ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

কৃষি

নাটোরে সাড়ে ১১ হাজার কৃষকের স্বপ্ন সরিষার হলুদ ফুলে

মো. মামুনুর রশীদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৫৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৩, ২০২০
নাটোরে সাড়ে ১১ হাজার কৃষকের স্বপ্ন সরিষার হলুদ ফুলে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঝিকমিক করতে থাকে সবুজ গাছের মধ্যে সরিষার হলুদ ফুলগুলো/ ছবি: বাংলানিউজ

নাটোর: শিশির ভেজা শীতের সকাল। চারিদিকে কুয়াশার চাদরে ঢাকা চলনবিলের বিস্তৃত ফসলের মাঠ।

এরই মধ্যে সোনা ঝরা রোদ পড়লে মনে হয় যেন সাজানো রয়েছে হলুদের বিছানা। যেন এক অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি। প্রকৃতি কন্যা হলুদ রঙ মেখে বসে আছে সমগ্র মাঠজুড়ে।

বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঝিকমিক করতে থাকে সবুজ গাছের মধ্যে সরিষার হলুদ ফুলগুলো। আর ফুল থেকে মধু আহরণে ব্যস্ত মৌমাছিরা। অন্যদিকে হলুদ ক্ষেতের মধ্য দিয়ে আনন্দ উল্লাসে ছুটে চলে শিশুরা। কোথাও হলুদ আর সবুজের মিশ্রণ, আবার কোথাও পুরোটাই হলুদ। সব মিলিয়ে যেন এক অপরূপ রূপে সেজেছে চলনবিলের বিস্তীর্ণ মাঠ।    

সম্প্রতি চলনবিলের বন্দর এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিনে ঘুরে এমন দৃশ্য দেখা যায়। এ সময় কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গেল বন্যায় রোপা আমনের ক্ষয়ক্ষতি কেড়ে নিয়েছে এই এলাকার অন্তত ২৯ হাজার ৯১৩ জন কৃষকের স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন পূরণে এবং ক্ষয়ক্ষতি কাটাতে এবার ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা অনেকটা আগে ভাগেই কোমর বেঁধে নেমেছেন সরিষা চাষাবাদে। আর এই সরিষা আবাদই বন্যায় কেড়ে নেওয়া কৃষকের সেই স্বপ্ন পূরণসহ গ্রামীণ অর্থনীতিতে দেখা দিচ্ছে সম্ভাবনার হাতছানি। আবহাওয়া ও পরিবেশ অনুকূলে থাকলে এই সম্ভাবনার অনেকটাই বাস্তবায়ন হবে বলে আশা করছেন কৃষকরা।

কৃষিবিভাগ জানিয়েছে, চলনবিল অধ্যুষিত নাটোর জেলায় তিন ধাপের বন্যায় রোপা আমনের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে জেলায় এবার সাড়ে ১১ হাজার কৃষক সরিষার চাষ করছেন। আসন্ন বোরোর আগেই এই ফসল ঘরে তুলতে পারবেন বলে আশা প্রকাশ করছেন কৃষকরা। সেই লক্ষ্য নিয়ে বিগত বছরের তুলনায় কৃষকরা এবার সরিষা চাষাবাদের প্রতি বেশি ঝুঁকে পড়েছেন। এই কাজে কৃষি বিভাগও অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে।  

এজন্য সরকারের পুনর্বাসন কর্মসূচির আওতায় ১০ হাজার কৃষক এবং রবি ও খরিপ -১ এর  ২০২০-২১ মৌসুমে কৃষি প্রণোদনা কর্মসূচির আওতায় দেড় হাজার কৃষককে বিনামূল্যে সরিষা বীজ ও ২১০ মেট্রিক টন ডিএপি এবং এমওপি সার দিয়েছেন কৃষিবিভাগ।

এসবের সঠিক প্রয়োগ বা ব্যবহার হলে সরিষা আবাদ থেকেই কৃষকরা অনেকটাই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবেন। তাদের স্বপ্ন পূরণ হবে অনেকাংশে। জেলায় এবার ৬ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে সরিষা আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ পর্যন্ত অর্জিত হয়েছে ৫ হাজার ৬৮০ হেক্টর। মোট উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৮ হাজার ৯১০ মেট্রিক টন। এবার লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। গত মৌসুমে সরিষা চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ ছিল ৭ হাজার ৩১৯ হেক্টর। সেখানে অর্জিত হয় ৬ হাজার ৫৪২ হেক্টর। আর মোট শস্য উৎপাদন হয় ৮ হাজার ৯৮ মেট্রিক টন।  

কৃষি বিভাগ আরো জানিয়েছে, এবারের তিন ধাপের বন্যায় জেলার সিংড়া, নলডাঙ্গা ও গুরুদাসপুর উপজেলায় ২৯ হাজার ৯১৩ জন কৃষকের রোপা আমন, সবজি, বোনা আমন ও আউশ ফসলের ক্ষতি হয়েছে। যার আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৬৪ কোটি ৩৩ লাখ ৬৬ হাজার ৬০০ টাকা। বোরো ধানের আগেই কৃষকরা যদি সরিষা আবাদ ভালোয় ভালোয় করতে পারেন, তাহলে অনেকাংশে ক্ষতি কাটিয়ে উঠবেন। সেই লক্ষ্য নিয়ে এবং পরিস্থিতি বিবেচনা করে সরকার কৃষকদের বিনামূল্যে সরিষা বীজ ও রাসায়নিক সার দিয়েছে। সেই লক্ষ্য পূরণ হবে বলে আশা প্রকাশ করছে কৃষিবিভাগ।

নাটোর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, কৃষি পুনর্বাসন কর্মসূচির আওতায় জেলার সাতটি উপজেলায় ১০ হাজার কৃষককে বিনামূল্যে সরিষা বীজ ও সার বিতরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ৮৩০ জন, নলডাঙ্গায় ১ হাজার ৮৭০ জন, সিংড়ায় ৪ হাজার ৬০০ জন, গুরুদাসপুরে ১ হাজার ৮০০ জন, বড়াইগ্রামে ৩৫০ জন, লালপুরে ৩৬০ জন ও বাগাতিপাড়া উপজেলায় ১৯০ জন কৃষক এসব সরষে বীজ ও সার পেয়েছেন।

সূত্র আরও জানায়, প্রতিটি কৃষককে এক কেজি করে সরিষা বীজ, ১০ কেজি করে ডিএপি ও এমওপি সার দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রণোদনা কর্মসূচির আওতায় এক হাজার ৫০০ জন এবং পুনর্বাসন কর্মসূচির আওতায় ১০ হাজার কৃষককে এসব উপকরণ বিনামূল্যে দেওয়া হয়।  

কৃষকরা জানিয়েছেন, বন্যায় ক্ষতি পুষিয়ে নিতে তারা কৃষি বিভাগের পরামর্শে উন্নত জাতের ও স্বল্পমেয়াদী সরিষা বীজ নিয়ে চাষাবাদে নেমেছেন। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে এবং ফসল ভালো হলে তারা অনেকটাই সংকট কাটিয়ে তুলতে পারবেন বলে আশা প্রকাশ করেন। সবচেয়ে বড় প্রাপ্তির বিষয় হচ্ছে আসন্ন বোরো মৌসুমের আগেই এই সরিষা ফসল ঘরে তুলতে পারবেন। পরবর্তীতে সেখানে বোরোর আবাদ করতে পারবেন।

সিংড়া উপজেলার বন্দর এলাকার কৃষক মো. আবু সাঈদ জানান, তিনি এ বছর সাড়ে তিন বিঘা জমিতে সরিষার আবাদ করেছেন। বর্তমানে তার ক্ষেতের ফসলে ফুল এসেছে। খুব শিগগিরই হয়তো ফল এসে যাবে। ফসলের অবস্থা মোটামুটি ভালো। আশা করা যাচ্ছে এবার সরিষার বাম্পার ফলন হবে। এতে এবারের বন্যায় তাদের যে ক্ষতি হয়েছে, তার অনেকাটাই পুষিয়ে নিতে পারবেন। আর সরিষা তুলে সেখানে বোরোর আবাদ করবেন। একই কথা জানালেন আরো অনেক কৃষক।

হালতিবিলের  উঁচু এলাকার কয়েকজন কৃষক জানিয়েছেন, এবারে ফসলের অবস্থা বেশ ভালো। এখনো কোনো প্রকার পোকামাকড়ের আক্রমণ দেখা দেয়নি। সবকিছু ঠিক থাকলে এবার বিঘাপ্রতি ৫ থেকে ৬ মণ হারে ফলন হবে। এমনকি তার চেয়ে বেশি পরিমাণও হতে পারে বলে আশা করছেন তারা।

নলডাঙ্গা উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ ফোজিয়া ফেরদৌস বাংলানিউজকে জানান, এ বছর সরিষা চাষের ব্যাপারে কৃষকদের সচেতন করার পাশাপাশি বীজ ও সার দিয়ে সহযোগিতা করা হচ্ছে। সরিষা চাষ আবাদের পদ্ধতি এবং পোকার আক্রমণ রোধে মাঠ পর্যায়ে উপ-সহকারী কর্মকর্তাদের নিয়োজিত রাখা হয়েছে। তারা সার্বক্ষণিক কৃষকদের পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। যারা আগাম বীজ বপন করেছেন তাদের গাছে হলুদ ফুল এসেছে। ফসলের অবস্থাও বেশ ভালো।  
আর অনেক কৃষক দেরিতে হলেও সরিষা বীজ বপন করছেন।    

সিংড়া উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ মো. সাজ্জাদ হোসেন বাংলানিউজকে জানান, বন্যায় চলনবিল অঞ্চলে রোপা আমনের যে ক্ষতি হয়েছে তাতে সরিষা চাষ আবাদের কারণে তা অনেকাংশেই পূরণ হবে। চলনবিলের বিভিন্ন অঞ্চলে সরিষা ক্ষেতে ফুলে ফুলে ছেয়ে গেছে। আর যে সমস্ত এলাকায় পানি নামতে দেরি হয়েছে সে সমস্ত এলাকায় কৃষকরা এখন সরিষা বীজ বপন করছেন। সরিষা চাষে খরচ কম এবং লাভজনক। সঠিক পরিচর্যা ও অনুকূল পরিবেশ থাকলে সরিষা আবাদে আশা করা যায় বাম্পার ফলন হবে। আসন্ন বোরো মৌসুমের আগেই কৃষকরা সরিষার ফসল ঘরে তুলতে পারবেন।

নাটোর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (ডিডি) কৃষিবিদ সুব্রত কুমার সরকার বাংলানিউজকে জানান, এবারের বন্যা পরিস্থিতির কারণে কৃষকের রোপা-আমন, বোনা আমন ও সবজি ফসলের যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, তা অপূরণীয়। এসব ক্ষতি পুষিয়ে নিতে কৃষকদের আসন্ন বোরো মৌসুমের আগেই স্বল্প সময়ে, স্বল্প খরচে সরিষার চাষ আবাদের পরামর্শ দেওয়া হয়। সেই পরামর্শ মোতাবেক কৃষকরা এবার আগাম ও উন্নত জাতের সরিষার চাষাবাদ করেছেন। এজন্য কৃষকদের বিনামূল্যে সার, বীজ, প্রযুক্তিগত পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া কৃষি উপকরণ পেতে সহজলভ্যতা ও সর্বাধিক সহযোগিতার জন্য কৃষকদের সরিষা চাষে আগ্রহ বেড়েছে।  
আবহাওয়া ও পরিবেশ অনুকূলে থাকলে আশা করা যায় সরিষা আবাদে বাম্পার ফলন হবে। এছাড়া কৃষকরা এবারের বন্যায় যে ক্ষতি হয়েছে, তা অনেকাংশে পুষিয়ে নিতে সক্ষম হবেন। এজন্য কৃষিবিভাগ সার্বক্ষণিকভাবে এ বিষয়ে মনিটরিং করছেন এবং কৃষকদের পাশে আছেন।    

বাংলাদেশ সময়: ০৮৫৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৩, ২০২০
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।