ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

বইমেলা

বিনিয়োগ নিয়ে শঙ্কায় প্রকাশকরা

মেহেদী হাসান পিয়াস, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮১০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৩, ২০১৪
বিনিয়োগ নিয়ে শঙ্কায় প্রকাশকরা ছবি: (ফাইল ফটো: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম)

ঢাকা: একুশে বইমেলা শুরু হতে বাকি আর মাত্র দুই সপ্তাহ। বরাবরের মতো এবারও মহান ভাষা আন্দোলনের মাস ফেব্রুয়ারির প্রথম দিন থেকেই শুরু হচ্ছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা-২০১৪।



বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য অঙ্গনের সবচেয়ে বড় উৎসব একুশের বইমেলা। দেশের সাহিত্যপ্রেমী পাঠক, লেখক, প্রকাশক ও বাংলা একাডেমির যৌথ প্রচেষ্টায় বইমেলার পরিচিতি আজ সারা বিশ্বে। এবারের বইমেলাকে সামনে রেখে চলছে পুরোদমে প্রস্তুতি। দেশবাসীর কাছে মিলনমেলা নামে পরিচিত বইমেলার জন্য এখন শুধুই অপেক্ষা।

সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতার মাঝেও নতুন সব প্রকাশনার অর্ধেকের বেশি কাজ সম্পন্ন করে ফেলেছে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের ৮০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে বলেও দাবি করছে প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তৃপক্ষ।

তবে দেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে এবার প্রকাশনা শিল্পে অপেক্ষাকৃত কম বিনিয়োগ করেছেন বলে জানিয়েছেন বেশিরভাগ প্রকাশক। দু’একজন বড় প্রকাশক বাদে মাঝারি বা অপেক্ষাকৃত নতুন প্রকাশকরা বিনিয়োগে স্বস্তি পাচ্ছেন না।

তাদের অনেকেই জানিয়েছেন, গত বছর বইমেলা শুরু হওয়ার পরপরই শাহবাগে শুরু হয় গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন। সেসময় লেখক, পাঠকসহ আপামর মানুষের মনোযোগ ছিল আন্দোলনকে ঘিরে। তাই বইমেলা বরাবরের মতো জমে ওঠার সুযোগ পায়নি। ফলে গত বইমেলায় দু’একজন প্রকাশক ছাড়া অধিকাংশ প্রকাশককেই লোকসান গুণতে হয়েছে।

তাদের অনেকেই জানান, সে লোকসান এখনো তারা বহন করে চলেছেন। আশঙ্কায় রয়েছন এবারের বিনিয়োগ নিয়েও।   তাছাড়া চলমান সহিংসতায় নিরাপত্তা নিয়েও উদ্বিগ্ন তারা।

প্রকাশকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, চলমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সবকিছুতেই অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। সে অনিশ্চয়তা থেকে দূরে নয় প্রকাশকরা। তাই অনেক প্রকাশকই মেলার প্রথম ১০দিন পর্যবেক্ষণের পর দ্বিতীয় দফায় বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক বলে মনে হলে সর্বোচ্চ বিনিয়োগেও পিছপা হবেন না তারা।

এজন্য তারা দেশের সকল রাজনৈতিক দলগুলোকে ফেব্রুয়ারি মাসে সকল ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচি শিথিল রাখারও আহ্বান জানিয়েছেন।

দেশের স্বনামধন্য প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘অন্য প্রকাশ’র প্রধান নির্বাহী মাযহারুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, কিছুটা চিন্তা-ভাবনা করেই এবার বিনিয়োগ করতে হচ্ছে। তবে আমরা আশাবাদী বরাবরের মতো এবারো বইমেলাকে সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচির আওতার বাইরে রাখা হবে।

প্রস্তুতির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, এবার অন্য প্রকাশ থেকে ৪০টি নতুন বই মেলায় আসবে। গত সাত-আটমাস আগে থেকেই মেলার প্রস্তুতি নিয়েছেন। এখন তা শেষ পর্যায়ে রয়েছে।

মেলার পরিসর বাড়ানো জরুরি হয়ে পড়েছে দাবি করে এই প্রকাশক বলেন, নতুন ভবন হওয়ায় বাংলা একাডেমির ভেতরের জায়গা কমে এসেছে। এবার একাডেমির বিক্রয় কেন্দ্রের জায়গায় আরেকটি ভবন উঠছে। এর ফলে জায়গা আরো কমে আসবে।

সেক্ষেত্রে বাংলা একাডেমির সামনের রাস্তাটিতে মেলার পরিসর বাড়ানো যায় কিনা চিন্তা করতে হবে। দোয়েল চত্বর থেকে পরমাণু শক্তি কমিশন অথবা টিএসসি পর্যন্ত মেলাকে সম্প্রসারণ করা যায়। এছাড়া বিকল্প জায়গা হিসেবে সোহরাওয়ার্দীতে মেলা স্থানান্তর করা যায়। গত বছর মেলা উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে সেরকম একটি আভাস দিয়েছিলেন।  

ফোনে যোগাযোগ করলে প্রকাশকদের সংগঠন বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এবং অনুপম প্রকাশনীর সত্ত্বাধিকারী মিলন কান্তি নাথ বাংলানিউজকে বলেন, মেলা সম্প্রসারণের বিষয়ে বাংলা একাডেমি চিন্তা করছে। এ নিয়ে প্রকাশকদের সাথে কয়েকদফা বৈঠক করেছে বাংলা একাডেমি।

তিনি জানান, মেলা সম্প্রসারণের বিষয়ে এমন সিদ্ধান্ত আসতে পারে যে, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাসহ সরকারি-বেসরকারি, সামাজিক-সাংস্কৃতিক, সেবামূলক প্রতিষ্ঠান এবং সংবাদ মাধ্যমের জন্য বরাদ্দকৃত স্টল থাকবে একাডেমি প্রাঙ্গণে। আর দোয়েল চত্বর থেকে টিএসসি পর্যন্ত রাস্তায় থাকবে শুধুমাত্র প্রকাশনীর স্টল।

তিনি বলেন, মেলা যে আকারেই হোক নিরাপত্তার বিষয়টি বিশেষভাবে বিবেচনা করতে হবে। গত বছর ২৫ ফেব্রুয়ারি রাতে আগুন লেগে বেশ কয়েকটি স্টল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। জানি না এটা নাশকতা না দুর্ঘটনা? তবে এবার মেলার নীতিমালায় স্টল বরাদ্দ পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রত্যেক প্রকাশনীর জন্য ‘ফায়ার ইনস্যুরেন্স’ থাকা বাধ্যতামূলক করেছে বাংলা একাডেমি। তাছাড়া কোনো ধরনের নাশকতা যেন না ঘটে সে ব্যাপারে বাংলা একাডেমি সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেবে বলেই আশা করি। তিনি মেলাকে নির্বিঘ্ন করার জন্য সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আহ্বান জানান।

সৃজনশীল তরুণ ও নতুন লেখকদের প্রকাশনী হিসেবে খ্যাত ‘পাঠসূত্র’র নির্বাহী তনুজা আকবর বাংলানিউজকে জানিয়েছেন, ফায়ার ইন্স্যুরেন্স বাধ্যতামূলক করলেও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে এবার মেলার নিরাপত্তা জোরদাড় করা প্রয়োজন।

তিনি বলেন, নাশকতা ঘটাতে একটি পেট্রোলবোমাই যথেষ্ট। তাই মেলাকে কেন্দ্র করে চারপাশের নিরাপত্তা বাড়াতে হবে।  

মেলার আঙ্গিক, পরিসর, প্রস্তুতি নিয়ে জানতে চাইলে প্রকাশনী ‘শ্রাবণ’র সত্ত্বাধিকারী রবীন আহসান ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, আমাদের বইমেলা বারোয়ারি মেলায় পরিণত হয়েছে। গত বছরের মেলাকে পাঠক এবং প্রকাশকদের মেলা হিসেবে ঘোষণা দিলেও আমরা দেখেছি শেষ পর্যন্ত তা রক্ষা করা যায়নি।

তিনি বলেন, বাণিজ্যমেলায় বিশাল জায়গাজুড়ে প্যাভিলিয়ন বানানো হয়। অথচ বইমেলায় এক ইউনিটের একটি স্টলের জায়গা সংকীর্ণ হতে হতে এমন হয়েছে, ঠিকমতো দাঁড়ানোর জায়গা থাকে না। দুই-তিন ইউনিটের স্টল নিলেও সব বই প্রদর্শন করা যায় না। কিন্তু নতুন প্রকাশিত সবক’টি বইয়ের কভার আমি পাঠকদের সামনে প্রদর্শন করতে চাই।

এই প্রকাশকও বইমেলার জায়গা সম্প্রসারণ জরুরি বলে মনে করেন।    

প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘বাঙলায়ন’র অস্ট্রিক আরজু জানান, এবারের মেলায় এখন পর্যন্ত মোট বিনিয়োগের ৫০ শতাংশ বিনিয়োগ করেছেন। মেলা শুরুর প্রথম ১০দিন পর পরিস্থিতি ভালো বোধ করলে পরবর্তী বিনিয়োগের কথা চিন্তা করবেন।

তিনি বলেন, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় সব কিছুতেই মন্দাভাব তৈরি হয়েছে। এর ফলে প্রকাশনার খরচও বেড়েছে। কিন্তু বইয়ের মূল্য নির্ধারণ করতে হয় একটি নির্দিষ্ট শ্রেণিকে ধরে নিয়ে। এদিক থেকেও একটি সঙ্কট প্রকাশকদের আছে। কিন্তু আমরাতো লস দিয়ে বইয়ের দাম নির্ধারণ করতে পারব না। তবে আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকে বইয়ের দাম পাঠকদের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রাখার জন্য।

সম্প্রসারণ, নীতিমালাসহ মেলার প্রস্তুতি বিষয়ে জানতে চেয়ে যোগাযোগ করা হলে বাংলা একাডেমির জনসংযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ বিভাগের  উপপরিচালক মুর্শিদউদ্দিন আহম্মদ বাংলানিউজকে জানান, বাংলা একাডেমি সংলগ্ন স্থানে মেলা সম্প্রসারণের বিষয়ে প্রকাশকদের বিভিন্ন ফোরামের সাথে আলোচনা চলছে, এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে দু’এক দিনের মধ্যে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে বলেও জানান এ কর্মকর্তা।

মেলা সম্প্রসারণে বিশেষ কোনো স্থানকে বিবেচনা করা হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, মেলা স্থানান্তর এবং সম্প্রসারণ দুটি বিষয়েই আলোচনা চলছে। একাডেমি মেলা সম্প্রসারণের পক্ষে। সেক্ষেত্রে একাডেমির সামনের রাস্তাটিতে মেলা আরো সম্প্রসারণ করা যেতে পারে।

বাংলা একাডেমি সূত্রে জানা যায়, ১৯৮৪ সালে গ্রন্থমেলার জন্য বিধিবদ্ধ নীতিমালা প্রণীত হয়। এ বছরই গ্রন্থমেলার নাম হয় ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’। সেই থেকে অমর একুশে গ্রন্থমেলা প্রতি বছর প্রায় একই আঙ্গিকে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।

আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে মেলায় অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সংখ্যা বাড়তে থাকে। ১৯৮০ সালের গ্রন্থমেলায় সে সংখ্যা বেড়ে হয় ৩০। মাত্র পাঁচ বছর পর ১৯৮৫ সালে সে সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৮২ তে। ১৯৯১ সালে এ সংখ্যাটি ১৯০-তে উন্নীত হয়। এর মাত্র এক বছরের ব্যবধানে ১৯৯২ সালে অনুষ্ঠিত অমর একুশে গ্রন্থমেলায় অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২৭০-এ।

সত্তর দশকের শেষ দিকে মেলার ব্যাপক আয়োজন শুরু হলেও এ আয়োজন পূর্ণতা পায় আশির দশকের মাঝামাঝি এসে। নব্বইয়ের শুরুতে মেলা অভাবনীয় ব্যাপ্তি লাভ করে।

তবে বিগত চার বছরে মেলায় বই বিক্রির পরিমাণ অভাবনীয় বৃদ্ধি পেয়েছে। বইমেলায় ২৫ ভাগ কমিশনে বই বিক্রি করা হয়। বাংলা একাডেমী যথারীতি ৩০ ভাগ কমিশনে বই বিক্রি করে থাকে।

বাংলা একাডেমি সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সালে মেলা উপলক্ষে প্রকাশিত হয় ২ হাজার ৭৪১টি নতুন বই এবং বিক্রির পরিমাণ ছিল প্রায় ২১ কোটি টাকা। ২০১০ সালে মেলায় প্রকাশিত নতুন বইয়ের সংখ্যা ২ হাজার ৮৭৯টি।

বাংলা একাডেমির তথ্যমতে, ২০১১ সালে ৩ হাজারেরও বেশি নতুন বই মেলায় প্রকাশিত হয়। বরাদ্দকৃত স্টলের সংখা ছিল ৫৬০টি। নতুন-পুরনো মিলিয়ে মেলায় ২৫ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়। ২০১২ সালে মেলায় প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৬৬৯টি। বরাদ্দকৃত স্টল ৪২৫টি এবং বই বিক্রির পরিমাণ ছিল ২৬ কোটি টাকা।

বাংলা একাডেমি জানায়, ২০১৩ সালে মেলায় ২৬২টি প্রতিষ্ঠানকে ৪৬০টি স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়। গত চার বছরের তুলনায় বিগত বছরে বই বিক্রি হয়েছে অনেক কম। সেটা রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণেই। গত বছর বই বিক্রির পরিমাণ ছিল ১০ কোটি ১৫ লাখ টাকা।

এই হিসাবের আওতায় বর্তমানে বাংলাদেশে সারা বছর প্রকাশিত বইয়ের তিন-চতুর্থাংশই প্রকাশিত হয় মেলাকে কেন্দ্র করে। বইমেলা এবং বইয়ের বাজারের ক্রমবর্ধমানতায় বর্তমানে বাংলাদেশে সৃজনশীল পুস্তক প্রকাশকের সংখ্যা প্রায় তিন শতাধিক।

বাংলাদেশ সময়: ১৭৫১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৩, ২০১৪
সম্পাদনা: এম জে ফেরদৌস, নিউজরুম এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।