ঢাকা, শনিবার, ২০ আশ্বিন ১৪৩১, ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ০১ রবিউস সানি ১৪৪৬

আওয়ামী লীগ

এমপি এনামুলের নিয়োগবাণিজ্যে পুনর্বাসিত জামায়াত-বিএনপি

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১০০ ঘণ্টা, আগস্ট ৩০, ২০১৭
এমপি এনামুলের নিয়োগবাণিজ্যে পুনর্বাসিত জামায়াত-বিএনপি সংসদ সদস্য এনামুল হক

বাগমারা (রাজশাহী) থেকে ফিরে: টাকা-ছাড়া চাকরি হয়েছে এমন নজির কমই রয়েছে। বেশিরভাগ নিয়োগ পেয়েছে জামায়াত-বিএনপির লোকজন। শুধু চাকরি নয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সভাপতি পদে বিএনপি-জামায়াতের লোকদেরই বসানো হয়েছে।

রাজশাহী-৪ (বাগমারা) আসনের এমপি এনামুল হকের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ করেছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। যোগীপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মোস্তফা কামালের মুখেই জানা গেল অনেক কিছু।

বাংলানিউজকে তিনি জানান, এনামুল হক ঠাণ্ডা মাথায় আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করে জামায়াত-বিএনপিকে পুনর্বাসন করেছেন, করছেন। সাড়ে ৮ বছরে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তার মাধ্যমে কারা নিয়োগ পেয়েছেন খোঁজ নিলেই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে। এই লোকটি কতটা অর্থলোভী হতে পারে তা সাধারণের ধারণারও বাইরে।

মোস্তফা কামাল জানান, বীরকুৎসা স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দিলে আওয়ামী লীগ নেতা জুলফিকার আলী আলিমের জন্য তিনি তদ্বির করতে গিয়েছিলেন এমপি এনামুল হকের কাছে। এমপি তখন সরাসরি ২০ লাখ টাকা (ঘুষ)চেয়ে বসেন তার কাছে। এমপি তাদের বলেছিলেন, ‘অনেকে ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত দিতে চাচ্ছে, তুমি যেহেতু এসেছো ৫ লাখ ছাড় দিচ্ছি। ’

শেষে রফা হয় ১৫ লাখ টাকায়। নিয়োগের আগেই তার (মোস্তফা কামাল) উপস্থিতিতে ১৫ লাখ টাকা এমপির এনামুল হকের হাতে তুলে দিয়ে তবেই নিয়োগ পান জুলফিকার আলী আলিম। ওই প্রতিষ্ঠানের সভাপতি এমপির আপন ভাবী শিরিন ইসলাম। তাকে পুতুল হিসেবে বসিয়ে রেখে কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন এনামুল হক। তিনি নিজে অনেক ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বলেও দাবি করেন মোস্তফা কামাল।
 
মোস্তফা কামালের বক্তব্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন জুলফিকার আলী আলিম নিজেও। তিনি বাংলানিউজকে জানান, টাকা তিনি দিয়েছেন কয়েক দফায়। এমপি নিজহাতে রিসিভ করেছেন দু’দফায়। এছাড়া এক দফায় তার মা এবং এক দফায় প্রতিষ্ঠানের সভাপতির (এমপির ভাবী) কাছে ঘুষের টাকা জমা দিয়েছেন।

সবচেয়ে বেশি অনিয়ম হয়েছে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর নৈশপ্রহরী নিয়োগ নিয়ে। টাকা ছাড়া কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি বলে দাবি করেছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা। আর বেশিরভাগ নিয়োগ পেয়েছে জামায়াত-বিএনপির লোক। এমনকি নিয়ম না থাকলেও ক্যাচমেন্ট এলাকার বাইরে থেকে জামায়াত বিএনপির প্রার্থী এনে চাকরি দেওয়া হয়েছে।

বলয়পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নৈশপ্রহরী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে জামায়াতের পক্ষে সদা সক্রিয় জুয়েল মিয়াকে। যার বাড়ি ক্যাচমেন্ট এলাকার বাইরে অবস্থিত ডোখলপাড়া গ্রামে। অথচ ওই স্কুলে চাকরি পাওয়ার জন্য অনেক চেষ্টা তদ্বির করেছিলেন ইউনিয়ন যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সাইফুল ইসলাম সাগর।
সাগর বাংলানিউজকে জানান, তাকে চাকরি দেওয়ার জন্য প্রথমে আড়াই লাখ টাকায় কন্টাক্ট হয়। সে অনুযায়ী তিনি ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা অগ্রিম দেন। কিন্তু হঠাৎ করে নিয়োগের আগে হাজির হন জামায়াতের লোক জুয়েল।

তখন হঠাৎ করেই ভোল পাল্টে ফেলেন এমপি এনামুল। তাকে বলা হয়, আড়াই লাখ টাকায় চাকরি দেওয়া সম্ভব নয়। অনেকে পাঁচ লাখ টাকা দিতে চাচ্ছে। ৫ লাখ টাকা দিতে পারলেই কেবল চাকরি দেওয়া সম্ভব—একথা তাকে সাফ জানিয়ে দেন এমপির চাচাতো ভাই আফসের।

অনেক ধরাধরি করেছেন। কোনো লাভ হয়নি। নিয়োগ পেয়েছেন জামায়াতের লেঅক বলে পরিচিত ডোখলপাড়া গ্রামের আব্দুল জব্বারের পুত্র জুয়েল। কিন্তু তার টাকাটা আর ঠিকমতো ফেরত দেয়া হয়নি বলে দাবি করেন সাগর।

ভাগনদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নৈশপ্রহরী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বিএনপির সক্রিয় এক কর্মীকে। অথচ এই নিয়োগের জন্য আরও তিনজন প্রার্থী ছিলেন। যাদের মধ্যে আওয়ামী লীগ কর্মী আব্দুর রাজ্জাক সাড়ে তিন লাখ টাকা দিতে চাইলেও তার নিয়োগ হয়নি।

কাতিলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বিএনপি নেতা মজিবর রহমানের ছেলে মিল্টনকে। এলাকায় চাউড় আছে, তার কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নিয়েই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। জানা যায়, এখানে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছেন এমপির প্রেস সেক্রেটারি জিল্লুর রহমান। এই জিল্লুর রহমান নিজেও এক সময় বিএনপির সক্রিয় কর্মী ছিলেন।

সবচেয়ে নজিরবিহীন ঘটনাটি ঘটেছে নখোপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নিয়োগে। এখানে নিয়োগ পরীক্ষায় চূড়ান্ত হন ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মজিদ। স্কুলটিতে বিএনপির প্রার্থী আব্দুল ওয়াহেদকে নিয়োগ না দেওয়ায় ক্ষেপে যান এমপি। আর প্রধান শিক্ষককে যোগদান না করানোর জন্য চাপ প্রয়োগ করেন। যে কারণে ঝুলে যায় যোগদান। পরে বিএনপির কর্মী আব্দুল ওয়াহেদকে দিয়ে মামলা ঠুকে দিয়ে আটকে দেন নিয়োগ।

আওয়ামী লীগের এই কর্মীর নিয়োগ ঝুলে যাওয়ায় চটেছেন আওয়ামী লীগের লোকজন। তারাও পাল্টা মামলা ঠুকে দিয়েছেন বলে জানান ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নেতা মোস্তফা কামাল।

বেশিরভাগ স্কুলে জামায়াত-বিএনপির সক্রিয় সদস্যদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয় আওয়ামী লীগের কাছে হাইব্রিড ও বিতর্কিত হিসেবে পরিচিত এনামুল হকের কারণে জামায়াত-বিএনপি পুর্নবাসিত হচ্ছে বাগমারায়। তার কারণে রাজশাহীর বাগমারা উপজেলায় আওয়ামী লীগের অবস্থা শোচনীয় বলে দাবি করেছেন তাহেরপুর পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল কালাম আজাদ।

শুধু অর্থ কেলেঙ্কারী নয়, তার বিরুদ্ধে নারী কেলেঙ্কারিরও নানা অভিযোগ রয়েছে। এসব বিষয়ে কথা বলার জন্য অনেকবার ফোনকল দিলেও এমপি এনামুল হক তা রিসিভ করেন নি।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৫৮ ঘণ্টা, আগস্ট ৩০, ২০১৭
এসআই/জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।