লক্ষ্মীপুর: পঞ্চাশোর্ধ্ব শামসুন্নাহারের বসতি মেঘনা নদীর তীরে। নদীর তীরঘেঁষা ঝুপড়ি ঘরের চাল এবং তিন পাশের বেড়া ভাঙাচোরা টিনের।
আট থেকে ১০ ফুটের বর্গাতির ছোট্ট কুঁড়েঘরে ছোট্ট এ ঘরের ভেতর শামসুন্নাহার ও তার স্বামী মো. বশির, দুই ছেলে এবং এক মেয়ের বসবাস। দুই ছেলের একজন আবার বুদ্ধি প্রতিবন্ধী আর মেয়েটির চোখে আলো নেই। তাদের আরও একটি মেয়ে আছে, অপ্রাপ্ত বয়সেই তাকে বিয়ে দিতে হয়েছে।
শামসুন্নাহার যে স্থানে বসতি গড়েছেন, সে জমি নিজেদের নয়৷ অন্যের জমিতে তিন বছর ধরে আশ্রয় নিয়েছেন তিনি। এটি লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার পাটওয়ারীর হাট ইউনিয়নের ইসলামগঞ্জ বাজার এলাকায়।
খালের ওপর থাকা জরাজীর্ণ সাঁকো পার হয়ে ফসলি ক্ষেত মাড়িয়ে যেতে হয় শামসুন্নাহারের কুঁড়েঘরে।
শামসুন্নাহারের এক সময় জমি ছিল, ছিল বসতিও। কিন্তু মেঘনা কেড়ে নিয়েছে সব। পাঁচবার ভাঙনের কবলে পড়েছেন তিনি। এবার ভাঙলে ছয়বারে গিয়ে ঠেকবে।
নদীর ভাঙনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে আজ তিনি ক্লান্ত। শরীরে নানা রোগের বাসা। শ্বাসকষ্টের রোগী তিনি। কিন্তু ওষুধ কেনার টাকা নেই তাদের।
শামসুন্নাহারের এখনকার মাথাগোঁজার ঠাঁইটিও মেঘনা কেড়ে নিতে চায়। ভাঙতে ভাঙতে ঘরের কোণে নদী চলে এসেছে। যে কোনো সময় ঘরটি গিলে খেতে পারে মেঘনা। এবার বসতি হারালে কোথায় আবার ঠাঁই হবে, সে চিন্তায় চোখে ঘুম নেই শামসুন্নাহারের।
শামসুন্নাহারের স্বামী মো. বশির পেশায় জেলে। অন্যের নৌকায় করে নদীতে গিয়ে মাছ শিকার করেন। জালে মাছ উঠলে কিছু টাকা আয় হয়, মাছ না ধরতে পারলে তিনবেলা ভাত জোটানো দায়। তবে ইলিশের নিরাপদ ডিম ছাড়া নিশ্চিত করতে গত ১২ অক্টোবর থেকে ২২ দিনের জন্য বন্ধ রয়েছে মাছ ধরা। সরকারি এ নিষেধাজ্ঞা শেষ হচ্ছে আজ (২ নভেম্বর) রাতে। এতোদিন নদীতে মাছ ধরা বন্ধ থাকায় এ পরিবারের আয়ও বন্ধ। আপাতত ধারদেনা করে চলছে শামসুন্নাহারের সংসার। প্রায় ৩০ বছর ধরে বশির মেঘনায় মাছ শিকার করেন। যখন যে এলাকায় থেকেছেন, সে এলাকার মহাজনের নৌকায় থেকে মাছ শিকার করতেন। তার একটি জেলে কার্ড ছিল। তখন নদীতে মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞার সময়ে সরকারি চাল পেতেন। তিন বছর ধরে তার জেলে কার্ডটিও কোনো কাজে আসছে না। চালের জন্য পাওয়ারীর হাট ইউনিয়ন পরিষদে গেলে সেখান থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়, জেলেদের তালিকায় বশিরের নাম নেই। তাই তো নিষেধাজ্ঞার সময়ে শামসুন্নাহার এবং বশিরের সংসারে অভাব যেন আরও চেপে বসে।
সেদিন বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে দিয়ে দেখা যায়, তখনও রান্না হয়নি শামসুন্নাহারের। ঘরের পাশে থাকা উনুনে ভাত-তরকারি বসিয়েছেন তিনি। সকাল থেকে মুড়ি ছাড়া পেটে কিছু পড়েনি পরিবারের কারও। বিকেলে তিনি যখন রান্না করছিলেন, তখন মেঘনার বাতাসে তার চুলার আগুন যেন নিভে যাচ্ছিল।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল, ভাত রান্নায় দেরি কেন- এমন প্রশ্নে চোখ ছলছল করে ওঠে শামসুন্নাহারের। জানালেন, ঘরে চাল না থাকায় পাশের মোল্লা বাড়ি থেকে চাল ধার করে এনেছেন। তাই দেরি৷ এ দৃশ্য যে শুধু এদিনের- তা কিন্তু নয়। এ সময়টা ধারকর্জ করেই চলছে। এ কয়েকদিনে চাল ধার করেছেন অন্তত ১৬ থেকে ১৭ কেজি। যখন সামর্থ্য হবে, তখন পরিশোধ করবেন।
শামসুন্নাহার বলেন, ঘরে চাল ছিল না। সকাল থেকে চালের কোনো ব্যবস্থা হয়নি। প্রতিবন্ধী ছেলে আর মেয়েটার মুখে তো ভাত তুলে দিতে হবে। তাই পাশের বাড়ি থেকে দেড় কেজি চাল কর্জ এনেছি। পরিত্যক্ত জায়গা থেকে কচুর লতি কুড়িয়ে এনে আলু দিয়ে রান্না করতেছি। আজকের দিনটা এভাবেই যাবে।
তিনি বলেন, প্রায় দিনই অনাহারে অর্ধাহারে কাটাতে হয়। কখনো সারাদিনের খাবার বিকেলে খাই, আবার কখনো সকালে খেলে দুপুরে খেতে পারি না। দুপুরে খেতে পারলে রাতে খাবার জোটে না।
সকাল থেকে কী খেয়েছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রতিবন্ধী ছেলেটা কাগো যেন কাম করছে, সেখান থেকে ২০ টাকা দিছে। ওই টাকা দিয়ে ২৫০ গ্রাম মুড়ি এনে সবাই খাইছি।
শামসুন্নাহার তার ছোট্ট ঝুপড়ি ঘর নিয়ে এখন ভীষণ চিন্তিত। কারণ নদী হয় তো আর বেশিদিন তাদের থাকতে দেবে না। যে কোনো সময় মাথা গোঁজার ঠাঁইটি কেড়ে নেবে। এরপর বৃদ্ধ স্বামী, বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ছেলে, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী তরুণী মেয়ে আর সাত বছরের ছেলেকে নিয়ে কোথায় যাবেন, সে চিন্তায় আছেন তিনি।
শামসুন্নাহার-বশিরের প্রথম বসতি ছিল কমলনগর উপজেলার সাহেবের হাট ইউনিয়নে। এখন থেকে ঠিক ২৫-২৬ বছর আগে সে বসতি গিলে খেয়েছে মেঘনা৷ এরপর বসতি গড়েন পাশের উপজেলা রামগতির মেঘনা নদীর বিচ্ছিন্ন দ্বীপ চর আবদুল্লাহতে। মেঘনা সে বসতিও খেয়েছে। এরপর সেখান থেকে কমলনগরের পাওয়ারীর হাট বাজারের পশ্চিমে আশ্রয় নেন। সেটিও গেছে মেঘনায়। পরে ইসলামগঞ্জ বাজারের পশ্চিমে গড়েন বসতি, দুইবার ভেঙেছে সে বসতি। এখন আছেন ইসলামগঞ্জ বাজারের দক্ষিণে। সেটিও ভাঙনের মুখে।
শামসুন্নাহারের স্বামী বশির সরকারি কোনো আশ্রয়কেন্দ্রে স্থায়ী বসতি গড়ার আশায় পাটওয়ারীর হাট ইউনিয়নের ইসলামগঞ্জ এলাকার কবির মোল্লা নামে একজন দফাদারকে ধরেছিলেন। সরকারি ঘরের তালিকায় নাম দেওয়ার আশায় সাড়ে পাঁচ হাজার টাকাও নিয়েছেন তাকে। আবার তাদের ছেলে এবং মেয়ের নামে প্রতিবন্ধী কার্ড করে দেওয়ার নামে নিয়েছেন সাড়ে তিন হাজার টাকা। কিন্তু কিছুই পাননি তিনি।
শামসুন্নাহার-বশিরের মতো মেঘনা তীরে এরকম হাজারো পরিবার রয়েছে, যারা মেঘনার ভাঙনের কবলে পড়ে নিঃস্ব হচ্ছেন৷ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রতিনিয়ত মেঘনা গ্রাস করছে ঘরবাড়ি, বসতি, ফসলি জমি, মাছের পুকুর। গৃহহীন হচ্ছে লক্ষ্মীপুরের হাজারো পরিবার। গৃহস্থবাড়ির কর্তা থেকে মুহূর্তে হতে হচ্ছে উদ্বাস্তু।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৪২ ঘণ্টা, নভেম্বর ২, ২০২৩
এসআই