এক সময় বিশ্বের সবচেয়ে বড় কার্পেট আর ঝাড়বাতির ছিল ওমানের এই প্রধান মসজিদটির অধিকারে। নামও উঠে গিনেস ওয়ার্ল্ড বুকে।
এসব অনুষঙ্গের হিসেব-নিকেশে ওমানিদের কিছুটা আক্ষেপ থাকতেই পারে। কিন্তু আধুনিক ইসলামী স্থাপত্যের গৌরবময় নিদর্শনের মর্যাদার কোনো হেরফের হয়নি। সুলতান কাবুস গ্র্যান্ড মসজিদটি দেখার পর আমার ধারণা তেমনই।
আরও পড়ুন>>
** মুঘল আমলের নজরকাড়া মসজিদ (পর্ব-২)
গত রমজানে জরুরি কাজে যেতে হয়েছিল মরুর দেশ ওমানে। জমিয়াতুল বিদার নামাজ পড়তে গিয়ে দেখা হয়ে যায় বর্তমান বিশ্বের অন্যতম এই ইসলামিক স্থাপত্যটি। পাঠকদের কাছে তুলে ধরছি অনূভূতি; নজরকাড়া মসজিদটির গর্ব করার মত ইতিহাসের সঙ্গে।
সুলতান কাবুস বিন সাইদ আল সাইদ। ওমানের বর্তমান শাসক। শাসন করছেন প্রায় ৪৭ বছর ধরে। মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে দীর্ঘ সময়ের রাষ্ট্রপ্রধান। স্বদেশি এবং প্রবাসী সবার কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়।
রাজত্বের ৩০তম বছরে জাতিকে তিনি উপহার দেন এই মসজিদ। রাজধানী মাস্কাটের বাউশার এলাকার ৪ লাখ ১৬ হাজার বর্গমিটার জমির উপর বানানো মসজিদটি ২০০১ সালে উদ্বোধন করা হয়।
সুন্দর স্থাপত্যশৈলীর জন্য মসজিদটি এখন ওমানের প্রধান পযর্টন আকর্ষণও বটে। বছরজুড়ে ভিড় থাকে বিশ্ব পর্যটকদের। এটি ওমানের একমাত্র মসজিদ যেখানে অমুসলিমরাও যেতে পারেন।
সকাল সাড়ে ১১টায় বাঙালিপাড়া খ্যাত হামিরিয়া থেকে রওনা হই। সঙ্গী হলেন প্রবাসী বাংলাদেশি গায়ক এমদাদ বাচ্চু, নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা প্রকৌশলী শরীফ জাকের এবং হেলাল উদ্দিন।
প্রধান সড়ক ধরে বিমানবন্দরের দিকে ২০ মিনিট যেতেই দূর থেকে চোখে পড়ল মসজিদের পাঁচ মিনার। আকাশছোঁয়া বড় একটির সঙ্গে ছোট আরও চারটি। কাছে যেতে দেখলাম মসজিদের সামনের বিশাল জায়গাজুড়ে শান্ত, সুন্দর সাজানো ফুলের বাগান। যা মসজিদের সৌন্দর্যকে অনেকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
গাড়ি এগিয়ে গেল পেছনে পার্কিংয়ের দিকে। কাছে আসতেই গাড়ির লম্বা সারি দেখে ভড়কে গেলাম। আখেরি জুমা মনে হয় মিস হলো! না বেশিক্ষণ হলো না। অল্পতেই জট হালকা হয়ে গেল। সুন্দর ব্যবস্থাপনা। সহজেই ঢুকে গেলাম পার্কিংয়ে।
গাছ গাছালি বেষ্টিত বিশাল পার্কিংয়ে শত শত গাড়ি। জায়গা বের করাই কঠিন হয়ে পড়ে। শেষপর্যন্ত পাওয়া গেলো। গাড়ি থেকে নামতেই কানে বাজলো খুৎবার ধ্বনি। সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত ঢুকে পড়লাম মসজিদে।
উপচে পড়া মুসল্লি। বাইরের চত্বর ও বারান্দাগুলোতেও কোনো জায়গা নেই। ২০ হাজার মুসল্লি এক সঙ্গে নামাজ পড়তে পারেন এই মসজিদে। মনে হচ্ছে আজ তা ছাড়িয়ে গেছে। পেছনের বারান্দায় জায়গা পেলাম। নামাজ শেষে দেখার পালার শুরু। গাইড হলেন প্রকৌশলী শরীফ জাকের।
স্থাপত্যশৈলীর আগাম ধারণাও পেলাম তার কাছে। জানালেন, চতুর্ভূজ আকৃতির এই মসজিদ ওমানের এবাদি মুসলিম সমাজ ব্যবস্থার প্রতীকস্বরূপ। দুইটি করিডোর দিয়ে সংযুক্ত তিনটি পৃথক হল। একই সঙ্গে বেলে পাথর, মার্বেল পাথর ও স্টেইনড গ্লাসের সমন্বয়ে গড়া নকশার পরতে পরতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে-সাগর আর মরুভূমির মিশেলে গড়ে ওঠা আবহমান মরু-জীবন, যা সত্যিই অনন্য।
ইন্টারনেট থেকে আগেই ইতিহাসের অনেককিছু জানা হয়েছিল। তারপরও অফিস থেকে এক রিয়ালে নিলাম ইংরেজি তথ্য নির্দেশিকা; তথ্য পরখের সঙ্গে ভ্রমণ স্মারকও হলো।
ইতিহাস বলছে, ১৯৯২ সালে সুলতান কাবুস মসজিদটি বানানোর সিদ্ধান্ত নেন। পরের বছর প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নির্বাচন করা নকশা। অংশ নিয়েছিলেন দেশি-বিদেশি নামকরা নকশাবিদরা। ১৯৯৫ সালে শুরু হয় নির্মাণ কাজ। দায়িত্ব পায় ওমানি প্রতিষ্ঠান কার্লিয়ন আলাওই। মাস্কাট আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, জাতীয় যাদুঘর, মজলিশ, রয়েল ওপেরা হাউজের মতো ওমানের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো এই কোম্পানিরই বানানো।
স্থপতি ইরাকের মোহাম্মদ সালেহ মাকিয়া এবং লন্ডনের কুড ডিজাইন কোম্পানির তত্ত্বাবধানে ছয় বছর চার মাসে মসজিদটি তৈরি হয়। ২০ হাজার শ্রমিক কাজ করেন। ব্যবহার করা হয় বিশ্বের নানা জায়গার নামি-দামি সব উপকরণ। ৩০ হাজার মেট্রিক টন সেরা মানের বেলেপাথর আনা হয় ভারতের খনি থেকে।
ইতালি, মিশর, ভারত থেকে আনা হয় মার্বেল ও মোজাইক পাথর। ভাস্কর্য কাজ করে ওমানের ৬০ জন এবং ভারতের ২০০ জন কারুশিল্পী।
প্রথমে গেলাম প্রধান নামাজ ঘরে। স্থানীয় নাম ‘মুসালা’। আয়তন সাড়ে ৫ হাজার বর্গমিটারের বেশি। এক সঙ্গে জামাতে দাঁড়াতে পারেন প্রায় ৭ হাজার মুসল্লি। কারুকাজ করা উচু দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকেই চোখ জুড়িয়ে গেলো। উপর, নিচ, চারিদিকে নান্দনিক স্থাপত্য শৈলীর ছড়াছড়ি।
প্রকৌশলী শরীফ জানালেন, বিভিন্ন যুগের ঐতিহ্যবাহী ইসলামিক নকশার সমন্বয়ে গড়া প্রধান নামাজ ঘরটি মূলত ভিন্ন ভিন্ন মতাদর্শের অনুসারী ইসলামিক গোষ্ঠীসমূহের ঐক্য ও সহাবস্থানকে নির্দেশ করে, যা ওমানের এবাদি মুসলিম আদর্শের মূল ভিত্তি।
দেখে তাই মনে হলো। সাদা ও গাঢ় ধূসর মার্বেল পাথরে দিয়ে আচ্ছাদিত চারদিকের দেয়াল। গায়ে লতাপাতার মোটিফ ও জ্যামিতিক নকশার মুরাল। মেঝে জুড়ে বিছানো সেই বিখ্যাত কার্পেট। একসময় বিশ্বের হাতে বোনা টুকরাবিহীন কার্পেট, এখন দ্বিতীয় বৃহত্তম। আয়তন ৪ হাজার ৩৪৩ বর্গমিটার। ওজন ২১ মেট্রিক টন।
ক্লাসিক্যাল, তাব্রিজ, কাশান এবং ইসাফাহান ঐতিহ্যের নকশায় ১৭০ কোটি সুতার বন্ধনে বোনা। নানা রঙের বিন্যাস ২৮টি স্তরে। ৬০০ ইরানি নারী চার বছর ধরে এটি বুনেন। সরবরাহ করে বিশ্বখ্যাত ইরান কার্পেট কোম্পানি। আমিরাতের শেখ জাহেদ মসজিদে বসানো বর্তমান বিশ্বের বৃহত্তম কাপের্টটির আয়তন ৫ হাজার ৬৩০ বর্গ মিটার। ১২০০ কারিগর দুই বছরে সেটি তৈরি করে।
ছাদের মাঝ বরাবরে সুদৃশ্য কেন্দ্রীয় গম্বুজ, তার মাঝখানে ঝুলানো একসময় গিনিস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডের ঝাড়বাতিটি। এক সময় বিশ্বের সবচেয়ে বড় বর্তমানে দ্বিতীয় বৃহত্তম।
ওজন সাড়ে ৮ মেট্রিক টনের বেশি। উচ্চতা ১৪ মিটার। ৬ লাখ টুকরা অস্ট্রিয়ান স্বরভস্কি ক্রিস্টাল, ১১২২ টি হেলোজেন ব্লাব, মেটাল বিটের উপর ২৪ ক্যারেটের সোনার প্রলেপের এই ঝাড়বাতিও বানাতে ৪ বছর লেগেছিল। তৈরি করে জার্মানের ফৌস্টিগ কোম্পানি। এর সঙ্গে হলজুড়ে ১৬ টি ছোট ঝাড়বাতি প্রধান নামাজ ঘরকে আরো উজ্জ্বল করেছে।
কাতারের দোহায় আল হাতমি বিল্ডিংয়ের লবিতে স্থাপিত ‘রিফ্লেক্টিভ ফ্লো’ ঝাড়টি এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড়। ওজন ১৮ মেট্রিক টন। দৈর্ঘ্য সাড়ে ৩৮ মিটার এবং উচ্চতা ৫ দশমিক ৮ মিটার। বানানো হয়েছে ১ লাখ ৬৫ হাজার এলইডি এবং ২৩ শো অপটিক্যাল ক্রিস্টাল দিয়ে।
মেঝে থেকে ৫০ মিটার উপরে কেন্দ্রীয় গুম্বজটি চারটি বড় পিলারের সঙ্গে যুক্ত। গম্বুজের ভেতরটা মার্বেল কলাম কাঠামোর মধ্যে খোদাই করা রঙিন গ্লাসের অনেকগুলো ছোট ছোট জানালা এবং চীনা মাটির বাসন প্যানেলে অলঙ্কৃত।
গম্বুজের খালি অংশ বাদ দিয়ে পুরো সিলিংয়ে অলংকিত করা হয়েছে কারুকাজ খচিত কাঠের প্যানেলে। গম্বুজ আর সিলিং যে কত শৈল্পিক ও সুন্দর হতে পারে স্থপতি দেখিয়েছেন বটে। কিছুটা সময় নিতে হলো এই সৌন্দর্য থেকে চোখ ফেরাতে।
সিলিংয়ের সঙ্গে লাগানো ওপরের কলামে ইবনে মুক্লা শরাজির উদ্ভাবিত ইসলামী ঠুলুথ লিপিতে কোরানের আয়াত অংকিত। পাশের বারান্দার প্রবেশ পথগুলোও ইসলামিক জ্যামিতিক ও আলংকরিক ফ্রেমওয়ার্ক জ্যামিতিক ফ্রেমওয়ার্ক দিয়ে পূরণ করা।
সুন্দরে কোনো অংশে কম নয় মেহরাবটি। নিচ থেকে উপর পর্যন্ত অসংখ্য ছোট খুপরির প্যার্টানে মোজাইকে আচ্ছাদিত। লতা-পাতার মোটিফ ও আলংকারিক নকশার মাঝখানে আল্লাহ নাম ও কোরআনের আয়াতের ক্যালিওগ্রাফি, দেখে চোখ জুড়িয়ে গেলো।
প্রধান নামাজ ঘরের লাগোয়া নারীদের জন্য সাড়ে ৫০০ বর্গমিটারের আলাদা একটি মুসালা আছে। ৭৫০ জন এক সঙ্গে নামাজ পড়তে পারেন। পুরুষ ও নারীদের জন্য আলাদা অজুখানা দুটিও সুদৃশ মার্বেলে বানানো।
প্রধান প্রার্থনা হলের আশেপাশের ভবন, দেয়াল এবং চত্বর, বাইরের সীমানা দেয়াল ওমানের ঐতিহ্যবাহী দুর্গ স্থাপত্যের আদলে গড়া। নকশায় প্রাধান্য পেয়েছে পবিত্র কুরআনের আয়াত। বারান্দাগুলো অনেকটা সুরক্ষিত প্রাচীরের মতো মনে হয়। প্রতিটি নির্দিষ্ট ইসলামিক সংস্কৃতির সজ্জা ধারণ করছে।
রিভার্ক বা ইসলামী বাগান নকশা করা। বারান্দার সামনের দেয়ালের উপরে দেওয়ানি স্ক্রিপ্টে আল্লাহর নাম এবং বাইরের দেয়ালে পবিত্র কোরআনের আয়াত খোদাই করা। বাইরের ২৪ হাজার ৪০০ বর্গ মিটারের মেঝের পুরোটাতেই জ্যামিতিক নকশায় নানা ধরনের মার্বেল বসানো। চত্বর জুড়েও আচে বাহারী ফুলের বাগান।
দৃষ্টি পড়লো মিনারের দিকে। ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভ শাহাদা (বিশ্বাস), সালাত (প্রার্থনা), যাকাত (দাতব্য), সিয়াম (রোজা) এবং হজ (মক্কা তীর্থ) প্রতীকস্বরূপ পাঁচ মিনারের সম্মিলন। ৩০০ ফুট উচ্চতার বড়টি কেন্দ্রীয় গম্বুজের পাশে এবং প্রায় ১৫০ ফুট উচ্চতার ছোট চারটি মসজিদের ৪ কোণে।
এই মসজিদ কমপ্লেক্সে আছে ইসলামিক সায়েন্সেস ইনস্টিটিউট, ৩০০ জন ধারণক্ষম সেমিনার এবং ২০ হাজার বইয়ের সমৃদ্ধ বিশাল গ্রন্থাগার।
পরিদর্শন শেষে ইসলামী কেন্দ্রেটিতে বিশ্রাম নেওয়ার চমৎকার ব্যবস্থাও আছে। এখানে বিনামূল্যে ওমানি খেজুর, চা, আরবি গাওয়া দিয়ে আপ্যায়ন করনে পর্দানসীন ওমানি নারীরা। কথা বলার সুযোগও আছে তাদের সঙ্গে। অবশ্যই কোরআন, ইসলাম কিংবা ওমানের সংস্কৃতি বিষয়ে। রমজান বলে বন্ধ। হাতছাড়া হলো বিরল সুযোগটি !
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৪০ ঘণ্টা, জুন ০৬, ২০১৮
এমএ