কিন্তু এত বড় সফলতাও যেন ঢাকা পড়ে গেছে স্রেফ একটা মানুষের সঙ্গে তার ‘রক্তের সম্পর্ক’ পরিচয়ের আড়ালে। বছর ২১ এর তরুণ যে সম্পর্কে বিখ্যাত পাকিস্তানি লিজেন্ড ইনজামাম উল হকের ভাতিজা।
হংকংকে উড়িয়ে মাঠ থেকে বের হলেন সবে। এমন সময় ধরা হলো তাকে। দীর্ঘক্ষণ ব্যাটিংয়ের পর আবার ফিল্ডিং, হয়তো ক্লান্তিতে ডুবে থাকবেন-ইনজি ভাতিজা। এমন ভাবনায় জল ঢেলে দিয়ে ইমাম উল হক কথা বললেন তার ব্যাটিংয়ের মতোই। কোনো রাগঢাক না রেখেই জানিয়ে দিলেন নিজের পৃথিবীর ‘সবকিছুই’।
পাকিস্তান ক্রিকেটারের সর্বোচ্চ আবেগের স্থান-ইনজির ঘরে জন্ম হয়েও একটা সময় ক্রিকেটকে ‘ঘৃণা’ করতেন ইমামুল হক। রোদে ত্বক পুড়িয়ে ক্রিকেট খেলা-না সম্ভব না। পছন্দের তালিকায় এক নম্বরে ছিল মডেলিং। সময় পেলে ডুবে থাকতেন ব্যাটমিন্টনেও। সেই খেলায় স্কুল চ্যাম্পিয়নও ছিলেন তিনি। কিন্তু ইনজামামের নিঃশ্বাস যার গায়ে লেগেছে-সে কি ক্রিকেটার না হয়ে পারে?
ক্রিকেটে আসার আরও একটা মজার কারণ আছে ইমামের। স্কুল জীবনে বেশ ‘ইনজামামময়’ ছিলেন। মানে প্রিয় চাচার শরীরটাও পেয়েছিলেন। তাই কোনো একদিন শুনলেন নিয়মিত ক্রিকেট খেললে মুটো হওয়া থেকে বাঁচা যাবে। তারপর ক্রিকেটে আসা, ক্রিকেটেই থাকা।
শুরুতেই মডেলিংয়ের বিষয়টি মনে করিয়ে দিতেই একগাল হেসে উত্তর দিলেন এভাবে. ‘মডেল হওয়াটা ছিল স্কুল জীবনের ইচ্ছে। এখন মনে হয় না কোনো পরিচালক আমাকে তার ছবির জন্য ডাকবেন। কারণ আমি যে এখন পুরোদস্তুর ক্রিকেটার। ’
ইনজামামের ভাতিজা হওয়ার যেমন লাভ আছে, তেমনি তার উল্টো পৃথিবীটাও দেখা হয়ে গেছে তার।
‘আমার চাচ্চু এখন প্রধান নির্বাচক। এটাই আমার জন্য বড় একটা চাপ। মিডিয়া সবসময় সমালোচনা করে লিখে, চাচার জন্যই দলে। আরও কত কী?-বেশ উত্তপ্ত শোনা গেল ইমামুল হকের গলা।
‘তবে চাচ্চু আমাকে বলেন এসবে মাথা না ঘামাতে। তিনি আমাকে সবসময় সাপোর্ট দেন। বলেন তুমি তোমার মতো করে ক্রিকেট এনজয় করো। তোমার পাশে আমি আছি। ’-এবার কিছুটা শান্ত ইমামুল হক।
ক্রিকেট বিষয়ে যে কোনো সংকটে চাচা ইনজামামই তার সর্বোচ্চ শিক্ষক। বাংলাদেশে আসার আগেও চাচার পরামর্শ সঙ্গে নিয়ে এসেছেন ইমামুল হক।
ইমার্জিং টিমস এশিয়া কাপে খেলতে আসার আগে আমি চাচ্চুকে ফোন দিই। তিনি বলেন, ‘গুড লাক। সহজভাবে খেলো। ভালো ইনিংস খেলতে গেলে তোমাকে সহজভাবেই খেলতে হবে। ’
ইমামের উত্থান মূলত ২০১৪ এর অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে। সেই বিশ্বকাপের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান ছিল তার। তারপর থেকে ঘরোয়া লীগের নিয়মিত পারফরমার ইমামুল হক।
তাই তার পরবর্তী স্টেশন যে পাকিস্তান জাতীয় দল তা তো বলাই যায়।
তার মুখ থেকে শুনতে চাইলে বলেন, ‘পাকিস্তান জাতীয় দলের হয়ে খেলা আমার স্বপ্ন। সুযোগ পেলে পারফরম্যান্স করে টিকে থাকতে চাই অনেকদিন। ’
ইনজামামের ভাতিজা তা জানা ছিল। কিন্তু সরাসরি না ঘুরিয়ে-পেছিয়ে ভাতিজা তা নিয়ে কিছুটা সন্দেহ ছিল্ই। সেই সন্দেহটা আবচা আবচা করে তুলতে যেতেই, ‘ইনজামাম মেরি রিয়েল চাচ্চু হে। আমার বাবা ইনসারাম উল হকের ছোট ভাই তিনি। ’
এখন ক্রিকেটে ব্যস্ত বলে পড়ালেখাকে তেমন সময় দেওয়া হয় না ইমামুল হকের। কিন্তু তা নিয়ে প্রচণ্ড আক্ষেপ দেখা গেল তার গলায়।
আমার জন্ম মুলতানে। তবে আমরা পাঁচ ভাই বোনের ভালো পড়াশোনার জন্য বাবা-মাসহ লাহোরে চলে যাই। আমি সেখানেই বড় হই, ও লেভেল পাস করি। আমি কিন্তু খুব ভালো স্টুডেন্ট ছিলাম। কিন্তু এখন ক্রিকেটের ব্যস্ত সূচির কারণে পড়ালেখা করা হয়ে উঠছে না। তবে সুযোগ পেলেই আমি পড়ালেখাটা এগিয়ে নিয়ে যাবো। ’
ইনজামামের পাশাপাশি এতদূর আসার পেছনে বাবা-মাকেও সমান কৃতিত্ব দিলেন ইমাম।
‘আমার মা ক্রিকেট খুব ভালোবাসেন। আমি যখন ছোটকালে প্র্যাকটিসে আসতাম, মা পড়ে থাকতেন মাঠের পাশে। দূর থেকে দেখতেন আমার ব্যাটিং অনুশীলন। ’ বলে যান ইমাম।
বিখ্যাত চাচ্চুর ভাতিজা হয়েও তার সঙ্গে অনেক বৈসাদৃশ্য ইমামের।
ইনজামাম ব্যাট করতেন ডান হাতে, সেখানে ইমাম বাঁহাতি। ইনজামামের ‘চিরঠিকানা’ ছিল মিডল অর্ডার, ইমামের ভূমিকা সেখানে ওপেনার ব্যাটসম্যান। ইনজামাম মানে শান্ত-নরম মানুষ। ইমামের ভাষায় তিনি, ‘ভীষণ দুষ্টু’।
আর এতক্ষণ ধরে যারা ইমামের আইডলের নাম ইনজামাম ভেবে বসে আছেন তাদের জন্য, ইমামের বক্তব্যটা তুলে দেওয়া যাক।
সাদা চশমা পরা, দেখতে এমনিতেই দার্শনিকের মতো ইনজি ভাতিজা। সেই চশমার ফাঁক থেকে ঠিক দার্শনিকের মতো করেই বললেন, ‘আমার ক্রিকেট আদর্শের নাম ইউনিস খান, ইনজামাম নন। কারণ ক্রিকেটে ইনজামাম জন্মগত প্রতিভা। ইউনিস খান তা নন। তিনি এতদূর এসেছেন তার পরিশ্রম-একাগ্রতার বলে। তিনি পাকিস্তানের হয়ে দিনের পর দিন রান করে যাচ্ছেন। তার দায়িত্ব, প্যাশন তাকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করেছে। এটা আমাকে ভীষণভাবে টানে। ’
পরবর্তী ইনজামাম কি আপনি এমন প্রশ্নে হাসলেন। তারপর হাসি থামিয়ে বললেন ‘উনি একজন লিজেন্ড। আমি সেখানে মাত্রই শুরু করেছি। আমি ইনজামাম হতে চাই না। আমি ইনজামামের ২০ শতাংশ হলেই খুশি। ’
বাংলাদেশ সময়: ২০৫০ ঘণ্টা, মার্চ ২৯, ২০১৭
টিএইচ/টিসি