ঢাকা: জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বাজেটে মোট জাতীয় উৎপাদনের অন্তত ৩.২% বরাদ্দের দাবি জানিয়েছেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। সোমবার (৫ জুন) জাতীয় প্রেসক্লাবের তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এই দাবি জানান তারা।
এই উদ্যোগ নিজস্ব উৎস্য থেকে জলবায়ু অর্থায়নে সহায়ক হতে পারে বলে তারা অভিমত প্রকাশ করেন। একই সঙ্গে অর্থ পাচার রোধে এবং একটি কার্যকর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে, দেশের কর ও আর্থিক ব্যবস্থারও সংস্কারের সুপারিশ করা হয়।
কোস্ট ফাউন্ডেশন, সেন্টার ফর পার্টিসিপেটরি রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (সিপিআরডি) এবং সেন্টার ফর সাসটেইনেবল রুরাল লাইভলিহুড (সিএসআরএল), ইক্যুইটি অ্যান্ড জাস্টিস ওয়ার্কিং গ্রুপ বাংলাদেশ (ইক্যুইটিবিডি), অ্যান অর্গানাইজেশন ফর সোসিও-ইকোনমিক ডেভেলমেন্ট (এওসেড), ক্লাইমেট অ্যাকশন নেটওয়ার্ক অন সাউথ এশিয়া, বাংলাদেশ (কানসা বিডি) এবং লিডারস যৌথভাবে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। আর ইক্যুইটিবিডির রেজাউল করিম চৌধুরী এই সংবাদ সম্মেলন সঞ্চালনা করেন।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করতে গিয়ে ইক্যুইটিবিডির সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আমিনুল হক বলেন, সরকার স্বাধীনতার পর থেকেই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জন্য বাজেটের একটি বিশেষ অংশ বরাদ্দ করে আসছে। মূলত দাতাদের দেখাতে দুর্যোগের জন্য বরাদ্দকৃত সেই অর্থ এখন জলবায়ু অর্থায়ন হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে। এই বরাদ্দ দেশের বর্তমান জলবায়ু পরিবর্তন জনিত বাস্তবতার সঙ্গে, বিশেষ করে বাংলাদেশকে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় দীর্ঘমেয়াদে জলবায়ু সহনশীল করে তোলা লক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
তিনি বলেন, ডেল্টা প্ল্যান-২১০০, মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনা-২০৩০ এবং ন্যাশনাল ডিটারমাইন্ড প্ল্যান ইত্যাদি সরকারি কৌশলগত জলবায়ু পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়নে প্রতি বছর জিডিপির প্রায় ৩.২% (বছরে ১৮৩০০০ কোটি টাকা) অর্থ প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমানে বিনিয়োগ বা বরাদ্দ সেই চাহিদার তুলনায় অনেক কম।
সিএসআরএলের সাধারণ সম্পাদক মো. জিয়াউল হক মুক্তা বলেন, ডেল্টা পরিকল্পনা এবং মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনাসহ বিভিন্ন সরকারি পরিকল্পনায় নীতিগত সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। প্রস্তাবিত ২০২৩-২৪ বাজেট এই অসঙ্গতির ফলাফল। যেখানে বাস্তবসম্মত জলবায়ু অর্থায়নের লক্ষ্য নেই। সরকারকে কৌশলগত জলবায়ু পরিকল্পনার বিষয়গুলিতে জোর দিতে হবে, এবং সেই অনুযায়ী জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় অর্থ বরাদ্দ করতে হবে।
সিপিআরডির প্রধান নির্বাহী মো. শামসুদ্দোহা বলেন, সরকারের মন্ত্রণালয়গুলোর অর্থ ব্যবহারের সক্ষমতার অভাব এবং তাদের খাতভিত্তিক কোনো পরিকল্পনা নেই। এ কারণেই আলাদা জলবায়ু অর্থায়নের প্রয়োজন। মন্ত্রণালয়গুলো বরং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় অর্থ নিতে আগ্রহী, কারণ সেখানে তুলনামূলক জবাবদিহিতা এবং স্বচ্ছতা খুব কম।
এওসেডের নির্বাহী পরিচালক শামীম আরেফিন বলেন, সরকার উপকূল সুরক্ষার বিষয়গুলোকে উপেক্ষা করেছে। এ কারণেই জলবায়ু তাড়িত বাস্তুচ্যুতি ও স্থানান্তর ঘটছে এবং বাড়ছে আর্থ-সামাজিক ভারসাম্যহীনতা। আশাকরি, সরকার সমস্যাগুলিকে গুরুত্বসহ বিবেচনা করবে এবং সেই অনুযায়ী জলবায়ু অর্থায়নের কৌশলগুলি সংশোধন করবে।
বাংলাদেশ ক্লাইমেট জার্নালিস্ট ফোরামের কাওসার রহমান প্রস্তাবিত বাজেটটিকে আইএমএফের শর্তের প্রতি সরকারের সম্মতি ও পরিপালন হিসেবে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, এই বাজেট ভ্যাটের মতো পরোক্ষ কর আরোপের মাধ্যমে দরিদ্র মানুষের দাবিকে অগ্রাহ্য করেছে। তাই বাজেট সংশোধন ও রাজস্ব আদায়ের জন্য সম্পদ কর প্রবর্তনের দাবি জানাচ্ছি।
কোস্ট ফাইন্ডেশনের মো. আহসানুল করিম দেশ থেকে অবৈধ অর্থ পাচার রোধে বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানান। একই সংস্থার ফেরদৌস আরা রুমী বলেন, এই বাজেট নারীদের প্রতি সেভাবে প্রয়োজনীয় মনযোগ দেয়নি। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় জলবায়ু বিপন্ন নারীদের জন্য অগ্রাধিকারভাবে বিশেষ বরাদ্দ দিতে হবে।
ইক্যুইটিবিডির নির্বাহী পরিচালক রেজাউল করিম চৌধুরী একটি সমন্বিত উপকূলীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়নে পর্যাপ্ত অর্থায়নের দাবি জানান। তিনি বলেন, সমন্বিত এই পরিকল্পনার আওতায় দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস, সামাজিক উন্নয়ন, কারিগরি শিক্ষা এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির কর্মসূচি বাস্তায়িত হতে পারে। এটি করা সম্ভব হলে উপকূলীয় জনগণের জন্য একটি প্রকৃত সুরক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
জলবায়ু রক্ষায় আয়োজকদের পক্ষ থেকে কয়েকটি সুনির্দিষ্ট দাবি তুলে ধরা হয়। সেগুলো হচ্ছে-
(১) সরকারকে অবশ্যই কৌশলগত পরিকল্পনা এবং বাস্তব প্রয়োজনানুযায়ী জলবায়ু অর্থায়ন হিসেবে জিডিপির কমপক্ষে ৩.২% বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে।
(২) জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ভিন্ন ভিন্ন বরাদ্দ না দিয়ে একটি সমন্বিত জাতীয় জলবায়ু বাজেট বরাদ্দ ও তার বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে।
(৩) জলবায়ু অর্থায়নের জন্য বৈদেশিক ঋণের ওপর নির্ভর না করে অভ্যন্তরীণ উৎস্য থেকে এই অর্থ সংগ্রহে জোর দিতে হবে।
(৪) অভ্যন্তরীণ উৎস্য থেকে অর্থ সংগ্রহের লক্ষ্যে অর্থ পাচার রোধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।
(৫) উপকূল সুরক্ষা সম্পর্কিত অবকাঠামো কর্মসূচিকে অগ্রধিকারপ্রাপ্ত বিনিয়োগ খাত হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ২০২৮ ঘণ্টা, জুন ৫, ২০২৩
ইএসএস/এমএমজেড