মিরপুরে খেলা না থাকলে সময় কাটানো ভীষণ মুশকিল। এমনিতেই মেট্টোরেল নির্মানের কল্যাণে জ্যাম, ধুলোবালি আর শব্দের তীব্রতা চরম আকার ধারণ করেছে; সঙ্গে ভ্যাপসা গরম তো আছেই।
সবসময় যে খবর মেলে, ব্যাপারটা তেমনও না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডায় মেতে থেকে খবরের অপেক্ষা করতে হয়। তেমনই এক আড্ডায় এক সাংবাদিক জানতে চাইলেন, ‘বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ক্ষতি কী জানো?’ পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কৌতূহলী অনুজ সাংবাদিকের উদ্দেশ্যেই ছিল প্রশ্নটা।
খানিক বাদে তিনি নিজেই বললেন, ‘পরিণত সাকিবকে অধিনায়ক হিসেবে না পেয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেট পাঁচ বছর পিছিয়ে গেছে। ’ ব্যাপারটা সত্যি কি না, এ নিয়ে চাইলে তর্ক হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের টেস্ট সংস্কৃতিকে এক ধাপ উপরে নিয়ে যেতে পারেন কে? এমন প্রশ্নের উত্তরে সাকিব না বলাটা এক রকমের অনুচিত কাজই হয়ে যাবে।
ক্ষুরধার ক্রিকেট মস্তিস্কের স্বীকৃতি সাকিব বহুজনের কাছ থেকে পেয়েছেন, পারফরম্যান্সও সবসময় প্রশ্নাতীত- সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে বড় ব্যাপার যেটা যোগ হয়েছে, তাকে আইডল হিসেবে মানছেন দলের তরুণরা। নেতৃত্বের গুণাবলী সাকিবের কেমন? সেটা তরুণদের আড্ডায় কিংবা কথায়ও প্রমাণ মিলেছে বহুবার।
এর আগেও দুইবার অধিনায়কত্ব পেয়েছেন। তবে প্রথমবার বয়স ছিল ২২ বছর। দ্বিতীয়বার নিষেধাজ্ঞায় নেতৃত্ব পর্ব শেষ হয়েছে বছর খানেকের মধ্যে। সব মিলিয়ে সাকিব পূর্ণতা দিতে পারেননি অধিনায়কত্বকে। ১৬ জুন অ্যান্টিগায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে তৃতীয় দফায় একই মিশন শুরু করবেন তিনি।
দলটির বিপক্ষে অবশ্য সাকিবের নাম জড়িয়ে বেশ ভালোভাবে। আগের দুই দফায় নেতৃত্বের শুরু করেছিলেন তাদের বিপক্ষে- এবারও তাই। ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স? সাকিবের প্রিয় প্রতিপক্ষই বলা চলে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে। সবচেয়ে বেশি টেস্ট তিনি খেলেছেন তাদের বিপক্ষে।
সাকিবের টেস্ট ক্যারিয়ারের ৪ হাজার ১১৩ রানের ৮১৩-ই এসেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। রান করেছেন ৪৫.১৬ গড়ে। ক্যারিবীয়নদের বিপক্ষে বল হাতে সবচেয়ে উজ্জ্বল সাকিব, ৪৬ উইকেট নেওয়ার পথে তিনবার নিয়েছেন ইনিংসে পাঁচ উইকেট।
সাকিব তো বটেই, বাংলাদেশের জন্যও ওয়েস্ট ইন্ডিজ হারানোর জন্য ‘তুলনামূলক সহজ’ প্রতিপক্ষ। ১৮ ম্যাচের ১২টিতে হারলেও ৪টিতে জিতেছে বাংলাদেশ; সবগুলো ম্যাচেই ছিলেন সাকিব। ২০০৯ সালে এই দলের বিপক্ষে জিতেই প্রথমবারের মতো বিদেশের মাটিতে সিরিজ জেতার স্বাদ পেয়েছিল বাংলাদেশ।
এসব পরিসংখ্যান এক পাশে সরিয়ে রাখলেও এই সিরিজটি বাংলাদেশের জন্য ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। সাকিবই যেমন সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘সবাইকে ভুল প্রমাণের’ মঞ্চ। তিনি স্বীকারও করেছেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে টেস্টে ভালো যাচ্ছে না’ বাংলাদেশের।
মুমিনুল হক সমালোচনা খাদের কিনারায় চলে গিয়েছিলেন। ‘ব্যাটিংয়ে মনোযোগ দিতে’ ছেড়েছেন নেতৃত্ব। এরপর অধিনায়ক কে হবেন? প্রশ্নের জবাব খুঁজতে বেশি দূরে যেতে হয়নি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডকে। লিটন দাসকে সঙ্গী করে সাকিবকে অধিনায়কত্বের ভারটা তুলে দেওয়া হয়েছে।
তার নেতৃত্বে এর আগে ১৪ ম্যাচে খেলেছে বাংলাদেশ। ১১ হারের বিপরীতে এসেছে কেবল ৩ জয়। পরিসংখ্যান দেখে ভ্রু কুঁচকানোর উপায় নেই। সাকিব কোনোবারই পুরোপুরি সামলে উঠতে পারেননি সব। এখন কি পারবেন? এই প্রশ্ন বরং সময়ের হাতে তোলা থাকুক।
বয়স ৩৫ হয়ে গেছে। তবুও এখনও তিনি দলের সেরা পারফরমার, তরুণদের জন্য আদর্শ। সাকিবের ব্যক্তিত্ব দেশের ক্রিকেটে অন্য উচ্চতায়। অন্য একজন কিংবা তরুণ কারো হাতে অধিনায়কত্ব নিশ্চয়ই তুলে দেওয়া যেত- তাতে হয়তো জয়ও আসতো- কে জানে সাকিব আল হাসানের চেয়েও বেশিও হতে পারতো সেটি!
কিন্তু টেস্ট পাঁচদিনের ম্যাচ। ধৈর্য, সংযম, নিবেদন ও লড়াইয়ের মন্ত্র নিয়ে টিকে থাকতে হয় এখানে। হাল ছেড়ে দিলে সব শেষ হয়ে যায়। ম্যাচের মতো এই ফরম্যাটে সাফল্য পাওয়ার পথটাও ভীষণ লম্বা। ঘরোয়া ক্রিকেট, বোর্ড, দর্শক, সংবাদ মাধ্যম- সব মিলিয়ে দেশের সংস্কৃতির একটা ব্যাপার।
সাকিব সেটা বদলে ফেলতে পারবেন কি না? পুরোপুরি সম্ভব না। তাহলে কেন? কারণ যদি কেউ বদলে ফেলতে পারেন এই মুহূর্তে, তার নামটা সাকিব আল হাসান। ওয়েস্ট ইন্ডিজে দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজের ফল কী হবে? তা নিয়ে মাথাব্যথা না করাটাই বোধ হয় বুদ্ধিমানের কাজ। রোমাঞ্চ নিয়ে বরং সাকিব টেস্ট সংস্কৃতিতে কী বদল আনছেন- তার অপেক্ষা করা যায়!
ওয়েস্ট ইন্ডিজে ম্যাচগুলো বাংলাদেশ সময় রাতে- ভোরের আলো ফুটলে হয়তো কোনো ফল আসবে। দেশের ক্রিকেট নিশ্চয়ই এক-দুইটা জয়ের চেয়ে সাকিবের আলোয় নতুন ভোর হওয়ার স্বপ্নটাই বেশি করে দেখছে!
বাংলাদেশ সময় : ০৮৫০, জুন ১৬, ২০২২
এমএইচবি