ঢাকা, বুধবার, ১০ পৌষ ১৪৩১, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জলবায়ু ও পরিবেশ

সিডরের ১৬ বছর: ২৪২ কোটি টাকার বাঁধে ফাটল নিয়ে এখন আতঙ্ক 

এস এস শোহান, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩২৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৫, ২০২৩
সিডরের ১৬ বছর: ২৪২ কোটি টাকার বাঁধে ফাটল নিয়ে এখন আতঙ্ক 

বাগেরহাট: সুপার সাইক্লোন সিডরের ১৬ বছরেও আতঙ্ক কাটেনি বাগেরহাটের শরণখোলা ও মোরেলগঞ্জবাসীর। নির্মাণাধীন টেকসই বেড়িবাঁধে ভাঙন দেখা দেওয়ায় হতাশা বিরাজ করছে স্থানীয়দের মধ্যে।

 

২৪২ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ৬২ কিলোমিটার টেকসই বেড়িবাঁধের একাধিক স্থানে ফাটল ধরেছে। প্রায় ৭০০ মিটার বাঁধের ব্লক ধসে বিলীন হচ্ছে বলেশ্বর নদে। ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে অন্তত ২০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ। হস্তান্তরের আগেই এমন অবস্থা হওয়ায় চিন্তিত এলাকাবাসী।  

নদী শাসন না করে এবং মাটির পরিবর্তে বালু ব্যবহারে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।  
পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, নদী শাসন প্রকল্পের প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে, অনুমোদন হলে কাজ শুরু হবে।

২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর সুপার সাইক্লোন সিডরের আঘাতে লন্ডভন্ড হয়ে যায় বাগেরহাটসহ উপকূলীয় কয়েকটি জেলা। সরকারি হিসেবে এ দিনে প্রায় ৯০৮ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আর্থিক ক্ষতি হয় কয়েকশ কোটি টাকার। স্বজন হারানো বেদনা ও আর্থিক ক্ষতি ভুলে শরণখোলা-মোরেলগঞ্জবাসীর একমাত্র দাবি ছিল টেকসই বেড়িবাঁধ। গণ মানুষের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে সরকার ২০১৫ সালে ২৪২ কোটি টাকা ব্যয়ে উপকূলীয় বাঁধ উন্নয়ন প্রকল্প (সিইআইপি-কোস্টাল ইমব্যাংকমেন্ট ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট) নামে একটি প্রকল্পের অধীনে মোরেলগঞ্জ থেকে শরণখোলা উপজেলার বগী-গাবতলা পর্যন্ত ৬২ কিলোমিটার টেকসই বাঁধ নির্মাণ শুরু হয়। বেড়িবাঁধের ৯৫ শতাংশ কাজ শুরু হয়েছে। চলতি বছরের ডিসেম্বরে কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।

তবে সম্প্রতি ১৮ অক্টোবর বলেশ্বরের ভাঙনে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৩৫/১ পোল্ডারের শরণখোলা-মোরেলগঞ্জ বেড়িবাঁধের গাবতলা নামক স্থানে মূল বাঁধের নিচে ১০০ ফুট এলাকার বেশ কিছু সিসি ব্লকও নদীগর্ভে হারিয়ে গেছে। এছাড়া শরণখোলা উপজেলার বগী, ও মোরেলগঞ্জের আমতলা এলাকায় ভাঙন শুরু হয়েছে। বাঁধের ব্লক ধসে বিলীন হচ্ছে নদীতে। বাঁধের ব্যাপক এলাকা জুড়ে ধরেছে বিশাল ফাটল। এছাড়া বেশ কয়েকটি স্থান ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে। হস্তান্তরের আগেই এমন অবস্থা হওয়ায় চিন্তিত এলাকাবাসী।

শরণখোলা উপজেলার দক্ষিণ সাউথখালী গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল বারেক বলেন, বলেশ্বরের ভাঙনে আমার ও পরিবারের প্রায় ১৫০ বিঘা জমি হারিয়েছি। সিডরে স্বজন হারিয়েছি। বাঁধ নির্মাণ শুরু হলে আশায় বুক বেঁধেছিলাম। ভাঙন ও দুর্যোগ থেকে মুক্তি পাব। সেই স্বপ্ন এখন দুঃস্বপ্নে রূপ নিয়েছে। টেকসই বেড়িবাঁধেই ভাঙন শুরু হয়েছে। যে কোনো মুহূর্তে বড় ধরনের ভাঙন শুরু হবে। এখন মনে হচ্ছে বিপুল টাকার এ বাঁধ আমাদের কোনো কাজে আসবে না।
গাবতলা এলাকার আব্দুর রশীদ বলেন, বাঁধ নির্মাণের শুরুতেই আমরা নদী শাসনের দাবি করেছিলাম। এজন্য সভা, সমাবেশ, মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছি। তারপরও নদী শাসন না করে বাঁধ নির্মাণ করেছে সিইআইপি প্রকল্প। এখন বাঁধে ভাঙন শুরু হয়েছে, ফসলি জমি, গাছপালা, বসত ঘর ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

দক্ষিণ সাউথখালী গ্রামের জামাল জমাদ্দার বাঁধ নির্মাণে অনিয়মের অভিযোগ করে বলেন, বেড়িবাঁধের দুই পাশে মাটি দিয়ে মাঝখানে ১০ থেকে ১২ ফুট উচ্চতায় বালু দেওয়া হয়েছে। যে কোনো মুহূর্তে ব্লক সরে গেলে সব বালু নদীতে বিলীন হয়ে যাবে। তখন কোটি টাকার এ বাঁধ কোনো কাজেই আসবে না।  

মোরেলগঞ্জের খাউলিয়া ইউনিয়নের ফসিয়াতলা এলাকার দেলোয়ার তালুকদার বলেন, প্রতিনিয়তই ভাঙনে ধসে পড়ছে টেকসই বাঁধের ব্লকগুলো। পানি উন্নয়ন বোর্ডের লোকজন জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙন বন্ধের চেষ্টা করলেও কোনো কাজে আসছে না। নদীতে পানির গভীরতা ৫০ থেকে ৬০ হাতের ওপরে। সরকারের কোটি কোটি টাকা ভেসে যাচ্ছে।

এদিকে ভাঙনরোধে জরুরি ভিত্তিতে জিও ব্যাগ ফেলেও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন ঠিকাদারের প্রতিনিধি মনিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, গেল ১৫ দিনে গাবতলায় ভাঙনরোধে ২০০ মিটার জায়গায় ১৪ হাজার জিও ব্যাগ ফেলা হয়েছে। তারপরও ভাঙন রোধ হচ্ছে না। এখানে কংক্রিটের ব্লক ফেলানো জরুরি।

শরণখোলা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান রায়হান উদ্দিন শান্ত বলেন, সিডরের পরে আমাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ড সিআইপি প্রকল্পের দূরদর্শিতার অভাবে নদী শাসন না করেই বাঁধ নির্মাণের ফলে আজ বাঁধটি হুমকিতে পড়েছে। বিভিন্ন স্থানে ভাঙন ও ফাটল দেখা দিয়েছে।  
সিইআইপি প্রকল্পের মাঠ প্রকৌশলী মো. রাকিবুল ইসলাম নাহিদ বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৩৫/১ পোল্ডারের ৬২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণের ৯৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। চলতি বছরের ডিসেম্বর মাসে কাজ হস্তান্ত করা হবে। তবে বলেশ্বর নদের স্রোত তীব্র হওয়ায় বিভিন্ন স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। আমরা মাঠে থেকে পর্যবেক্ষণ করে কাজ করছি। তবে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে নদী শাসন জরুরি হয়ে পড়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড বাগেরহাটের নির্বাহী প্রকৌশলী মাসুম বিল্লাহ বলেন, ৬২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের ২০ কিলোমিটার ঝুঁকিপূর্ণ। নদীর গভীরতা ও স্রোত বেশি থাকায় ভাঙন সৃষ্টি হওয়ায় নদী শাসনের একটি প্রকল্প প্রস্তাব ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে। অনুমোদন হলে ভাঙনের সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।  

বাংলাদেশ সময়: ১৩১৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৫, ২০২৩
এসআই
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।