ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ক্রিকেট

ডিজে মিউজিক, অ্যাসোসিয়েট ক্রিকেট ও একটি স্বপ্ন দেখতে না পারার বাস্তবতা

মাহমুদুল হাসান বাপ্পি, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট (স্পোর্টস) | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৫৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৩, ২০২৩
ডিজে মিউজিক, অ্যাসোসিয়েট ক্রিকেট ও একটি স্বপ্ন দেখতে না পারার বাস্তবতা

চট্টগ্রাম থেকে: ‘খেলা না দেখলে স্বপ্ন কীভাবে তৈরি হবে?’ ম্যাক্সওয়েল প্যাট্রিক ও'দউদ আফসোস করেন এমন। তার জন্ম নিউজিল্যান্ডে।

ক্রিকেটের পুরোটাজুড়ে অবশ্য কেবলই নেদারল্যান্ডস। দেশের প্রথম ও একমাত্র টি-টোয়েন্টি সেঞ্চুরিয়ানও তিনি। এবার বিপিএলে খেলছেন চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্সের হয়ে।

ডিজে মিউজিকে ডুবে থাকা, ক্রিকেটের শুরু ও স্বপ্ন, কোন পথে অ্যাসোসিয়েট ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ; এসব নিয়ে বাংলানিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে তার কথা শুনেছেন স্টাফ করেসপন্ডেন্ট মাহমুদুল হাসান বাপ্পি...

বাংলানিউজ: প্রথমবার বাংলাদেশে এসে কেমন লাগছে?

ম্যাক্সওয়েল: বেশ ভালো। চট্টগ্রামে এসে আবহাওয়াও বদলাতে দেখলাম। সূর্যের দেখা পাওয়া গেল বেশ ভালোভাবে। ভালোই লাগছে।

বাংলানিউজ: এটা (বিপিএল) তো আপনার প্রথম ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ, খবরটা পেয়ে কেমন লেগেছিল?

ম্যাক্সওয়েল: খবরটা পাই রাত সাড়ে এগারোটার দিকে। তখন প্রেমিকার সঙ্গে বসে সিনেমা দেখছিলাম। হঠাৎ এজেন্ট ম্যাসেজ পাঠিয়ে বললো, ‘তোমাকে অভিনন্দন’। আমি বললাম, ‘কীসের জন্য?’। সত্যিই কিছু বুঝতে পারছিলাম না। আমার মনেই ছিল না ড্রাফটের ব্যাপারটা।

এরপর অ্যাজেন্ট বললো, ‘তুমি বিপিএলে দল পেয়েছো...’। টুইটারে গিয়ে সার্চ করে পেলাম, ‘ম্যাক্সওয়েলকে দলে নিয়েছে চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্স’। এরপর বাতাসে হাত ছড়িয়ে দিয়ে বললাম, ‘অবশেষে...’। অনেকদিন ধরেই একটা ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে খেলতে চাচ্ছিলাম, শেষ অবধি!

বাংলানিউজ: নেদারল্যান্ডসে খেললেও আপনার জন্ম তো এখানে না...

ম্যাক্সওয়েল: আমার জন্ম নেদারল্যান্ডসে না, নিউজিল্যান্ডে। মা ডাচ ছিলেন, ওই সূত্রেই আর কি। ৫ থেকে ১৩ বছর অবধি নেদারল্যান্ডসেই ছিলাম। এরপর হাই স্কুলের জন্য নিউজিল্যান্ডে ফিরি। পরে আবার নেদারল্যান্ডসে ফিরে ক্রিকেট শুরু করি ১৯-২০ বছর বয়স অবধি। এরপর থেকে এখানকার হয়েই খেলছি।

বাংলানিউজ: এখনও কি নিউজিল্যান্ডে যাওয়া-আসে আছে?

ম্যাক্সওয়েল: হ্যাঁ, ছয় মাস করে থাকি দুই জায়গায়। কারণ শীতের সময় নেদারল্যান্ডসে কোনো ক্রিকেট থাকে না। ওই সময় সব ক্রিকেটারের বাইরে যেতে হয়। যদিও এটা এখন অনেকটা বদলে যাচ্ছে। বছরের ৭-৮ মাস নেদারল্যান্ডসেই থাকি।

বাংলানিউজ: মা ডাচ হলেও আপনার বাবা তো নিউজিল্যান্ডেরই, রাগবি কোচ। উনি ক্রিকেট খেলতেন?

ম্যাক্সওয়েল: বাবা ক্যারিয়ার বা জীবনেরই অনেক বড় অংশজুড়েই আছেন। উনিও পেশাদার ক্রিকেট খেলতেন, জাতীয় দলে অবশ্য খেলতে পারেননি। অকল্যান্ডের হয়ে ঘরোয়া ম্যাচে মাঠে নেমেছেন। এর বাইরেও উনি এমন একজন, যার সঙ্গে যেকোনো বিষয়ে কথা বলা যায়।  

পিচ টার্ন করুক অথবা না করুক; বোলার যেমন হোক অথবা মানুষ, পরিস্থিতি- উনার সবসময়ই আমার জন্য প্রশ্ন থাকে। বাবা এমন একজন, যার সঙ্গে যেকোনো মুহূর্তে কথা বলা যায়, আমার পাশে থাকেন। এটা আমার জন্য জরুরিও।

বাংলানিউজ: নেদারল্যান্ডসের ক্রিকেটের অবস্থা এমনিতে কেমন?

ম্যাক্সওয়েল: খুব বেশি ভালো না। হয়তো ৫-৬ হাজার মানুষ ক্রিকেট খেলে বা এটা সম্পর্কে জানে। তো, খুব বেশি না- বুঝতেই পারছেন। আমরা যদি ভালো করে যেতে পারি, তাহলে হয়তো লোকজন দেখবে, জানবে।  

বাংলানিউজ: এই যে বললেন মাত্র ৫-৬ হাজার মানুষ দেখে। এখানে বাংলাদেশে এসে আবার দেখছেন সবার আগ্রহ ক্রিকেট নিয়ে। একই পেশায় থেকেও নেদারল্যান্ডসে সেটা পাচ্ছেন না। কষ্ট লাগে?

ম্যাক্সওয়েল: একটু-আধটু খারাপ লাগে। আমি ক্রিকেট খেলি, এটা আমার পেশা; আমি চাইবো লোকজন খেলাটা সম্পর্কে জানুক। আমার মনে হয় বাংলাদেশের মতো দেশে খেললে প্যাশনটা আপনি উপলব্ধি করতে পারবেন।

ক্রিকেট এখানে ধর্মের মতো। সব ক্রিকেটারদের ব্যাপারেই সাধারণ মানুষও সবকিছু জানে। নেদারল্যান্ডসে আমাদের এ ধরনের অভিজ্ঞতা নেই। অবশ্যই তাতে দুনিয়া শেষ হয়ে যাচ্ছে না। আমরা এখনও বিশ্বসেরাদের বিপক্ষে খেলি, ভালো সুযোগ পাই। কিন্তু ক্রিকেটটা আরেকটু ভালো জায়গায় দেখা নিশ্চয়ই আনন্দের হবে।

বাংলানিউজ: আপনি তো বোধ হয় ক্রিকেটকে ‘আরেকটু ভালো’ জায়গায় নেওয়ার ব্যাপারে বেশ সিরিয়াস। ক্রিকেটার এখনও, আবার কোচিংও করান...

ম্যাক্সওয়েল: খুব বড় কিছু তো না আসলে। আমার একটা ক্রিকেট একাডেমি আছে অকল্যান্ডে। এখন তো এখানে, কোচিং করাতে পারছি না...। তবে একাডেমি শুরু হয়েছে ভালো ক্রিকেটার যেন আসে, আমার কাছে শিখতে পারে। তরুণ থাকতে যে ভুল করেছি, সেটাই তাদের বলতে চাই।  

বাংলানিউজ: আমরা প্রায়ই দেখি, অ্যাসোসিয়েট দেশগুলোর নায়োকোচিত পারফরম্যান্স খুব পছন্দ করে সবাই। সম্ভবত আইসিসিও। কিন্তু তারা কি যথেষ্ট জায়গা পায়?

ম্যাক্সওয়েল: এখন অন্তত আমার মনে হয়, আগের চেয়ে অ্যাসোসিয়েট দেশগুলো ভালো সুযোগ পাচ্ছে। গত বিশ্বকাপেই দেখা গেছে এটা, আমরা প্রমাণও করেছি। স্কটল্যান্ডের কাছে হেরেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, আমরা দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়েছি, নামিবিয়া শ্রীলঙ্কাকে হারিয়েছে; সবাই সবাইকে নিয়মিতই হারাচ্ছে।  

খেয়াল করলে দেখবেন, দলগুলোর মধ্যে পার্থক্য কিন্তু কমে আসছে। অ্যাসোসিয়েট দেশগুলোর আরও ভালো করার জন্য সেরাদের বিপক্ষে খেলতে হবে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে খেলে গতবার বিশ্বকাপ শুরু করেছি, নিউজিল্যান্ড, পাকিস্তান, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে খেলেছি।  

বিশ্বকাপে গিয়েছি বাড়তি আত্মবিশ্বাস নিয়ে। এখন দেখেন আমি, পল ভ্যান মেকেরিন, কলিন আকারম্যান বিপিএলে। দুই-তিনজন খেলছে দুবাইয়ে। সবাই কেন সুযোগ পাচ্ছে? কারণ তারা জানে বিশ্বসেরাদের বিপক্ষে কীভাবে খেলতে হয়।

বাংলানিউজ: কয়েকদিন আগে জাতীয় দলে আপনার সতীর্থ পল ভ্যান মেকেরিনের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি বলছিলেন টিভি, পত্রিকা, অনলাইন; কোথাও ক্রিকেট নেই। এমন হলে কীভাবে ক্রিকেট এগিয়ে যাবে?

ম্যাক্সওয়েল: আপনিই তো বলেছেন, সত্যিই কীভাবে এগোবে?...জানি না। খুব কঠিন। একটা দেশের ক্রিকেটের উন্নতির শুরুটা হয় আসলে জাতীয় দলের খুব ভালো বা বড় কোনো পারফরম্যান্স দেখে। আমি নিশ্চিত আপনিও ক্রিকেট দেখতে শুরু করেছেন জাতীয় দলের কোনো একটা ঘটনা দেখে। যখন আপনি তাদের ভালো করতে দেখবেন, তখন তরুণ বা যে-ই ক্রিকেট খেলতে চায়; দেখবে জাতীয় দল কী করে।  

কারণ যদি আপনি খেলাটাকে ছড়াতে চান, তরুণদের আকৃষ্ট করতে হবে। তারা যদি টিভিতে খেলাই না দেখে তাহলে তারা দেখবে কীভাবে? আপনি কেবল ভাববেন আমি ক্রিকেট খেলবো...এভাবে তো হয় না। অথবা ধরেন হলো, একদিন হয়তো জাতীয় দলেও খেলে ফেলবেন। কিন্তু তাতে কারো কিছৃ যায়-আসে না।

এখানে বাংলাদেশেই দেখুন, জন্মের পর থেকে সাকিব আল হাসান বা আফিফ হোসেনকে দেখছেন। তাদের মতো হওয়ার ইচ্ছে হচ্ছে। টিভিতে তাদের দেখাচ্ছে। নেদারল্যান্ডসে তেমন কিছু নাই। এজন্য আমাদের বিশ্বমঞ্চে আরও বেশি ভালো করা দরকার।  

বাংলানিউজ: অ্যাসোসিয়েট দেশগুলোর এগিয়ে যাওয়ার পথ কি টি-টোয়েন্টিই?

ম্যাক্সওয়েজ: আমার তো তেমনই মনে হয়। কারণ টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট ছোট, রোমাঞ্চকর, দ্রুতগতির; বেশি আপসেট তৈরি করে। ওয়ানডের তুলনায় দুই দলকে কাছাকাছি আনে। ছোট দলগুলোর জেতার সুযোগও তাই স্বাভাবিকভাবেই বেশি...

বাংলানিউজ: কিন্তু সবাই বলে ‘টেস্ট ক্রিকেট বেস্ট ক্রিকেট’। আপনার সাদা পোশাকে খেলার ইচ্ছে নেই?

ম্যাক্সওয়েল: আমি টেস্ট ক্রিকেট ভালোবাসি। অনেক দেখিও। কিন্তু বাস্তবতা ভুলে গেলে চলবে না। টেস্ট ক্রিকেট খেলার জন্য নেদারল্যান্ডসের যথেষ্ট ক্রিকেটার নেই। এটা আমাদের দিয়ে এখন হবে না। আপনি অন্য দলগুলোকে দেখুন, তিন ফরম্যাটে আলাদা স্কোয়াড আছে। এটার জন্য অন্তত ৫০ জন ক্রিকেটার লাগবে। আমার মনে হয় না অর্ধেক প্লেয়ারও আছে নেদারল্যান্ডসের। আমাদের জন্য টেস্ট খেলা সত্যিই কঠিন।

বাংলানিউজ: শেষদিকে চলে এসেছি... ম্যাক্সওয়েল না ডেকে আপনাকে তো ডিজে ম্যাক্সও বলা যায়?

ম্যাক্সওয়েল: হাহাহাহা...বলতে পারেন। সারাজীবন ধরেই এই কাজ করছি। ছোটবেলায় বাবা-মা ইলেকট্রনিক মিউজিক বাজাতেন। এসব শুনতে শুনতেই বড় হয়েছি। আমি ডিজের জিনিসপত্র নিয়েই ঘুরে বেড়াই। বাংলাদেশে অবশ্য আনিনি। জানি এখানকার মানুষ আমার মিউজিক পছন্দ করবে কি না।

বাংলানিউজ: আপনার লম্বা চুলের কারণও কি তাহলে ডিজে মিউজিক? 

ম্যাক্সওয়েল: নাহ! আপনি ভাইকিংস দেখেছেন? ওখানের একটা চরিত্রকে পছন্দ করতো আমার প্রেমিকা লম্বা চুলের। এটা বাদ দিলেও লম্বা চুলে আমাকে ভালোই মানায়! পুরোনো ছবিগুলো দেখলে হয়তো আরেকটু ভালো বুঝতে পারবেন...

বাংলানিউজ: চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্স জিতলে কি ডিজে হবেন?

ম্যাক্সওয়েল: অবশ্যই, বিপিএল যদি জিতে যাই। কোনো সন্দেহ নেই ইকুইপমেন্ট পেলে আমি ডিজে হবো....

বাংলানিউজ: এখানে আছে কি না জানি না, তবে ঢাকায় কিন্তু আছে...

ম্যাক্সওয়েল: তাই না কি? তাহলে তো হলোই...

বাংলাদেশ সময়: ১০৫২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৩, ২০২৩
এমএইচবি/এমএইচএম 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।