ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

কৃষি

চৈত্র মাসে বন্যা, তিস্তাপাড়ে কান্না

খোরশেদ আলম সাগর, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০০০ ঘণ্টা, এপ্রিল ৮, ২০২২
চৈত্র মাসে বন্যা, তিস্তাপাড়ে কান্না

লালমনিরহাট: উজানের ঢেউ আর বৃষ্টিতে ধু ধু বালুচরের তিস্তা নদী হঠাৎ ফুলে ফেঁপে উঠে দু’কুল উপচে বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। চৈত্র মাসের এ আকস্মিক বন্যায় ফসল ডুবে কান্নার রোল পড়েছে তিস্তাপাড়ে।

জানা যায়, ভারতের সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার পর নীলফামারী জেলার কালীগঞ্জ সীমান্ত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে ঐতিহাসিক এ তিস্তা নদী। যা লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর ও গাইবান্ধা জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী বন্দর হয়ে ব্রক্ষপুত্র নদের সঙ্গে মিশে যায়। দৈর্ঘ প্রায় ৩১৫ কিলোমিটার হলেও বাংলাদেশ অংশে রয়েছে প্রায় ১২৫ কিলোমিটার।  

ভারতের গজলডোবায় বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে ভারত সরকার একতরফা তিস্তার পানি নিয়ন্ত্রণ করায় শীতের আগেই বাংলাদেশ অংশে তিস্তা মরুভূমিতে পরিণত হয়। বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত পানি প্রবাহের ফলে বাংলাদেশ অংশে ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি হয়। বন্যায় সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় তিস্তার বাম তীরের জেলা লালমনিরহাট।  

প্রতিবছর শুস্ক মৌসুমে তিস্তার চরাঞ্চলে জেগে ওঠা বালুতে বিভিন্ন ধরনের ফসল চাষ করেন চাষিরা। এ বছরও এর ব্যতয় ঘটেনি। চাষিদের কঠোর পরিশ্রমে তিস্তার বালু চর সবুজ সমারোহে পরিণত হয়। বোরো-আউশ ধান, পাট, ভুট্টা, মিষ্টিকুমড়া, কাউন, রসুন, পেঁয়াজ, মরিচ, আলু, তামাক, বাদামসহ নানা জাতের শাক-সবজিতে ভরে ওঠে তিস্তার চরাঞ্চল। যা বর্ষার আগেই ঘরে তোলার স্বপ্ন বুনেন চাষিরা। কিন্তু চাষিদের সেই স্বপ্ন এবার ডুবেছে চৈত্র মাসের আকস্মিক বন্যায়।

গত ৪ দিন ধরে টানা বৃষ্টি আর উজানের পাহাড়ি ঢলে তিস্তা নদীর পানি প্রবাহ বেড়ে যায়। চৈত্র মাসের ধু ধু বালু চরের তিস্তায় হঠাৎ দেখা দিয়েছে আকস্মিক বন্যা। এতে ডুবে যায় চরাঞ্চলের চাষিদের উৎপাদিত ফসল। পেঁয়াজ, রসুন, কাউন আর বোরো ধান মাত্র ১০-১৫ দিনের মধ্যেই ঘরে তোলা শুরু হতো। উঠতি ফসল অসময়ের বন্যায় ডুবে নষ্ট হওয়ায় কান্নার রোল পড়েছে তিস্তা পাড়ের প্রতিটি কৃষক পরিবারে। খাবার যোগান তো দূরের কথা ঋণের কিস্তি নিয়েও মহাবিপদে পড়েছেন অনেকেই। এ ফসলই সারাবছর চলে তিস্তাপাড়ের মানুষ। বন্যাকালীন সময়ের জন্য সঞ্চিত রাখেন এই শুস্ক মৌসুমের ফসল ও তার মুনাফা।  

তিস্তা নদীর বাম তীরের গোবর্দ্ধন চরাঞ্চলের চাষি মন্টু মিয়া বাংলানিউজকে বলেন, এনজিও আশা থেকে ১৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ৩ দোন (২৭ শতাংশে ১ দোন) জমিতে পেঁয়াজ, তামাক আর কাউন আবাদ করেছি। শিলাবৃষ্টিতে তামাক নষ্ট হয়েছে। এখন আবার হঠাৎ বন্যায় পেঁয়াজ আর কাউন ডুবে পঁচে নষ্ট হয়েছে। এখন পরিবারের খাবার আর কিস্তি কিভাবে হবে? বানের পানি আর চোখের পানিতে একাকার চরাঞ্চলের মানুষ।

একই চরাঞ্চলের চাষি মোক্তার আলী (৮০) বাংলানিউজকে বলেন, ‘পানিটা ছাড়া আগে জানালে উৎতি ফসলগুলো তোলা যাইত। উঁচু অঞ্চলের ধানের চেয়ে চরের ধানে ফলন বেশি। সেই ধান, পেঁয়াজ, কাউন, মিষ্টিকুমড়া পানিতে ডুবি নষ্ট হইচে। বুড়া হইনো বাহে, চৈত মাসে এমন বান (বন্যা) দেখং নাই। বর্ষার বানেও এত ক্ষতি হয় না। এমন কোন আবাদ ছিল না যা চরে এবার চাষ হয় নাই। এলা সউগ পানির নিচত ডুবি আছে বাহে। চরবাসীর ক্ষতি হলেও কৃষি প্রণোদনা বা পুনবাসন চরবাসীর একটি লোকও পায় না। ’ 

কুটিরপাড় গ্রামের চাষি লিয়ন বলেন, কয়েকদিন ধরে রোদ না থাকায় পেঁয়াজগুলো তুলতে পারিনি। এখন চোখের সামনে ডুবে গেলো প্রায় ১০০ মণ পেঁয়াজ। আমার এমন ক্ষতি কখনই হয়নি।  

রসুন চাষি বাবু জানান, পিঁয়াজ, রসুন তুলে ক্ষেতেই শুকানো লাগে। তাই রোদের অভাবে পাকা ক্ষেতের রসুন তুলিনি। এখন সব স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার। প্রায় ৫০ মণ রসুন ডুবে আছে বানের পানিতে। ডুবে ডুবে যেটুকু তুলতেছি, তা তো দ্রুত পঁচে যাবে। পেঁয়াজ আর রসুন পানি পেলে পঁচে যায়। কে জানতো অসময়ে বন্যা হবে? আর আমাদের কপাল পুড়বে?

মহিষখোচা ইউপি সদস্য মতিয়ার রহমান বাংলানিউজকে বলেন, চরাঞ্চলের কোনো জমি এবার ফাঁকা ছিল না। শিলাবৃষ্টিতে তামাক নষ্ট হয়েছে। অসময়ের হঠাৎ বন্যায় বাকিসব ফসল ডুবে নষ্ট হয়েছে। চরাঞ্চলের মানুষ এ মৌসুমের ফসল ও তার মুনাফায় সারাবছর সংসার চালায়। বন্যাসহ আপদকালিন সময়ের জন্য এ ফসল সঞ্চিত করেন চরবাসী। চরাঞ্চলের মানুষের সেই স্বপ্ন এবার অসময়ের বন্যায় ডুবে গেছে।  

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর জানায়, চৈত্র মাসের আকস্মিক বন্যায় জেলার ৫টি উপজেলার তিস্তার তীরবর্তি নিম্নাঞ্চলের ফসল ডুবে গেছে। প্রতি বছরের ন্যায় এ বছর শুস্ক মৌসুমে বোরো ধান, কাউন, পেঁয়াজ, রসুনসহ নানা জাতের শাক সবজিতে ভরে উঠে তিস্তা চরাঞ্চল। আকস্মিক এ বন্যায় তিস্তা চরাঞ্চলের প্রায় ৪০ হেক্টর জমির ফসল ডুবে যায়। যার মধ্যে বোরো ১৮, আউশ ৫, পাট ৭ দশমিক ৭, কাউন ৭, পিঁয়াজ রসুনসহ সবজি ২ হেক্টর। তবে কৃষি বিভাগের মনগড়া এ তথ্য মানতে নারাজ স্থানীয় চাষিরা। তাদের দাবি প্রায় শতাধিক হেক্টর জমির ফসল ডুবে আছে।

লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক শামীম আশরাফ বাংলানিউজকে বলেন, আকস্মিক বন্যায় ডুবে থাকা ফসলের তালিকা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। পানি নেমে গেলে ক্ষয়-ক্ষতির বিবরণসহ পাঠানো হবে। তবে বর্তমান চরাঞ্চলের মাঠে থাকা সকল ফসলই ঘরে তোলার উপযোগী ছিল। পানি নেমে গেলে বোরো আর ভুট্টা কিছুটা রক্ষা পেলেও পেঁয়াজ রসুনসহ সবজি ক্ষেত পুরো ঝুঁকিতে রয়েছে।  

বাংলাদেশ সময়: ১৯৫২ ঘণ্টা, এপ্রিল ৭, ২০২২
এনটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।