ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

কৃষি

সুশীলনে ভাগ্যবদল

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩৩৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৯, ২০১৭
সুশীলনে ভাগ্যবদল সুশীলনের কর্মীসভা/ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

খুলনা: সুন্দরবনের কোলঘেঁষা এক অজো পাড়াগাঁয়ের গৃহবধূ সেলিনা। অভাব-অনটন ছিল নিত্যসঙ্গী। কখনো কখনো দু'বেলা দু'মুঠো খাবার জোটেনি তার পরিবারের। সময়ের পরিবর্তনে আজ তিনি স্বাবলম্বী। ১০ বিঘা জমি ও মার্কেটের ১০টি দোকানের মালিক। আছে ব্যাংক ব্যালেন্স, মাছের ঘের। তার স্বাবলম্বী হওয়ার পিছনে বড় অবদান রেখেছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সুশীলন।

নিজের মুখেই অকপটে বাংলানিউজের কাছে তুলে ধরেন তার উন্নতির পিছনে সুশীলনের অবদানের কাহিনি।

সেলিনা জানান, ১৯৯৯ সালে তিনি সুশীলনের সদস্য হন।

প্রথমে দেড় হাজার টাকা লোন নেন। একাধিক প্রশিক্ষণ নেন। তারপর হাঁস-মুরগি ও পরে গরুর খামার করেন। এসব দিয়ে ক্রমেই তার ভাগ্যের চাকা ঘুরতে থাকে।
সুশীলনের বিভিন্ন কার্যক্রমের দৃশ্য

তিনি বলেন, ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় বড় বেতখালীর আবু সাঈদের সঙ্গে বিয়ে হয়। লেখাপড়ার মর্ম তখন বুঝতে পারিনি। সুশীলনে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ নিয়ে বুঝতে পারি লেখাপড়ার গুরুত্ব। আবার শুরু করি পড়া-লেখা। গতবছর ছেলের সঙ্গে এইচএসসি পাস করেছি। বর্তমানে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার মুন্সীগঞ্জ ইউনিয়নের ৭, ৮, ৯ নং ওয়ার্ডের সংরক্ষিত আসনের মহিলা মেম্বার। সুশীলনের সাধারণ পরিষদের সদস্য। এসব কিছুই হয়েছে সুশীলনের কারণে।

আগামীতে ইউপি চেয়ারম্যান প্রার্থী হবেন বলে জানান তিনি।

সুশীলনের কারণে বদলে গেছে সাতক্ষীরা সদরের কামাল নগরের শাহানারার জীবনও। ২০০১ সালে তিনি সুশীলনের অফিস সহকারীর চাকরিতে যোগ দেন। এরপর সুশীলনের কার্যক্রম দেখে লেখাপড়ায় উদ্বুদ্ধ হন। এক পর্যায়ে লেখাপড়া শুরু করে ডিগ্রি শেষ করেন।

তিনি বলেন, পিতৃতুল্য সুশীলনের নির্বাহী পরিচালক মোস্তফা নূরুজ্জামানের সাহস ও সহযোগিতায় বন্ধ হয়ে যাওয়া লেখাপড়া আবার শুরু করে ডিগ্রি পাস করতে পেরেছি। সুশীলনের অবদানের কারণে আজ আমি দরিদ্রতা জয় করে মাঠকর্মী হিসেবে চাকরি করে মাসে ২১ হাজার টাকা বেতন পাচ্ছি।  
 
সেলিনা ও শাহানারার মতো শত শত হতদরিদ্র শিক্ষা ও কর্মবঞ্চিত মানুষের ভাগ্যের চাকা ঘুরেছে সুশীলনের ছোঁয়ায়।

সুশীলন সূত্রে জানা যায়, ১৯৯১ সালে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের জেলা সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলায় কৃষ্ণনগর ইউনিয়নের বেনাদনা গ্রামে সুশীলনের জন্ম। একদল তরুণ সুশীলন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। সরকারের সমাজসেবা অধিদপ্তর, এনজিও ব্যুরো, মাইক্রো ক্রেডিট রেগুলেটরি অথোরিটির অনুমোদনক্রমে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের অবহেলিত মানুষকে সামনে অগ্রসর করার জন্য একটি কার্যকরী গতিশীল নেতৃত্বসম্পন্ন জনগণের সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

প্রদর্শনী প্লট
এ পর্যন্ত সুশীলন জাতীয় ও আন্তজার্তিক দাতা সংস্থার মাধ্যমে ২৫৪টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। এর মধ্যে ২১৪টি সমাপ্ত হয়েছে এবং ৪০টি প্রকল্প বর্তমানে চলমান। সুশীলন এ পর্যন্ত প্রায় ১০৬টি দাতা সংস্থার কাছ থেকে অনুদান নিয়েছে। যার মধ্যে বর্তমানে ৩০টি চলমান।  

বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান- যেমন, ইরি, বিরি, বারি, বীনা এসআরডিআই, এফআরআই এর সঙ্গে কাজ করে প্রতিষ্ঠানটি। সুশীলনের কাজ কৃষক ও গবেষকের মধ্যে সমন্বয় করা।

সুশীলনের নির্বাহী পরিচালক মোস্তফা নূরুজ্জামান বাংলানিউজকে বলেন, সুশীলনের মূল দর্শন হচ্ছে মানুষ অসীম সম্ভাবনার আধার; সেই সম্ভাবনার বিকাশ ঘটানো এবং সেই অর্জন মানুষের কল্যাণে কাজে লাগানো। সুশীলনের নীতিমালার মধ্যে অন্যতম প্রধান হচ্ছে সাম্য ও নিরপেক্ষতা এবং জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণ। ভিশন হচ্ছে আর্থ-সামাজিক বিকাশ উপযোগী সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। সমাজে পিছিয়ে পড়া প্রায় সব ধরনের মানুষের সঙ্গে সুশীলন কাজ করে। বর্তমানে সুশীলন দেশের ৭টি বিভাগের ৪২টি জেলার ১৯৭টি উপজেলায় ৪৫টি অফিসের মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করে চলেছে। কাজ করছে প্রায় দু’হাজার কর্মী। তারা দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রেখে চলেছে।

তিনি জানান, সুশীলনের কার্যক্রম পরিচালনার পথ পরিক্রমায় নানা অভিজ্ঞতার পাশাপাশি লাভ করেছে বিভিন্ন পর্যায়ের স্বীকৃতি, অর্জন করেছে বিভিন্ন পুরস্কার।   যেমন, ১৯৯৯, ২০০২ ও ২০০৮ সালে রাস্তায় বনায়ন বিষয়ে বৃক্ষরোপণে প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় পুরস্কার লাভ করে। এছাড়া বিশ্ব পরিবেশ দিবসে ২০১৫ সালে পরিবশে অধিদপ্তর, খুলনার দ্বিতীয় পুরস্কার অর্জন করে। সাতক্ষীরায় ২০০০ সালের বন্যা, সিডর, আইলা, জলাবদ্ধতা, মহাসেন, রোয়ানু, মোরায় প্রায় ৭ লাখেরও বেশি পরিবারকে সহযোগিতা করে সুশীলন। বিশেষ করে সিডরে খুলনা ও বরগুনা জেলায় প্রায় এক লাখ পরিবারকে ১০ মাস রেশন দেওয়া হয়।

তিনি বলেন, আমরা এ পর্যন্ত প্রায় ৪০ হাজার হতদরিদ্র মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছি। প্রতিবছর সুশীলন ৫০ হাজারের বেশি মানুষকে প্রশিক্ষণ দেয়। এরমধ্যে আইসিটির মাধ্যমে ৩২টি জেলায় সাংবাদিকদের আউটসোসিংয়ের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। ১০ হাজারের বেশি বাওয়ালি, মৌয়াল, জেলে সম্প্রদায়ের লোকদের যাতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সুন্দরবনে যেতে না হয় তার জন্য বিকল্প কর্মব্যবস্থা করা হয়েছে। ৪০ হাজারের বেশি কৃষককে সংগঠিত করেছে। তাদের বীজ, কৃষি উপকরণ ট্রাক্টর, মাটি-পানির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে সুপারিশ কার্ড দেওয়া, বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চলের এক ফসলি জমিকে বহু ফসল ফলানোর ব্যাপারে কৃষকদের দক্ষ করে তুলেছে সুশীলন।
হতদরিদ্রদের দেওয়া সুশীলনের ভ্যান/ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম‘নারী নেতৃত্বের ক্ষেত্রে সুশীলন স্বাধীকার সংগঠন তৈরির মাধ্যমে নানা ধরনের নেতৃত্ব দেওয়ার কাজে সম্পৃক্ত করে নারীদের নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। প্রায় দশ হাজারের বেশি অসহায় পরিবারকে গৃহ নির্মাণ করে দিয়েছে। ’

নির্বাহী পরিচালক আরও বলেন, সুশীলন আজ হাঁটি হাঁটি পা পা করে ২৬ বছর অতিবাহিত করতে চলেছে। সুশীলনকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে একদল দক্ষ কর্মীবাহিনী অক্লান্ত কাজ করে চলেছে। সুশীলন স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার মধ্য দিয়ে কার্যক্রম সম্পাদন করে দেশি-বিদেশি সংস্থা ও সরকাররের কাছে প্রশংসা পেয়ে আসছে।

দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য উন্নয়নের এ ধারা অব্যাহত রাখতে চায় সুশীলন।
 
বাংলাদেশ সময়: ২০৩৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৮, ২০১৭
এমআরএম/এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।