ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ক্রিকেট

সমালোচনার পথ পেরিয়ে রোমাঞ্চের বিপিএল

মাহমুদুল হাসান বাপ্পি, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট (স্পোর্টস) | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৫০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১১, ২০২৩
সমালোচনার পথ পেরিয়ে রোমাঞ্চের বিপিএল

ঘটনাটি চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামের। কোনো এক দর্শক মাঠে নেমে যাওয়ার পর ভীষণ কড়াকড়ি শুরু হলো।

সংবাদ সম্মেলনে কে আসবেন, দেখার কৌতূহল মেটানো হয়ে পড়লো কঠিন। সিকিউরিটির দায়িত্বে থাকা লোককে কিছুতেই বুঝানো গেলো না বাউন্ডারি লাইনে দাঁড়ানোর জন্য।

কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর সাইড স্ক্রিনের জন্য দেওয়া কালো কাপড় সরাতেই হাজির বিস্ময়। প্লেয়ার লিস্টের ছবি আবার দেখতে হলো, পুরো ম্যাচ ঘোরেই কাটলো কি না! সংবাদ সম্মেলনে যিনি আসছেন, তার নাম রবিন দাস; তাকে না চেনার কোনো কারণ নেই। কিন্তু বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ওই ক্রিকেটার সেদিনের ম্যাচটি খেলেনইনি।  

বদলি ফিল্ডার হিসেবে নেমেও দৃষ্টিকটু মিস করেছেন, তরুণ ক্রিকেটারের চোখেমুখে টিভি পর্দায়ই ফুটে উঠেছে হতাশা আর ভয়। হারতে থাকা ঢাকার প্রতিনিধি হয়ে তাকেই শেষ অবধি আসতে হয় সংবাদ সম্মেলনে। পরে রবিন বিপিএল ছাড়েন মাঝপথে। মাঠের বাইরের এমন নানা কাণ্ড ছিল পুরোটা সময় জুড়েই। তবুও বিপিএলের মাঠের ক্রিকেট ছড়িয়েছে বেশ রোমাঞ্চ। লিগ পর্বের সেসবই এক করা হয়েছে বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য...

ব্যাট হাতে দেশিদের দাপট

নাজমুল হোসেন শান্ত যেন বিপিএলেরই প্রতিচ্ছবি। সমালোচনার বন্ধুর পথ তিনি পার করছিলেন অনেক দিন ধরেই। চট্টগ্রাম পর্বেই তাকে গ্যালারি থেকে ‘লর্ড শান্ত’, ‘লর্ড শান্ত’ বলে চিৎকার করা হচ্ছিল। মন খারাপের কথা পড়ে জানিয়েছিলেন এই ব্যাটার। বলেছিলেন ‘মনে হয় দেশের বিরুদ্ধে খেলি’ এমন কথাও।  

এসব পাশ কাটিয়েও ব্যাট হাতে আলো ছড়িয়েছেন শান্ত। করেছেন দুর্দান্ত ব্যাটিং। সিলেট স্ট্রাইকার্সের সাফল্যে ভূমিকা রেখেছেন বড়। নিজের ইনিংস টেনেছেন লম্বা সময়। ১২ ম্যাচে ৩৭.৪০ গড় আর ১১০.৬৫ স্ট্রাইক রেটে করেছেন ৩৭৪ রান।  

শান্তই কেবল নন, এবারের বিপিএলে ব্যাট হাতে আলো ছড়িয়েছেন দেশিরাও। তৌহিদ হৃদয় ঘরোয়া ক্রিকেটে পরিচিত মুখ অনেকদিন ধরেই। ভাঙা-গড়ার খেলায় এবার জয়ী হয়েছেন তিনি। নিজেকে বদলে হাজির হয়েছেন ভিন্ন রূপে। এই ব্যাটার মাঝে ইনজুরির যন্ত্রণা সহ্য করেছেন, পরে ফিরে এসেও পারফর্ম করেছেন। ১০ ম্যাচ খেলে ৯ ইনিংসের পাঁচটিতে হাফ সেঞ্চুরিতে ৩৭৮ রান করে টুর্নামেন্টে সবচেয়ে বেশি রান এখনও তার।  

সিলেটেরই আরেক ব্যাটার জাকির হোসেন নিজের ব্যাপারে তৈরি হতে যাওয়া ভুল ভাঙিয়েছেন সাধারণের। টি-টোয়েন্টি দিয়েই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পথচলা শুরু হয়েছিল তার। তবে মাঝে বহুদিন ঘরোয়া লিগে নিয়মিত পারফর্ম করেও ছিলেন চোখের আড়ালে। ভারতের বিপক্ষে ক’দিন আগেই টেস্ট অভিষেক হয়েছে, চতুর্থ ইনিংসে সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে কেড়েছেন প্রশংসাও।  

‘টেস্ট ব্যাটার’ তকমা লাগার আগেই জাকির জানিয়েছেন নিজের সামর্থ্য। বিপিএলে এবার বড় শট খেলতে পারার প্রমাণ রেখেছেন। ১২ ম্যাচে ২৩২ রান করেছেন ১৩৭.২৭ স্ট্রাইক রেটে। এছাড়া লিটন দাস, মাহমুদুল হাসান জয়রাও আছেন সেরা রান সংগ্রাহকের তালিকায়। বিপিএলে ব্যাট হাতে দাপট ছিল দেশিদেরও। যদিও তিন সেঞ্চুরির সবগুলোই এসেছে পাকিস্তানিদের কাছ থেকে। উসমান খান, আজম খানের পর তিন অঙ্ক ছুঁয়েছিলেন ইফতেখার আহমেদ।

সব আলো কেড়েছিলেন সাকিব

বিপিএল শুরুর আগে বিতর্কের আগুন ছড়িয়ে দিয়েছিলেন সাকিব আল হাসান। ‘দায়িত্ব নিলে দুই মাসে সব বদলে দেবো’ এমন বলেছেন, সরব হয়েছিলেন টুর্নামেন্টের সমালোচনায়। শুরুর আগে সব আলো ছিল সাকিবের কাছে। মাঠেও শুরুর দিকে সাকিবই ছিলেন আলোতে।  

ব্যাট হাতে ‘ক্যারিয়ারের সেরা ফর্মে আছেন’ এমন মন্তব্যও এসেছিল তাকে নিয়ে। টি-টোয়েন্টির সঙ্গে মানানসই ব্যাটিং করেছেন। তার শটে মুগ্ধতা ছড়িয়েছে মিরপুর, চট্টগ্রাম, সিলেটে। এই অলরাউন্ডার ব্যাট হাতে ১২ ম্যাচের ১১ ইনিংসে ৩৭৫ রান করে টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। ইফতেখার আহমেদের সঙ্গে ফরচুন বরিশালের প্লে-অফে খেলার বড় কৃতিত্ব তার।  

মাশরাফি ম্যাজিকের সিলেট স্ট্রাইকার্স

‘বুড়ো হাড়ের ভেল্কি’ কিংবা অন্যকিছু। মাশরাফি বিন মুর্তজা এখনও ‘ম্যাজিক’ ভুলেননি; বিপিএল মনে করিয়েছে আরও একবার। টুর্নামেন্টের আগে কম আলোচনায় থাকা সিলেট স্ট্রাইকার্সকে তিনি চড়িয়েছেন সাফল্যের চূড়ায়। দলের ক্রিকেটাররা তার পেছনে বারবার কৃতিত্ব দিয়েছেন মাশরাফির নেতৃত্বকে। ভাই, বন্ধু হয়ে সেরা খেলা বের করতে পারার জাদু জানেন মাশরাফি; জানা ব্যাপার আবার এসেছে সামনে।

বল হাতে গতি কমে গেলেও মাশরাফি জায়গা বুঝে বল করে পেয়েছেন সাফল্যের দেখাও। এক ম্যাচ ইনজুরিতে খেলেননি। লিগ পর্বের শেষ ম্যাচে একাদশে থেকেও বল হাতে নেননি। এবারের বিপিএলে মাশরাফি তবুও নিয়েছেন ১২ উইকেট। দলের জন্য মাশরাফি কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ, সেটা অবশ্য পরিসংখ্যানে বোঝানো মুশকিল।  

বিপিএলকে নতুন স্বপ্ন দেখিয়েছে সিলেট

টুর্নামেন্ট নিয়ে সমালোচনার কমতি নেই এমনিতেই। চারপাশে নানা আলোচনা। তবুও বিপিএলকে নতুন স্বপ্ন দেখিয়েছে সিলেট। গ্যালারিতে স্বাগতিক সিলেট স্ট্রাইকার্সের সমর্থনে গোলাপি আভা দেখা গেছে, চিৎকার ছিল পুরো ম্যাচজুড়ে। বিপিএলে এমন পরিবেশ দেখা খুব একটা সহজ কথা নয়।  

শেষদিকে একটি ম্যাচ দেখতে গিয়েছিলেন বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন। তিনি বোধ হয় এই কথাটাই সবচেয়ে বেশি শুনেছেন ‘সিলেটে আরও বেশি ম্যাচ চাই’। প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছেন তিনি। গ্যালারি ভর্তি দর্শক, তাদের সমর্থন, টিকিটের জন্য হাহাকার; এসব দেখিয়েছে বিপিএলের আবেদনও। বিসিবি চাইলে যে বাজারটা বড় করতে পারে, জানিয়েছে সেই সম্ভাবনার কথাও।  

নাসিরের পুনরুত্থানেও হতাশা ঢাকার

প্রাদপ্রদীপের আড়ালে চলে যাওয়া নাসির এবারের বিপিএলে খুঁজে পেয়েছেন আলোর দেখা। ব্যাট-বল-ফিল্ডিং সব জায়গায় ভালো করেছেন। যদিও সেসব দলে অবদান রাখতে পারেনি খুব একটা। এই অলরাউন্ডারের নেতৃত্বে ঢাকা ডমিনেটর্স বিপিএলে ৩ ম্যাচ জিতে শেষ করেছে ছয় নম্বর হয়ে। ব্যাট হাতে ১২ ম্যাচে ৩৭৪ রান করেছেন। বল হাতে ১৬ উইকেট নিয়ে লিগ পর্বের সেরা বোলার তিনি।  

প্লে অফ থেকে বাদ পড়েছে আরও দুটি দল। চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্স পুরো টুর্নামেন্টজুড়ে ভুগেছে ধারাবাহিক পারফরম্যান্সের অভাবে, তারা হয়েছে সপ্তম। মোটামুটি ভারসম্যপূর্ণ দল নিয়েও ভালো করতে পারেনি খুলনা টাইগার্স। ইয়াসির আলির নেতৃত্বে দলটি খুঁজে পায়নি কম্বিনেশন। ১২ ম্যাচে তিনটিতে জিতেছে তারা।  

বোলিংয়ের ‘তারা’ যারা

বল হাতে গতির ঝলক দেখিয়েছেন অনেকেই, তাদের মধ্যে তরুণই বেশি। হাসান মাহমুদ ডেথ বোলিংয়ে কার্যকরী ছিলেন, ১২ ম্যাচে ১৫ উইকেট নিয়ে টুর্নামেন্টের তৃতীয় সর্বোচ্চ উইকেট তার। পেসারদের মধ্যে ভালো করেছেন সিলেটের রেজাউর রহমান রাজাও, ৮ ম্যাচে তার উইকেট ১৩টি।

রবিউল হক, মুকিদুল ইসলাম মুগ্ধরাও আলোয় এসেছেন মাঝে। টুর্নামেন্টের একমাত্র বোলার হিসেবে পাঁচ উইকেট আছে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের মুগ্ধর। তার সতীর্থ স্পিনার তানভীর ইসলামও পারফর্ম করেছেন ধারাবাহিকভাবে। ১০ ম্যাচে ১৪ উইকেট নেওয়া এই স্পিনার ওভার প্রতি রান দিয়েছেন ৬.২০ গড়ে। দলের বিপর্যয়েও আলো কেড়েছেন চট্টগ্রামের স্পিনার নিহাদুজ্জামানও।  

বাংলাদেশ সময়: ১৯৪৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১১, ২০২৩
এমএইচবি/এমএইচএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।