ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

কৃষি

আবারও তরমুজের বীজ নিয়ে প্রতারণা, হাহাকার চাষিদের

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৩৪ ঘণ্টা, মে ২, ২০২০
আবারও তরমুজের বীজ নিয়ে প্রতারণা, হাহাকার চাষিদের

কুষ্টিয়া: ‘চাষের জন্য হাতের জমানো টাকা শেষ, বিভিন্ন লোকের কাছ থেকে ধার করেছি। নিয়েছিলাম এনজিও থেকে ঋণ। লোকের জমিতে কাজ করে জন বেচে নিজের সংসার চালায়। সংসারে টানাপোড়েন অনেক কষ্ট করে জমিতে চাষ করি। নিজের জমি-জমা নাই, বর্গা নিয়েছি। অনেক কষ্টের ধন, সবই শেষ। একেবারেই পথে বসে গেছি। আমাদের দেখার কেউ নাই। এই কষ্ট কার কাছে গিয়ে বলবো। ধার দেনায় পুরো ডুবে শেষ।’

কথাগুলো বলছিলেন বর্গা চাষি রেজাউল হক। তিনি কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার সদরপুর ইউনিয়নের পুরাতন আজমপুর এলাকায় চার বিঘা জমি বর্গা নিয়ে হাইব্রিড জাতের তরমুজ চাষ করেছিলেন।

আরেক চাষি নিয়াত আলী লালু। এলাকার মডেল চাষি তিনি। নিজের জমির পাশাপাশি ১২ বিঘা জমি বর্গা নিয়েও এবার চাষ করেছেন তরমুজ। বিগত বছর তামাকের সময় শিলাবৃষ্টি এবং ঝড়ে পুরোটাই লস হয়েছিল। কোম্পানির পিছে ঘুরে ঘুরে কোনো ক্ষতিপূরণ পাননি তিনিসহ তামাক চাষিরা। তাই এবার তামাকের বিকল্প হিসেবে করেছেন তরমুজের চাষ। এক দাগে ১২ বিঘা জমিতে তরমুজ করেন তিনি।

বিঘাপ্রতি পাঁচ হাজার টাকা করে নিয়ে তরমুজের চাষ করেন তিনি। তরমুজ গাছের সুন্দর লতা দেখে খুশি হয়েছিলেন তিনি। তার জমিতে ধরেছে অসংখ্য তরমুজের ফুল। তরমুজের লাভ হওয়ার স্বপ্ন এসে তার দৌড়গোড়ায় হাতছানি দিচ্ছিলো। মৌঁমাছিরাও এসব ফুলে দিশেহারা প্রায়। সারাক্ষণ ফুল নিয়ে মেতে আছে মৌঁমাছিরা। কিন্তু ফুল ধরলেও বারো বিঘায় ধরেনি ১২টা তরমুজ। বাজারে চাহিদা বেশ ভালো তরমুজের কিন্তু জমিতে নেই তরমুজ। বর্গা নিয়ে চাষ, ধার দেনা করে সার, লেবার খরচ দিয়েছেন তিনি। ফল না আসায় দিশেহারা প্রায়। সব স্বপ্নই মাটির সঙ্গে মিশে গেছে তার।

শুধু এই এলাকার কৃষক রেজাউল কিংবা লালুর জমি না। সদরপুর ইউনিয়নের পুরাতন আজমপুর এবং কাকিলাদহ এলাকার প্রায় ১৬ জন কৃষকের ৫৬ বিঘা জমির তরমুজ ক্ষেতের একই অবস্থা। গাছের লতা জুড়ে ফুল থাকলেও নেই ফলের দেখা। স্বপ্ন কাছে পাওয়ার কৃষকের হাসিটা যেন মলিন হয়ে পড়েছে এসব তরমুজ চাষিদের।
ছবি: বাংলানিউজজানা যায়, ওই কৃষকেরা প্রায় পাঁচ মাস আগে এআর মালিক নামের একটি বিজ কোম্পানির ঝিনাইদহ এজেন্টের মাধ্যমে তরমুজের বীজ কেনেন। পরে তারা একই এলাকায় প্রায় ৫৬ বিঘা জমিতে এসব বীজ বপন করেন। বীজ থেকে সময়মতো চারা গজিয়ে লতানো গাছে ক্ষেত ছেয়ে যায়। ফুলও ধরে। কিন্তু তরমুজ ধরেনি। দু-একটি গাছে একটি-দুটি তরমুজ ধরলেও তা আকারে খুবই ছোট। বীজ কোম্পানির পরামর্শমতো কৃষকেরা ঠিক সময়ে সার, কীটনাশক দিয়েও কোনো ফল পাননি। এখন সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছেন এসব চাষিরা।

কৃষক নিয়াত আলী বাংলানিউজকে জানান, বিঘাপ্রতি পাঁচ হাজার টাকায় আমি ১২ বিঘা জমি বর্গা নিয়ে এরআর মালিক কোম্পানির তরমুজ বীজ বপন করি। গাছে ফুল এসেছে তবে কোনো ফল ধরেনি। জমিতে জৈব সার, বালাইনাশক সবই দিয়েছি। তবে কোনো লাভ হচ্ছে না। গাছের গ্রোথ ভালো তবে ফল নেই। আমাদের সঙ্গে লাগানো অন্য এলাকায় খোঁজ নিয়েছি। তারা বাজারে বিক্রি করেছেন। দামও পেয়েছেন ভালো। ’
  
তিনি বলেন, কোম্পানির লোকজন বলেছিলো ফল না আসলে টাকা ফেরত দেবে। আমরা চাষিরা গরীব মানুষ। বড় আসা করে তরমুজের চাষ করেছি। তবে এখন দেখছি সবই শেষ। অনেকেই বলছেন এটা নাকি বীজের দোষে হয়েছে।
  
আরেকজন কৃষক বাবুল হক বাংলানিউজকে বলেন, ‘বিঘাপ্রতি আমরা ২২-২৫ হাজার টাকা করে খরচ করে ফেলেছি। এখন পর্যন্ত ২২টা তরমুজও ধরেনি। চার মাস হয়ে গেলো লাগানো। কোম্পানির লোকজন বলেছিল অনেক তরমুজ পাবো। গাছ ভালো হলেও নেই তরমুজ। এখন আমাদের পুরোটাই লস। ’

কৃষক সাইফুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, সারা বিশ্বে করোনা ভাইরাসের মহামারি চলছে। এতে আমাদের আর কিছুই নাই। মহামারি আমাদের মাঠেই হয়েছে। সহায় সম্বল দিয়ে চাষ করেছি। হাতেও টাকা নেই। আমরা তো না খেয়ে মরবো। অনেকের কাছেই ধার দেনা করে তরমুজ চাষ করেছি। বাজারে তরমুজের যে দাম ক্ষেতের কথা চিন্তা করলে বুকটা ফেটে যায়। চার বিঘা জমির তরমুজ সব শেষ।

তরুণ তরমুজ চাষি রাসেল মল্লিক। লেখাপড়া শেষ করে বেকার অবস্থায় তিনি। তরমুজ চাষে অনেকের সাফল্যের কথা শুনে তিনিও চাষ করেছিলেন ৬ বিঘা জমিতে তরমুজ। ব্যবসার জন্য টাকা দিবে না পরিবার। বাবার ব্যাংকের জমানো টাকা জোর করেই নিয়ে চাষ করেছিলেন তরমুজ। অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন তিনি। ছেলের এমন কাজ দেখেও খুশি হয়েছিলেন তার বাবাও। তরমুজ ক্ষেতের চারপাশে দিয়েছেন শক্ত বেড়াও। ক্ষেতের সার্বক্ষণিক যত্ন নেওয়ার জন্য বাড়িতেও থাকেন না তিনি। তরমুজ ক্ষেতের এক কোনে বাঁশের মাচা করে সেখানেই দিন রাত থাকেন তিনি। ক্ষেতে নেই কোনো আগাছার চিহ্নও। লতা দেখে এলাকার মানুষের প্রাণ ভরলেও হতাশ রাসেল। ’

রাসেল মল্লিক বাংলানিউজকে বলেন, লাভের আশায় এই তরমুজ চাষ করেছিলাম। বাজারে তরমুজের দাম বেশ ভালো। কোম্পানি, কৃষি অফিসের দেওয়া সব পরামর্শই নিয়েছি। দুই হাতে টাকা খরচ করেছি এই ক্ষেতে। স্বপ্ন বলতে এই তরমুজ ক্ষেতই ছিলো। এই ক্ষতি সামাল দেওয়ার মতো শক্তি আমার এখন আর নেই। এসব গাছ কেটে ফেলা ছাড়া কোনো উপায় নেই।
ছবি: বাংলানিউজ
রেজাউল, লালু, সাইফুল. বাবুল, রাসেলের মতো একই অবস্থা অন্য চাষিদের। একেক জনের তরমুজ ক্ষেত যেনো একেকটি কষ্টের গল্প।  

এ বিষয়ে উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা সাদ্দাম হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, আমরা নিয়মিত জমি পরিদর্শন করেছি। বিভিন্ন পরামর্শ দিয়েছি। জমিতে রোগ কিংবা পোকার আক্রমণ হয়নি। গাছের গ্রোথ ভালো হয়েছে। ফুলও অনেক বেশি হয়েছে। তবে ফল আসেনি। এলাকার ৫০-৬০ বিঘা জমির তরমুজ চাষিদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

কি কারণে এমনটা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অনেক সময় মেয়াদোর্ত্তীণ বীজ বা ভেজাল বীজের কারণে ফুল আসলেও ফল হয় না। তবে একই এলাকার কৃষক শেরেবুল ইসলাম অন্য একটি কোম্পানি থেকে হাইব্রিড জাতের তরমুজ চাষ করে বেশ ভালো ফলন পাচ্ছেন তিনি। তার জমিতে ফুলের পাশাপাশি রয়েছে ভালো মানের তরমুজও।

ফুল আসলেও ফল না হওয়ার কারণ সম্পকে জানতে চাইলে এরআর মালিক সীড কোম্পানীর এরিয়া ম্যানেজার (মার্কেটিং) আব্দুল হালিম বাংলানিউজকে জানান, আমাদের কোম্পানির হাইব্রিড তরমুজ বীজ পাকিজা অন্য এলাকায়ও চাষ করেছে চাষিরা। সেখানে ভালো ফলন পেয়েছে। তবে মিরপুর উপজেলার সদরপুর ইউনিয়নের প্রায় ৫০ বিঘার উপরে জমিতে এই অবস্থা দেখা দিয়েছে। এমনটা তো হওয়ার কথা না। তবে কেনো এমনটি হয়েছে তা সঠিক বলা যাচ্ছে না।

কৃষকদের অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, আমাদের বীজের মান তো ভালো। মেয়াদ তো ঠিকই ছিলো বীজের।

মিরপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রমেশ চন্দ্র ঘোষ বাংলানিউজকে জানান, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, বীজের গুণগত মান খারাপ হওয়ার কারণেই তরমুজ ক্ষেতে ফল আসেনি। বিষয়টি আমরা খুব গুরুত্ব সহকারে নিয়েছি। এরআগেও মিরপুর উপজেলার বারুইপাড়া ও মশান এলাকায় এক কোম্পানির বীজের প্রতারণার কারণে তরমুজ চাষিদের এই অবস্থা হয়েছিল।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক (শস্য) রঞ্জন কুমার বাংলানিউজকে জানান, বীজের কারণে যদি কোনো কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাহলে লিখিত অভিযোগ পেলে তদন্তপূর্বক আমরা ওই কোম্পানির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। কৃষকদের এমন ক্ষতি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।

বাংলাদেশ সময়: ১১৩০ ঘণ্টা, মে ০২, ২০২০
এনটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।