঁচাবাজার থেকে প্রতিরাতেই কারওয়ান বাজার অথবা যাত্রাবাড়ীতে মাল কিনতে জড়ো হন ব্যবসায়ীরা। কেননা এই দুই বাজারে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে মালামাল আসে।

এরপর তা কিনতে কেউ নিজেদের ভ্যান নিয়ে আসেন, কেউ আবার ভাড়া ভ্যান নিয়ে জড়ো হন মালামাল কিনতে।  

খিলগাঁওয়ের গোড়ান কাঁচা বাজারের বিক্রেতা আবদুস সালাম জানান, প্রতিদিন রাত ১১টা থেকে ১২টার সময় মাল কিনতে কারওয়ান বাজারে আসেন তিনি। তাদের পুঁজি ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা।

‘বাজার ভালো হলে একদিন সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত মাল কিনি। তয় মাঝে মাঝে লোকসানও অয়,’ বলেন তিনি।

বাংলানিউজকে আবদুস সালাম বলেন, রাত ভইরা কষ্ট করনের পর আমাগোর দুই-আড়ই হাজার টেকার মতো থাকে। তা দিইয়াই চইল্যা যায়।

‘রাইতে মানুষ ঘুমায়, আর আমরা না ঘুমায়া ভ্যান ঠেলে মাল কিনি। এতো কষ্টের পরও লাভের মুখ দেখলে সব ভুলে যাই,’ বেশ প্রত্যয়ের সঙ্গে বললেন তিনি।

এদিকে বিভিন্ন ধরনের শাক-সবজি ভ্যানে বোঝাই করে গন্তব্যে রওনা দেওয়ার অপেক্ষা করছেন সালামসহ আরও অনেক বিক্রেতা।

পথের ধারে টঙ দোকান থেকে চা-পাউরুটি খেয়ে নিচ্ছেন, কেউবা ভ্যানে রাখা সবজিতে হেলান দিয়ে কিংবা খালি ভ্যানে শ‍ুয়ে কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে নিচ্ছেন।

তাদের মধ্যে একজন নোয়াখালীর মাইজদীর আবদুল কাদের। তার সঙ্গে আরও কয়েকজনকে বিশ্রাম নিতে দেখা যায়।
কাদের বলেন, মাল কিন‍া শেষ। রওনা দেওয়ার অপেক্ষা আছি। সাড়ে তিনটার দিকে শান্তিনগর বাজারের উদ্দেশে রওনা দিবো। তাই একটু জিরায়ে নিতাছি।

‘ভ্যান ভাড়া দিয়ে আড়াই-দুইহাজার টাকা থাকবো আশা করি। ভ্যান ভাড়া দিতে অয় ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা। ’

পরিশ্রম বেশি হয় কিনা? এমন প্রশ্নের উত্তরে বললেন, কষ্ট তো অয়ই, এরপরও আমরা খুশি; বাজার ভালা থাকলে এই কষ্ট হানি অইয়া যায়। তহন মনে অয়, খুব ভালা আছি।

পরিশ্রম, নির্ভেজাল ও সৎ পথে আয়ের পরও একটা ভয় থেকে যায় সত্যিকারের কর্মঠ এই মানুষদের। কারওয়ান বাজারে আসা-যাওয়ার পথে যে কোনো সময় ছিনতাইয়ের কবলে পড়ার আতঙ্কে থাকেন তারা।

সবজি বিক্রেতা কালু মিয়া বলেন, রাস্তায় গুন্ডা-পান্ডাদের ভয় হয়। কখন টাকা-পয়সা নিয়া মাইরা ফালায়। কারণ আমাদের সাথে যা থাকে সেইডাই তো সম্বল, পুঁজি।

‘তা ছিনিয়ে নিলে পথে বসা ছাড়া আর অন্য পথ নাই,’ যোগ করেন কুষ্টিয়া ভেড়ামাড়ার কালু মিয়া।

রাজধানীর শ্যামলী কাঁচাবাজারের এই খুচরা বিক্রেতা বলেন, ছেলে-বৌদের নিয়ে ঢাকায় এই ব্যবসা করে চলি। আমি রাতে মাল নিয়া যাই আর দিনে ছেলে দোকানদারি করে। আমি একটু ঘুমায়ি নিই।

রাজধানীর বিভিন্ন কাঁচাবাজার ও ভ্যানে করে সবজি বিক্রি করতে গেলেও ‘চাঁদা’ দিতে হয় বলে অভিযোগ করেছেন বিক্রেতারা। তবে কারও নাম বলতে রাজি হননি তারা।

বাংলাদেশ সময়: ০৫৪৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ২১, ২০১৬
এমএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।