ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

বইমেলা

প্রবাসী-অর্থনীতি ও আলোকিত মানুষের গল্প

‘আমাদের দুবাইওয়ালা’

চট্টগ্রাম প্রতিদিন ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৫২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৪, ২০১৫
‘আমাদের দুবাইওয়ালা’

একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাঙালি জাতির মুক্তির সংগ্রাম। সেই মুক্তি ছিল অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক ও সমাজিক মুক্তি অর্থাৎ সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম।

সদ্য স্বাধীন দেশে মুক্তির সেই সংগ্রামে শামিল হয়েছিল দেশ, কিন্তু মুক্তি-বিরোধী দেশি-বিদেশি শক্তিও বসে ছিল না। ফলশ্রুতিতে স্বাধীনতার সাড়ে তিন বছরেই মর্মন্তুদ রাজনৈতিক পটপরিবর্তন দেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যত অনেকটাই নষ্ট করে দিয়েছিল। অথচ স্বাধীনতার পরপরই বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের স্বর্ণদুয়ার খুলে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল, আর সেটা হলো বিদেশে বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে সরকারিভাবে অদক্ষ জনশক্তি রফতানির অপার সম্ভাবনা। খোদ তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই বিষয়টি নিয়ে বেশ ভাবনা-চিন্তা করছিলেন। সাপ্তাহিক হলিডে পত্রিকায় লন্ডন প্রবাসী এফআর খানের ‘ ‘দ্য আনসাং হিরো’ শীর্ষক এক প্রবন্ধে উল্লেখিত জনশক্তি রফতানি বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য- ‘আমাদের তো রফতানির কিছুই নেই, পাট ছিল তাও শেষ। আমার বিশ্বাস জনশক্তি রফতানি হতে পারে দেশের অর্থনীতির ভয়াবহ দুর্যোগ অবসানের রক্ষাকবচ। আমাাদের কাক্সিক্ষত সোনার বাংলা গড়ার এক মোক্ষম পথ। ’ কিন্তু সময় বড় নিষ্ঠুর, ’৭৫ এর ১৫ আগস্টের মনুষ্য তৈরি আরেক কারবালার নৃশংতায় তিনি পরপারে চলে যাওয়ায় জনশক্তি রফতানির বিষয়টি চূড়ান্ত করে যেতে পারেননি। কিন্তু তিনি যে স্বপ্নের বীজ বুনেছিলেন সেটা অংকুরিত হয়েছে অচিরেই, ৭৬ সালেই বাংলাদেশ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে জনশক্তি রফতানি শুরু হয়। হালের বলদ বিক্রি করে, বৌয়ের গহনা কিংবা বাপদাদার ভিটা বিক্রি করে মানুষ পাড়ি জমাতে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্যেও দেশগুলোতে। গত ৩৬ বছরে জনশক্তি রফতানি বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য সোনার খনি হয়ে উঠেছে। বর্তমানে প্রায় এক কোটি বাংলাদেশি বিদেশে অবস্থান করছেন, তাদের রেমিটেন্সে প্রতিনিয়ত স্ফীত হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ। আর তাতে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রধান লক্ষ্য ‘মুক্তির সংগ্রাম’ এ সম্পৃক্ত হয়েছেন প্রবাসীরা। তাদের বৈদেশিক মুদ্রা বাংলার মানুষের জন্য ‘অর্থনৈতিক মুক্তি’র পথ দেখাচ্ছে।   

৭০ এর দশকেই জনশক্তি রফতানির এই ধারায় যুক্ত হয় চট্টগ্রামও। ’৭০ ও ’৮০ এর দশকে চট্টগ্রাম থেকে কাতারে কাতারে অদক্ষ শ্রমিক পাড়ি জমাতে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে। বিশেষ করে সৌদি আরব, দুবাই, কাতারের মতো দেশগুলোতে চাঁটগাইয়া নওজোয়ানরা কিন্তু জামাই আদরে টাকা বানাতে পারেননি, অচেনা জীবনযুদ্ধে লড়ে তাদের প্রায় সবাই সফল হয়েছেন, ২০ হাজার টাকা খরচ করে যারা একদিন দুবাই গিয়েছিলেন তাঁদের কেউ কেউ আজ শত শত কোটি টাকার মালিক। প্রবাসী চাটগাঁইয়ারা শুধু টাকা কামানোতেই বসে নেই তারা দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখছেন, দেশের ইতিবাচক পরিবর্তনে অসামান্য অবদান রাখছেন। আমাদের চট্টগ্রামে তো দুবাইওয়ালা জামাইয়ের কদরই আলাদা। তাদের নিয়ে রচিত হয়েছে গান নাটক। শিল্পী সনজিত আশ্চার্য্য রচিত ও শেফালী ঘোষের গাওয়া সেই বিখ্যাত গানটির কথা মনে পড়ে,
ন লইয়ম ন লইয়ম
দুবাইওয়ালা জামাই আঁই
বিয়া গরি দুদিন পরে
যাইব গৈ ফেলাই
আঁর কী অইব উপায়॥

গানে দুবাইওয়ালা জামাই নিয়ে নারীর যতই আহাজারি থাক, অভিভাবকের কাছে এই জামাইয়ের কদর রাজপুত্তুরের মতো, কারণ এই জামাইয়ের কাছে মেয়ে দিলে আছে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির নিশ্চয়তা, সুখের হাতছানি।

প্রসঙ্গত, ১৯৭৬ সাল থেকে ২০১৪ পর্যন্ত চট্টগ্রাম থেকে ৯ লাখ ৩৩ হাজার ২৯৮ জন শ্রমিক বিদেশে গেছেন। তাদের এক বড় অংশই গেছেন মদ্যপ্রাচ্যের দেশে। লেবারসহ ১৩৮টি ভিসায় তারা সেখানে অর্থ উপার্জন করছেন।

মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসীদের নিয়ে এত কথা বলার মূল কারণ হলো তাদের নিয়ে আমরা গল্প করি, গর্ব করি কিন্তু আমাদের অর্থনীতির প্রাণ এসব মানুষগুলোর জীবন-যুদ্ধ, স্বপ্ন ও স্বপ্ন-ভঙ্গের ইতিহাস নিয়ে এতদিন রচিত হয়নি কোনো গ্রন্থ। কিন্তু সাংবাদিক এস এম রানা  সেই আরাধ্য কাজটি সম্পন্ন করেছেন, ‘আমাদের দুবাইওয়ালা’ শিরোনামে রচিত গ্রন্থটি চট্টগ্রামের দুবাইওয়ালা শুধু নয়, মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসীদের জীবনের গহীন চালচিত্র হয়ে উঠেছে। পাশাপাশি বইটিতে বাংলাদেশের জনশক্তি রফতানির ইতিহাস, প্রবাসীদের আয়ের খতিয়ান ও অর্থনীতিতে তার ইতিবাচক প্রভাব নিয়ে বিস্তারিত আলোকপাত করেছেন লেখক। এস এম রানা মূলত একজন সাংবাদিক, তবে তিনি সাংবাদিকের কলম দিয়ে শুধু তাদের সাফল্য বা দুঃখের কাহিনী লিখেই বসে থাকনেনি, তিনি অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে চট্টগ্রামের মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসীদের অবদান আলোচনা করেছেন, সমাজ-সংস্কৃতিতে এর প্রভাব এমনকি নৃতাত্ত্বিক পঠনপাঠনের খোরাকও আছে এই বইয়ে। দুবাইওয়ালাদের নিয়ে যে চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় আলাদা পাড়া গড়ে উঠেছে সে কথাও তিনি লিখেছেন সংবাদ লেখার মুন্সিয়ানায়।

‘আমাদের দুবাইওয়ালা’ গ্রন্থের শুরুটা হয়েছে সমৃদ্ধ দুটো প্রবন্ধ দিয়ে-
১. চট্টগ্রামে শ্রমের ফেরিওয়ালাদের ইতিবৃত্ত।
২. আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিবাচক প্রভাব

এরপরে লেখক ‘মহানায়কেরা’ শিরোনামে দুবাইপ্রবাসী সফল মানুষগুলোর জীবনচিত্র গ্রন্থিত করেছেন । দুবাইওয়ালাদের ‘সাফল্য’, ও ‘দুর্ভোগ’ এর কথাও তুলে ধরেছেন লেখক। শেষে আছে কিছু প্রতিবেদন যেখানে দুবাইওয়ালাদের অর্থ-শ্রম এবং প্রাপ্তি ও বঞ্চনার বিচিত্র কথা আলোচিত হয়েছে।

প্রবন্ধে লেখকের দেওয়া তথ্যে দেখা যায়, ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের বাজেট ছিল ৭৮৬ কোটি টাকার, যেটা ২০১৩-১৪ অর্থবছরে হয়েছে ২ লাখ ২২ হাজার ৪৯১ কোটি টাকা। ১৯৭৬ সাল থেকে পরবর্তী ৩৬ বছরে বাংলাদেশে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের পরিমাণ ৫৫ লাখ ৮৮ হাজার ৪৭ দশমিক ৬৩ কোটি টাকা। শুধু ২০১২ সালে প্রবাসীরা রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন এক হাজার ৪০০ কোটি ডলার। বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণ হলো এই রেমিটেন্স।

আসলে এস এম রানার বইটি পড়তে পড়তে হারিয়ে যেতে হয় এক স্বপ্নরাজ্যে। বাঙালিরা যে চেষ্টা করলে সব পারে তার বড় প্রমাণ রানার ‘আমাদের দুবাইওয়ালা’ বইয়ের নায়করা। ১৯৭৫ সালে এক কানি জমি আর ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে ভিসা নিয়ে দুবাই গিয়েছিলেন হাটহাজারীর নুরুল আলম। তিনি এখন শত কোটি টাকার মালিক। কেউ কেউ শুধু টাকা কামিয়ে নিজের আরাম আয়েশেই ব্যস্ত নন, তারা চিন্তা করেন দেশ নিয়ে জন্মভূমি চট্টগ্রাম নিয়ে। তাদেরই একজন হলেন মোহাম্মদ আকতার হোসেন, যিনি কর্ণফুলী সেতু নির্মাণে ঋণ দিতে চেয়েছিলেন। ভাবুন, আমরা যদি প্রবাসীদের আন্তরিকতার মূল্য দিতে জানতাম তা হলে তাদের টাকায় অনেক বড় অবকাঠামো তৈরি সম্ভব হতো, তার প্রমাণ রানার এই বই। মোহাম্মদ আবুল হাশেম, যার ২০০ দিরহাম দিয়ে প্রবাস জীবন শুরু, তিনি এখন ১০০ কোটি টাকার মালিক। ফজলুল কবির আবার প্রথমে ওমান গিয়েছিলেন, সেখানে নিঃস্ব হয়ে পাড়ি দিয়েছিলেন দুবাই, আজ তিনি বিত্তশালী।

আসলে মেধা-পরিশ্রম আর সততা জীবনে সাফল্য আনে। আমাদের দুবাইওয়ালারাও এই তিনটির গুণে সাফল্য পেয়েছেন। তাদের জীবনে কষ্টের করুণ কাহিনিও আছে, কেউ কেউ দিনের পর দিন না খেয়ে না ঘুমিয়ে কাটিয়েছেন। জীবনে সমৃদ্ধি আনতে গিয়ে নরকের কিনারায়ও কেউ কেউ পৌঁছে গিয়েছিলেন, কিন্তু তারা হাল ছাড়েননি। ফলে একসময় কষ্ট বিদায় নিয়ে জীবনে সুখ এসেছে জীবনে।

আগেই বলেছি এস এম রানা সাংবাদিক, সেহেতু তার ‘আমাদের দুবাইওয়ালা’ বইটিতে সাংবাদিকসুলভ তাড়াহুড়া, তথ্যের অকারণ সমাবেশ দেখা যায়। বইটিতে দুবাই প্রবাসীদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, দেশ তথা চট্টগ্রামের সমাজ-সংস্কৃতিতে তার নানামুখী প্রভাব নিয়ে আলোচনা আছে, বিষয় হিসাবে এই অধ্যায় বইয়ের নান্দনিকতা বাড়িয়েছে তবে বিশ্লেষণ আরো অর্থপূর্ণ ও গভীর হতে পারতো। এরপরও এস এম রানার ‘আমাদের দুবাইওয়ালা’ বইটি প্রবাসীদের অর্থনীতি ও সমাজ-সংস্কৃতিতে এর প্রভাব অধ্যয়নে একটি আকর গ্রন্থ হয়ে উঠবে বলে আমার বিশ্বাস।

- নাসির উদ্দিন হায়দার।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।