ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

কৃষি

বিএডিসির এক জাতের বীজে নানান জাতের ধান!

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২০০ ঘণ্টা, এপ্রিল ৮, ২০২২
বিএডিসির এক জাতের বীজে নানান জাতের  ধান!

যশোর: যশোর সদর উপজেলার দেয়াড়া ইউনিয়নে বিএডিসির বোরো ধানের বীজে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন শতশত কৃষক। তাদের অভিযোগ, বিএডিসির সরবরাহ করা ব্রি-৬৩ ধানের বীজে গাছ হয়েছে একাধিক জাতের।

সরেজমিনে দেখা গেছে বিভিন্ন ধানের মিশ্রণ থাকায় কোনটার শীষে ধান ধরেছে, আবার কোনটায় এখনও ধানই আসেনি। একই জমিতে ফসলের এমন তারতম্য থাকায় তারা হতাশ হয়ে পড়েছেন। তাতে চাষাবাদের খরচ ও ফসল উৎপাদনে ব্যাপক লোকসানে পড়েছেন।

এমন পরিস্থিতিতে এক জাতের বীজে একাধিক জাত তৈরির কারণ উদ্ঘাটন ও ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন কৃষকরা। তবে বিএডিসির ডিলারের দাবি, বীজে কোনো ভেজাল নেই। কৃষকদের জমির উর্বরতা না থাকায় এমনটি হয়েছে।  

কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেয়াড়া ইউনিয়নের দত্তপাড়া বাজারে বিএডিসির ধানের বীজ বিক্রি করেন কে কে সীডস্ অ্যান্ড অ্যাগ্রো ইনপুটস্ লিমিটিডের স্বত্বাধিকারী কৃষিবিদ কল্লোল কুমার ঘোষ। চলতি মৌসুমে এই ইউনিয়নের প্রায় দেড় শতাধিক কৃষক তার কাছ থেকে ব্রি-৬৩ জাতের বোরো ধানের বীজ কিনে চাষাবাদ শুরু করেন। তারা ক্ষেতে সঠিক মাত্রায় সেচ, সার দেন। অন্য সবার মতো তাদের ক্ষেতও দেখতে বেশ সুন্দর হয়। কিন্তু চারা বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষেতের ফসলে তারতম্য দেখা দেয়। ক্ষেতের কিছু অংশে যখন ধানের থোড় আসছে, অন্য অংশে আসছে না। আবার কোনো জমিতে ধানের শীষ পরিপুক্ত হয়ে গেলেও অন্য পাশে এখনও থোড়ই বের হয়নি।

জমিতে ফসলের এ রকম তারতম্য দেখে তারা ফলন নিয়ে হতাশ হয়ে পড়েছেন। প্রতিবিঘায় ধান চাষে তাদের ১৩-১৫ হাজার খরচ হয়েছে। এসব জমিতে স্বাভাবিক ধান হলে বিঘায় ২২-২৫ মণ উৎপাদন হয়। এখন ফসলের এ রকম তারতম্যের কারণে এসব বিঘায় ১০ থেকে ১৫ মণ ধান উৎপাদন হবে। যাতে তাদের বিঘা প্রতি ১২-১৫ হাজার টাকা ক্ষতি হবে। শেষ সময়ে এসে ক্ষেতে ফসলের এ অবস্থায় সবাই ভেঙে পড়েছেন। ফসল ঘরে তুলতে না পারলে সার-সেচের ঋণ পরিশোধ করবেন কীভাবে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন এসব ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক।

দেয়াড়া ইউনিয়নে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন মঠবাড়ী গ্রামের কৃষকরা। ওই গ্রামের হয়রত আলী নামে এক বৃদ্ধ কৃষক জানান, ফলন বেশি হওয়ার আশায় মাঠের পর মাঠ ব্রি-৬৩ ধান চাষ করেছি আমরা। অথচ জমিতে ভেজাল ধানের গাছ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এতোদিন কিছু বোঝা যায়নি। যখন ধানের থোড় বের হয়েছে, তখনই বুঝতে পেরেছি। দত্তপাড়া বাজারের ডিলার কল্লোল কুমার ঘোষ আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। এখন আমাদের পথা বসা ছাড়া কিছু করার নেই।

একই গ্রামের সুলাইমান হোসেন নামে আরেক ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক বলেন, অনেকে এই ব্রি-৬৩ জাতের পাশাপাশি অন্য জাতেরও ধান চাষ করেছেন। ফলে তারা ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে নিতে পারবেন। কিন্তু আমার তো ৬ বিঘায় এই ভেজাল ব্রি-৬৩ জাতের ধান চাষ করেছি। ফলে সব জমিতেই ভেজাল ধানের শীষ বের হচ্ছে। ফলে এই ৬ বিঘায় আমার ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা ক্ষতি হয়েছে। সেচ-সারের দাম পরিশোধের সঙ্গে সারা বছর খাওয়ার ধান হবে কিনা তা নিয়েও দুশ্চিন্তায় পড়েছি।

লুৎফর রহমান নামে এক কৃষক জানান, কৃষিবিদ কল্লোল কুমার ঘোষের পরামর্শে তার ডিলার থেকে ৪ বিঘা ধান লাগিয়েছি। এখন সব ধানেই ভেজাল। এই ভেজাল ধান বিক্রি করতে পারব না। এতো টাকা খরচ করে, রোদে পুড়ে এই ধান চাষ করে শেষ সময়ে ক্ষেতের ফসলের এ অবস্থায় হতাশ হয়ে পড়েছি।

ইউনুচ আলী নামে আরেক ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক বলেন, ২২শ  টাকা দিয়ে দুই বস্তা ব্রি-৬৩ জাতের ধানের বীজ কিনেছিলাম। এখন জমিতে সেই ধানের চারা লাগিয়ে দেখছি ব্রি-ধান ৬৩ ছাড়াও ব্রি ধান ২৮, মিনিকেট, ব্রি-৫৬ জাতের শীষ বের হচ্ছে। আবার ক্ষেতের কোনো অংশে ধানের শীষই বের হয়নি। একই গ্রামের প্রায় ৮০ জন কৃষকের ৫০ একর জমিতে এই সমস্যা। বিএডিসির বীজ নিয়েও আমাদের এভাবে ঠকতে হচ্ছে। যারা ভেজাল বীজ দিয়ে কৃষকদের সর্বনাশ করলো আর এই ক্ষতির তালিকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি জানিয়েছে কৃষকরা।

এ বিষয়ে কে কে সীডস্ অ্যান্ড অ্যাগ্রো ইনপুটস্ লিমিটিডের স্বত্বাধিকারী কল্লোল কুমার ঘোষ বলেন, ‘আমি বাড়িতে বীজ তৈরি করি না। বিএডিসির ডিলার নিরাঞ্জন ট্রেডার্সের কাছ থেকে বীজ কিনেই কৃষকদের মাঝে বিক্রি করেছি। যদি বীজে ভেজাল থাকে তা হলে বিএডিসির ডিলার বা বিএডিসির কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেন। তবে বিএডিসির ডিলার নিরাঞ্জন ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী নিরাঞ্জন ব্রি-৬৩ জাতের বীজ ভেজাল নয় দাবী করে তিনি বলেন, ওই ইউনিয়নে যেসব কৃষক ব্রি-৬৩ আবাদ করেছেন, তাদের জমি পরিদর্শন ও তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। বীজের সমস্যা না, মূল ঘটনা হলো জমির উর্বরতা। যেখানে ভালো উর্বরতা রয়েছে, সেখানে দ্রুত ধানের শীষ বের হয়েছে। আর যেখানে উর্বরতা নেই, সেখানে এখনো ধানের শীষ বের হয়নি।

এ বিষয়ে যশোর বিএডিসির উপ-পরিচালক খোরশেদ আলমের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজী হয়নি। আর যশোর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক দীপঙ্কর দাস বাংলানিউজকে বলেন, এতে ফলন খুব একটা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। কী কারণে এমনটা হয়েছে, তা খতিয়ে দেখা হবে।

বাংলাদেশ সময়:  ২৩৫৯ ঘণ্টা, মার্চ ০৭, ২০২২
ইউজি/এমএমজেড

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।