ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

বইমেলা

মাসজুড়ে মেলা, অমর হুমায়ূন

সাজেদা সুইটি, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭১৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৯, ২০১৬
মাসজুড়ে মেলা, অমর হুমায়ূন ছবি: দীপু মালাকার/বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

অমর একুশে গ্রন্থমেলা ঘুরে: অনেক কষ্টের পর কথাসাহিত্যিক মুহম্মদ জাফর ইকবালের অটোগ্রাফ নিতে পারলেন ভদ্রমহিলা। হাতে যেন অমূল্য কিছু পেলেন।

আনন্দে অশ্রুসিক্ত নয়নে ফিরছেন, আর মুখে বলছেন, ‘হুমায়ূন আহমেদের আপন ভাই, হুমায়ূন আহমেদের আপন ভাই!’

গর্বভরে এ গল্প করছিলেন স্বয়ং জাফর ইকবাল। তার ভাই নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের প্রতি পাঠকদের এ ভক্তি তার চোখে আনন্দাশ্রু এনেছে।

বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপে জাফর ইকবাল জানালেন, প্রায়ই হুমায়ূন আহমেদের বই কিনে সেটিতে জাফর ইকবালের অটোগ্রাফ নিতে আসেন ভক্তরা। আপন ভাইয়ের মাঝে যেন প্রিয় লেখককে খুঁজে ফেরেন তারা।

‘মানুষ নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পছন্দ করে। সে চায় অন্যরা তাকে খুঁজে বের করুক। ’

জাফর ইকবাল ও তার স্ত্রী ইয়াসমিন হক বলেন, বই পড়ার এবং কিনে পড়ার অভ্যাস ধরিয়ে দিয়ে গেছেন হুমায়ূন আহমেদ। বেঁচে থাকতে তার কদর সেভাবে না হলেও, এখন সবাই তার গুরুত্বটা বুঝতে পারছে। কোথায় নেই তিনি? জীবনের গল্পগুলি তিনি যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন, তা আর কে পারছি? বাংলাদেশের পাঠকদের জন্য তিনিই প্রথম সায়েন্স ফিকশন লিখেছেন। বিজ্ঞানে আগ্রহী করেছেন নতুন প্রজন্মকে। নানাবয়সীদের পাঠের অভ্যাস করে দিয়ে গেছেন হুমায়ূন আহমেদ।

মেলায় কয়েকবার আসেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত। হুমায়ূন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, হুমায়ূনের পাতলা একটি বই কিনে গাড়িতে উঠতাম। জার্নিতেই শেষ করতাম সেটি, পৃষ্ঠা বেশিতো না। পড়ে মনটা ভালো লাগতো। দামও কম বইয়ের। কিন্তু ভেতরে যে জগৎ হুমায়ূন দেখাতেন, সেটা অনেক দামি।

‘আমরা জানি একদিন আমরা মরে যাব
এই জন্যেই পৃথিবীটাকে এত সুন্দর লাগে।
যদি জানতাম আমাদের মৃত্যু নেই
তাহলে পৃথিবীটা কখনোই এত সুন্দর লাগতো না। ’

বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপে বাংলা একাডেমির সভাপতি ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, হুমায়ূন আহমেদের লেখা এতোটাই প্রাণবন্ত, পাঠক এক ভিন্ন জগতে চলে যায়।

লেখার মায়াবি জগতে তারা একাত্ম হয়ে পড়ে। এ কারণেই তার লেখার এতো জনপ্রিয়তা। অনেক দুঃখ-কষ্টের মাঝেও বেঁচে থাকাটা যে অসম্ভব ভালো ব্যাপার, সেটি পাঠককে বলে গেছেন হুমায়ূন। তাই মানুষ এসব লেখায় জীবনকে দুঃখ-কষ্টসহই ভালোবেসে ফেলে।

‘সঠিক সিদ্ধান্তের
ক্ষমতা আছে শুধুই আল্লাহপাকের।
মানুষকে মাঝে মাঝে ভুল
সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রমাণ করতে হয়
যে সে মানুষ। ’

হুমায়ূন আহমেদের বিভিন্ন সময়ের তোলা ছবি নিয়ে আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুন প্রকাশ করেছেন একটি বই, অ্যালবামও বলা চলে। মেলায় এর প্রকাশনা অনুষ্ঠানে আসেন হুমায়ূন আহমেদের বোন মমতাজ আহমেদ।

বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপে তিনি বলেন, লিখতে ভালোবাসতেন হুমায়ূন আহমেদ। ছোট ছোট কথায় জীবনের অনেক বড় সত্য সাবলীলভাবে তুলে ধরার জাদুকরি গুণ ছিল তার। কে জানতো, এ গুণই তাকে বাঙালির প্রাণে অমর করবে। পাঠকরা আসলে তার ভালোবাসারই মূল্যায়ন করছেন। হুমায়ূন আহমেদই বলতেন, ভালোবাসা মরে না।

‘কঠিন সত্য- হুমায়ূন আহমেদ বেঁচে নেই, তার নতুন বই আর পাবেন না পাঠকরা। কিন্তু সেই সঙ্গে এটাও সত্য- পাঠক কমে যায়নি এ লেখকের। পাঠকের সঙ্গে যেন আত্মার সম্পর্কই গড়ে গেছেন তিনি’-বাংলানিউজের সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন।

মিসির আলী, হিমু, শুভ্রসহ হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্ট চরিত্র হয়ে মাসজুড়ে মেলায় ঘুরেছেন তার ভক্তরা- বলেন শাওন।    
 
‘মাঝে মাঝে আত্মার সম্পর্ক রক্তের সম্পর্ককেও অতিক্রম করে-হুমায়ূন আহমেদ। ’
 
একই মন্তব্য নাসির আলী মামুনেরও। এ আলোকচিত্রী লেখকের সাক্ষাৎকারও নিয়েছেন। ‘হুমায়ূন আহমেদ যেকোনো কথায় এমন যুক্তি দেখাতেন, প্রতিটি কথা অনবদ্য হয়ে উঠতো’- বলেন মামুন।

‘যা পাওয়া যায়নি, তার প্রতি আমাদের আগ্রহের সীমা থাকে না। মেঘ আমরা স্পর্শ করতে পারি না বলেই মেঘের প্রতি আমাদের মমতার সীমা নেই। ’
 
যেসব প্রকাশনা তার বই বের করার সৌভাগ্য পেয়েছিল, তাদের গর্ব ছিল পুরো মেলায়। স্টলে হুমায়ূনের বড় ছবি, বইয়ের নাম ঝুলিয়ে ক্রেতাদের মনোযোগ আকৃষ্ট করেছেন তারা সহজেই। নিজেদের আভিজাত্যও যেন এভাবে ফোটাতে চেয়েছেন।

হুমায়ূন আহমেদের সর্বাধিক বই প্রকাশকারীদের অন্যতম অন্যপ্রকাশ-এর প্রধান নির্বাহী মাজহারুল ইসলাম বাংলানিউজ বলেন, হুমায়ূন আহমেদ এখনো মেলার প্রাণ। তিনি অমর তার লেখা দিয়ে। জীবনাবসানের পরেও তিনি পাঠক হারাননি। লেখকের পুরনো বইগুলোর কাটতি কমেনি একটুও। সব বয়সী পাঠক এখনো সেসব বই কিনে নিচ্ছেন।

‘মানুষ যখন মৃত্যুর দিকে এগোতে থাকে তখন সে
ব্যাকুল হয়ে পেছনে তাকায়। আমার মনে হয় তাই
হয়েছে। সারাক্ষণই শৈশবের কথা মনে পড়ে। কী
অপূর্ব সময়ই না কাটিয়েছি!’ (কিছু শৈশব)
 
‘যে একবার হুমায়ূন আহমেদের লেখার স্বাদ পেয়েছে, সে আর বিমুখ হতে পারেনি। তার জাদুতে বুঁদ হয়ে একের পর এক বই কিনে নিচ্ছেন, নিজেদের সংগ্রহশালা আরও সমৃদ্ধ করছেন’- বলেন তাম্রলিপির প্রকাশক একেএম তারিকুল ইসলাম রনি।  

একই রকম বক্তব্য হুমায়ুনের অন্য প্রকাশকদেরও। এ লেখকই এখনো তাদের মুখের হাসি ফোটাচ্ছেন। অন্যপ্রকাশ, অন্বেষা, কাকলী, তাম্রলিপির স্টলে হুমায়ূন ভক্তদের ভিড় দীর্ঘশ্বাস জাগিয়েছে অন্য স্টলগুলোতে।  
 
এ প্রকাশকরাও বলছেন, ঘুরে ফিরে হুমায়ূন আহমেদকেই খোঁজেন পাঠকরা। এ লেখকের বইয়েই সমৃদ্ধ তাদের স্টল।

হুমায়ূন বেঁচে থাকতে মেলায় তাকে ঘিরে যে ভিড়, উচ্ছ্বাস থাকতো, সে চিত্র এখনো মনে পড়ে সংশ্লিষ্টদের।

‘মেয়েদের মন পৃথিবীর সবচেয়ে স্পর্শকাতর জায়গা। এই মন অনেক কঠিন বিষয় সহজে মেনে নেয়, আবার অনেক সহজ বিষয় সহজে মেনে নিতে পারে না। ’

হুমায়ূন আহমেদের সাবেক স্ত্রী গুলতেকিন খানের কবিতার বই এসেছে এ মেলায়। নতুন আসা কবিতার বইয়ের মধ্যে এটিকে সর্বোচ্চ বিক্রিত বলছেন অনেকেই।

পাঠকরা গুলতেকিনকে কবি হিসেবে নতুন করে চিনলেও হুমায়ূনপত্নী হিসেবে চেনেন বহুবছর ধরে। প্রিয় লেখকের জীবনসঙ্গী বলে তার প্রতিও রয়েছে তাদের সীমাহীন মমতা।

তাম্রলিপি থেকে গুলতেকিনের ‘আজো, কেউ হাঁটে অবিরাম’ কিনেছেন শ্যামলী দত্ত। হুমায়ূনের ‘দেবী’ বইটি ১৫ বারের বেশি পড়েছেন বলে আলাপে জানান।

গুলতেকিনের বই প্রসেঙ্গ বলেন, স্যারের লেখক জীবনের শুরু থেকে গুলতেকিন ভাবি বড় প্রেরণা ছিলেন। সে ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা থেকে বইটি কিনেছি। আমার বিশ্বাস, ভাবির লেখাও অনেক ভালো হবে। ’

‘মেয়েরা ব্যক্তিগত চাহিদার কাছে কখনো পরাজিত হয় না-(আমিই মিসির আলী)
 
যদিও গুলতেকিন নিজের পরিচয়ে এসেছেন মেলায়, তবু পাঠকের ভালোবাসা পাচ্ছেন দু’ভাবেই।

মেলায় আগতদের আলাপে কান পেতে ভালোবাসার নানা মন্তব্য পাওয়া যায়। কেউ কেউ হুমায়ূনের মা আয়েশা ফয়েজের লেখা বইটির খোঁজও করেছেন। দুই ভাই (জাফর ইকবাল, ও উন্মাদ-এর প্রধান সম্পাদক আহসান হাবীব) স্বনামেই পরিচিত, তবু ভালোবাসা পান প্রিয় লেখকের ভাই বলেও। সাবেক স্ত্রী গুলতেকিন, দ্বিতীয় স্ত্রী শাওনসহ প্রত্যেকেই পাঠকের কাছে আদৃত হয়েছেন হুমায়ূনের নামে।

মমতাজ আহমেদ এটিকে ‘ভালোবাসার উত্তরাধিকার’ আখ্যা দেন। মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নেওয়ার চেয়ে বড় কিছু আর নেই বলে মনে করেন হুমায়ূন আহমেদের স্নেহের এ বোন।

সমাপ্তির পথে প্রাণের মেলা, এবার ছিল হুমায়ূন চত্বরর, তার নামে মোড়ক উন্মোচনের মঞ্চ। তার জীবদ্দশায় মেলার চিত্রের সঙ্গে তুলনা ছিল অনেক আলোচকের মূল আলোচ্যও।

বাংলাদেশ সময়: ১৭১৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৯, ২০১৬
এসকেএস/এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।