ঢাকা: অনুগল্প, কবিতা, স্মৃতিকথন আর ভ্রমণকাহিনি নিয়ে প্রকাশিত সাহিত্যের ছোটকাগজ ‘লিটলম্যাগ’। মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর বাংলাদেশে প্রচলিত ও গতানুগতিক ধারার বাইরে এসে সাহিত্যে যে নতুন ধারা তৈরির প্রয়াস নেওয়া হয়, তার ধারাবাহিকতায় শুরু হয় লিটলম্যাগ।
কালান্তরে সৃজনশীল গোষ্ঠীর সেই মুখপত্রগুলোতে ছোটকাগজ বলতে শুরু করে থাকে সমাজ বাস্তবতার কথা। সাহিত্যের সেই ছোটকাগজ পাঠক মনে জুগিয়েছিল নতুন খোরাক।
লিটলম্যাগ সম্পাদকরা বলছেন, সাহিত্যচর্চার বর্তমান প্রেক্ষাপটে লিটলম্যাগ ধুঁকতে থাকলেও এক শ্রেণির পাঠকের কাছে তার আবেদন ফুরোয়নি এখনো। কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণ লেখকদের অনেকে সাহিত্যচর্চার প্ল্যাটফর্ম হিসেবে লিটলম্যাগকে বেছে নেন। তারুণ্যের সাহিত্যচর্চায় সমসাময়িক চিন্তার প্রকাশ যেমন ঘটছে, তেমনি নতুন রচনাশৈলীর নানা দিক উন্মোচিত হচ্ছে।
ত্রৈমাসিক ম্যাগাজিন ‘নান্দিক’ প্রকাশক সুদীপ্ত মাহমুদ বলেন, লিটলম্যাগে যারা লিখছেন, তাদের লেখনীর সাহিত্যমান নিয়ে খুব কম জানাশোনা আছে পাঠকের। হয়তো তারা বড় প্রকাশনী থেকে বই প্রকাশের সুযোগ পান না। কিন্তু তারা গল্প, কবিতায় সমাজ ও দেশের নানা বাস্তব ঘটনা যেভাবে চিত্রায়িত করছেন, তার সাহিত্যমান সত্যি অসাধারণ।
‘শব্দকথন’ নামে একটি লিটলম্যাগে নিয়মিত লিখছেন ইয়াসমিন সুলতানা। তিনি বলেন, ‘লিটলম্যাগের আবেদন কিন্তু একশ্রেণির পাঠকের কাছে সব সময়ই থাকবে। নবীন লেখক তার চিন্তাচেতনার স্ফুরণের মাধ্যমে একজন পাঠককে তার রচনার চরিত্রের মাধ্যমে কীভাবে চিত্রায়িত করেন, তা জানা যায় লিটলম্যাগে। ’
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাহিত্যের ছোটকাগজ ‘তিতাসনামার’ স্টলে দেখা মিলল হাতে লেখা লিটলম্যাগের। এর উদ্যোক্তা তারিক সজীব জানান, ১৯৯৮ সাল থেকে শুরু করা এই সাহিত্য পত্রিকাটি ২০১৭ সাল পর্যন্ত হাতে লিখে প্রকাশিত হতো। আঞ্চলিক ওই সাহিত্য পত্রিকায় লোকজ জীবন, সংস্কৃতির কথা উঠে আসত। পরবর্তী সময় ছাপা হরফে পত্রিকা প্রকাশিত হতে থাকলেও এখন অর্থসংকটে ভুগছে। তাই নিয়মিত প্রকাশিতও হয় না পত্রিকাটি।
লিটলম্যাগের যাত্রার শুরুতে প্রকাশকরা বিজ্ঞাপন নিতে নারাজ থাকলেও এখন সেই চিত্র পাল্টেছে। অর্থাভাবে প্রকাশনাই যখন বন্ধ হয়ে যায়, তখন বাধ্য হয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দ্বারস্থ হতে হয় তাদের। ‘অনস্বর’ সম্পাদক বহ্নি কুসুম বলেন, ‘আমাকে এখন বাধ্য হয়ে বিজ্ঞাপন নিতে হচ্ছে। না হলে আমি টিকে থাকব কী করে? আমার মতো আরও অনেক লিটলম্যাগ সম্পাদক বাধ্য হয়ে বিজ্ঞাপন নিচ্ছেন। না হলে যে লিটলম্যাগ আর প্রকাশ করা যাবে না। ’
লিটলম্যাগের সংকট নিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা নতুন লেখক তৈরি করতে পারছি না। ভালোমানের লেখা লিখতে গেলে তো পড়তে হবে। এখন যারা লিখছেন, তাদের অনেকেই ভালোমানের সাহিত্যপাঠ করছেন না। ’
মননশীল ধারা থেকে বের হয়ে এসে অনেকে বেশ কয়েক বছর ধরে বিষয়ভিত্তিক লিটলম্যাগ প্রকাশ করছেন। এগুলোর মধ্যে নাটকের কাগজ ‘ক্ষ্যাপা’, ‘গ্রাম থিয়েটার’; ভ্রমণবিষয়ক ‘ভ্রমণগদ্য’, গারো নৃগোষ্ঠীর সংস্কৃতি নিয়ে ‘থকবিরিম’ প্রকাশিত হচ্ছে।
‘দ্রষ্টব্য’ ও ‘সরলরেখা’ নামে দুটি লিটলম্যাগের শিল্প সম্পাদক চারু পিন্টু বলেন, ‘এখন অনেক সাইনবোর্ড সর্বস্ব সংগঠন লিটলম্যাগ বের করছে। ছোট কাগজের নানা সীমাবদ্ধতা থাকবেই। গাঁটের পয়সা খরচ করে সাহিত্য সম্পাদকরা যে প্রকাশনাগুলো বের করছেন, তার মূল সীমাবদ্ধতা লেখনীতে। ’
বাংলাদেশ লেখক পরিষদের সভাপতি ও ‘পঙ্ক্তি’ সম্পাদক সৈয়দ মাজহারুল পারভেজ বলেন, ‘বাইরের অন্যান্য দেশের বইমেলায় লিটলম্যাগ চত্বর যে গুরুত্ব পায় এখানে তেমন পায় না। এটা বাংলা একাডেমির একরকম ব্যর্থতা। বাংলা একাডেমির বর্তমান মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার কাছে আমাদের প্রত্যাশা ছিল অনেক। কিন্তু আমরা হতাশ হয়েছি। ’
লিটলম্যাগের সাহিত্যমান ক্রমশ কমছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘লিটলম্যাগে যারা ভালো মানের লেখা লিখছেন, তাদের লেখা নিয়মিত পাওয়া যায় না। ’
বাংলাদেশ সময়: ২১২৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৪
এইচএমএস/এমজেএফ