আতাপাত্তু মুদিয়ানসেলাগে চামারি জায়ানগানি কুমাই আতাপাত্তু বা চামারি আতাপাত্তু। শ্রীলঙ্কার নারী ক্রিকেটে মহীরুহ তিনি।
নারী এশিয়া কাপ খেলতে আতাপাত্তু এখন সিলেটে। তার নেতৃত্বে এশিয়া কাপের ফাইনালেও পৌঁছে গেছে লঙ্কান মেয়েরা, শিরোপা জয়ে তাদের বাধা কেবল ভারত। টুর্নামেন্টের মাঝপথে টিম হোটেলের লবিতে বসে তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বাংলানিউজের স্টাফ করেসপন্ডেন্ট মাহমুদুল হাসান বাপ্পি।
বাংলানিউজ: ক্রিকেটার হওয়ার যাত্রা কীভাবে শুরু হলো?
আতাপাত্তু: তখন বয়স মাত্র ৫ বছর। শুরুটা হয়েছিল চাচার কারণে। উনি ক্রিকেট খেলতেন, কোচিংও করাতেন। আমার প্রথম কোচও চাচাই ছিলেন।
বাংলানিউজ: এরপর?
আতাপাত্তু: ১৯৯৬ সালে শ্রীলঙ্কা বিশ্বকাপ জিতল, খেলাটার প্রেমে পড়ে গেলাম। মনে হলো আমাকেও পেশাদার ক্রিকেটার হতে হবে। ওই বিশ্বকাপ, তখনকার ক্রিকেটাররা আমাকে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। আমার বয়স ৬ বছর। খেলাটা হয়েছিল দিবা-রাত্রি। তবুও আমি জেগে থেকে দেখেছিলাম।
মনে আছে, পুরো ম্যাচ দেখেছি। জেতার পর রাস্তায় নেমে উৎসবও করেছি। আমার প্রিয় ক্রিকেটার ছিল সনাথ জয়াসুরিয়া, আমার নায়ক। উনি ওই বিশ্বকাপে খেলেছিল। আমি তখন শুধু সনাথের জন্যই ক্রিকেট পছন্দ করতাম।
বাংলানিউজ: আপনি যখন ক্রিকেট শুরু করলেন মেয়েদের ক্রিকেট তত প্রতিষ্ঠিত ছিল না। নিজের জীবন বা ক্যারিয়ার নিয়ে ভয় কাজ করেনি শুরুতে?
আতাপাত্তু: কিছুটা তো ছিলই। যখন শুরু করেছি তখন তো মেয়েদের ক্রিকেট এত প্রতিষ্ঠিত না। কিন্তু ক্রিকেট পেশা হিসেবেই নিয়েছি, ছোটবেলায়ও ক্রিকেটারই হতে চেয়েছি। এ নিয়ে কোন সংশয় ছিল না। ১৯৯৭ সালে জানতে পারি শ্রীলঙ্কায় মেয়েদের ক্রিকেট শুরু হচ্ছে, ভারতে তারা প্রথম বিশ্বকাপ খেলে।
এরপর আমার আঙ্কেল আসেন আর আমাকে জানায় এই কথায়। উনি বলেন, যদি তুমি ভালো করতে পারো তাহলে একদিন জাতীয় দলের জার্সি গায়ে দিতে পারবে। এরপর ওই স্বপ্নের পেছনে ছুঁটেছি।
২০০৯ সালে ক্রিকেটের শুরু করি। এর আগে স্কুল ক্রিকেট খেলেছি। ২০০৮ এ প্রথম ঘরোয়া লিগে খেলি আর ওই বছরই জাতীয় দলে ডাক পাই। অবশেষে ২০০৯ সালে এসে প্রথম ওয়ানডে খেলতে পারি। এখনও শ্রীলঙ্কার হয়ে খেলে যাচ্ছি...।
বাংলানিউজ: শুরুর দিকে নাকি ছেলেদের সঙ্গে খেলতেন...কঠিন ছিল না?
আতাপাত্তু: হ্যাঁ, ছেলেদের সঙ্গে খেলতাম। কিন্তু কঠিন কিছু ছিল না। কারণ আমার স্কিল, সম্ভাবনা ওদের মতোই ছিল। কখনো তাদের বিপক্ষে জিততাম, মাঝেমধ্যে তারা জিতত। ওরা আবার বলতো, তুমি প্রথমে ব্যাট করতে পারবে না; কারণ আমাকে তারা আউট করতে পারতো না... (হাসি)
বাংলানিউজ: সনাথ জয়াসুরিয়া আপনার অনুপ্রেরণা, তাকে প্রথম দেখার কথা মনে আছে?
আতাপাত্তু: উনাকে প্রথম দেখেছিলাম জাতীয় দলে আসার পর। আমি একটা নেটে ব্যাট করছিলাম, সনাথ ভাই অন্যটিতে। এরপর কোচকে বললাম, ‘আমি উনার সঙ্গে একটা ছবি তুলতে চাই...’। কোচ আমাকে বললো, ‘যাও, গিয়ে তুলো...’
কিন্তু আমার ওই সাহস ছিল না। কোচকে বললাম, ‘আমি পারবো না, উনার সঙ্গে কথা বলতে ভয় করছে; আপনার আমাকে সাহায্য করতে হবে। ’ কোচ এরপর গিয়ে সনাথ ভাইকে বলেছিল, ‘এই মেয়েটা আপনার সঙ্গে একটা ছবি তুলতে চায়, আজকে আবার তার জন্মদিনও...’
সনাথ ভাই এরপর বললো, ‘এসো, এসো...ছবি তুলো। আমাকে কি তোমার জন্মদিনের এক পিস কেক দিতে পারবে?’ আমি বললাম ঠিক আছে, তারপর উনাকে কেক দিলাম। সনাথ ভাই আমাকে ব্যাট, গ্লাভস আর প্যাড দিয়েছিল; এসব স্মৃতি এখনও আমার কেবিনে জমা করা আছে...
বাংলানিউজ: ক্রিকেটের বাইরে আপনার অন্য কিছুর জন্য সময় হয়?
আতাপাত্তু: আমি পেশাদার ক্রিকেটার। তবে একটা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির হয়ে কাজ করি। তারা আমাকে ছাড় দেয় খেলার জন্য। ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি অনেক সাহায্য করে এসব ব্যাপারে।
বাংলানিউজ: শ্রীলঙ্কার মতো একটা দেশে, যেখানে ক্রীড়া তারকার অভাব নেই। আপনি ‘স্পোর্টস পার্সোনালাটি অব দ্য ইয়ার’ হয়েছিলেন একবার...
আতাপাত্তু: ২০১৮ সালে বছরের সেরা ক্রিকেটার হই। ওই সময় অনেক ছেলে ভালো খেলছিল, কয়েকজন মেয়েও। তাদের ছাপিয়ে আমি সেরা হই। এটার অনুভূতি অন্যরকম। মেয়ে হয়েও ছেলে ক্রিকেটারদের টপকে সেরা হয়েছি, এটা তো অন্যরকম ভালো লাগবেই!
বাংলানিউজ: আপনি তো পুরো বিশ্ব ঘুরে ঘুরে ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট খেলেছেন। বড় ম্যাচে পারফর্ম করেছেন। অনেক অভিজ্ঞতাও। আপনার কী মনে হয় মেয়েদের ক্রিকেটে কয়েকটা দল বেশিই এগিয়ে?
আতাপাত্তু: আমরা সবাই জানি ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও নিউজিল্যান্ড পৃথিবীর সেরা দল। তাদের প্রতিভা আছে, ঘরোয়া কাঠামোও। এজন্যই তারা সেরা হতে পেরেছে। আমি আশা করি দুই-তিন বছর পর আরও কয়েকটা দল এই লেভেলে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করতে পারবে।
কারণ অন্য দলগুলো নিজেদের ঘরোয়া কাঠামো পুনর্গঠন করার চেষ্টা করছে। শ্রীলঙ্কাও সেটা করছে। আশা করি দুই তিন-বছরের মধ্যে আমরাও সেরা দলগুলোর কাতারে যেতে পারবো।
বাংলানিউজ: আপনি তো আইপিএলে খেলেছেন, অভিজ্ঞতা কেমন?
আতাপাত্তু: খুব ভালো অভিজ্ঞতা আমার জন্য। সিপিএল, আইপিএল, বিবিএল, ইংল্যান্ড লিগসহ পৃথিবীর নানা জায়গায় ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট খেলেছি। আমার অভিজ্ঞতা মেয়েদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে পারি এসব টুর্নামেন্টে। দেশে এসে আমাদের ক্রিকেটারদের বলি কী হলো, বাইরের মেয়েরাও আমার কাছে জানতে চায়।
অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ইংল্যান্ডের মেয়েদের সঙ্গে ড্রেসিং রুম ভাগ করতে পারা- সবাই আলাদা দেশের, ভিন্ন সংস্কৃতির। এটা মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতেও সাহায্য করে। অর্থনৈতিকভাবেও ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট খেলা আমার জন্য লাভজনক। ২০১৭ সালের বিশ্বকাপে ১৭৮ রান করেছিলাম, এরপর থেকেই সুযোগগুলো আসছে।
বাংলানিউজ: ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট কি মেয়েদের খেলাকে আরও ছড়িয়ে দিতে পারে?
আতাপাত্তু: অবশ্যই। আগামী বছর থেকে মেয়েদের আইপিএল আরও বড় হচ্ছে। ম্যাচ বাড়ছে, দলের সংখ্যাও। মেয়েদের জন্য অনেক বড় সুযোগ। বিগ ব্যাশ আগে থেকেই হচ্ছে, সিপিএল আছে, পিএসএলও হতে পারে। পুরো বিশ্বের মেয়েদের ক্রিকেটকেই এগিয়ে নেবে এসব। কারণ যখন তারা অর্থনৈতিকভাবে আরও লাভবান হবে, এমনিতেই আগ্রহ বাড়বে ক্রিকেটে।
বাংলানিউজ: এই দলে তো এমন অনেকে আছে, যারা ক্রিকেট শুরুই করেছে আপনাকে দেখে। এখন একই ড্রেসিং রুমে। এদের সঙ্গে সম্পর্ক কীভাবে রাখেন?
আতাপাত্তু: অনেক তরুণীরা এখন জাতীয় দলে এসেছে। তাদের সঙ্গে নিজের জ্ঞান ভাগ করি, তাদের শেখাই, অভিজ্ঞতা বলি, চেষ্টা করি নম্রতা দেখাতে। ক্যারিয়ার কিংবা জীবন, তারা যেন বাধা ছাড়া এগিয়ে যেতে পারে সেদিকে খেয়াল রাখি।
তারা আমার কাছে আসে- ব্যক্তিগত বা পেশাদার যেকোনো ইস্যুই হোক। সবকিছু অবলীলায় বলতে পারে। আমিও বড় বোন হিসেবে তাদের দিকে তাকাই। অভিজ্ঞ ক্রিকেটার হিসেবে অথবা অধিনায়ক, সবসময়ই তাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছি।
বাংলানিউজ: দীর্ঘদিন জাতীয় দলের অধিনায়কত্ব করেছেন। আপনার নেতৃত্বের ধরণ ঠিক কেমন?
আতাপাত্তু: প্রথমবার যখন অধিনায়কত্ব পাই, ২৩ বছর বয়স ছিল। ২০১৪ সালের পর আরও দুই দফায় অধিনায়কত্ব করেছি। অনেক কিছু শিখতে হয়েছে প্রথমবার নেতৃত্ব পাওয়ার পর। তখন অভিজ্ঞতা ছিল না, কারণ ২৩ বছরের মেয়ে ছিলাম ওই সময়।
এখন আমার অভিজ্ঞতা অনেক। কারণ পৃথিবী ঘুরে ক্রিকেট খেলেছি। আমার মনে হয় অধিনায়কত্বের জন্য, নেতৃত্বের ভার নিয়ে পারফর্ম করতে, সামনে থেকে দলকে এগিয়ে নিতে; এটাই সঠিক সময়।
বাংলানিউজ: ড্রেসিং রুমের পরিস্থিতি ঠিক রাখতে কী করেন?
আতাপাত্তু: সবসময় ইতিবাচকতা ছড়িয়ে দিতে চাই। কোন ক্রিকেটার ড্রেসিং রুমে নেতিবাচক কথা বলবে, এটা হতে দেই না। জিতলে তো ভালোই, হেরে গেলেও নেতিবাচকতা নেই না। আমি সবসময় ইতিবাচক থাকতে চাই। মেয়েরা ভালো ক্রিকেট খেলুক অথবা খারাপ, তাদের সাহস যোগাই। সবসময় এই একই কাজ করি।
বাংলানিউজ: অল্প বয়সেই তারকা খ্যাতি পেয়ে গিয়েছিলেন। ২৩ বছর বয়সে অধিনায়ক। পেছন ফিরে তাকালে ওই চামারিকে কীভাবে দেখেন?
আতাপাত্তু: একটু কঠিন ছিল ওই সময়টা। দলে অনেক সিনিয়র ছিল, তাদের সামলানো সহজ না। আমার পুরো ক্যারিয়ার ছিল, সেটাকে গড়ে তুলতে হতো। ২৩ বছর বয়সে অধিনায়ক হই, দুই বছর পর নেতৃত্বে ছেড়ে আবার শুধু ক্রিকেটার হয়ে গেছি। অধিনায়কত্ব আসলে কোনো ব্যাপার না। আমি দেশের হয়ে ভালো খেলতে চাই। এটাই আসল ব্যাপার।
বাংলানিউজ: শ্রীলঙ্কার হয়ে আপনার সাতটা সেঞ্চুরি। আর কারো একটাও নেই। এটা ভাবলে কেমন লাগে?
আতাপাত্তু: হ্যাঁ, ওয়ানডেতে ছয় আর টি-টোয়েন্টিতে একটা সেঞ্চুরি আমার। কিন্তু আর কারো নেই ভাবলে একদমই ভালো লাগে না। আমি মেয়েদের বড় ইনিংস খেলতে উদ্বুদ্ধ করি। এই এশিয়া কাপে হারশিতা ৮৩ করেছে, দেখে ভালো লেগেছে।
বাংলানিউজ: অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেই তো আপনার তিনটা সেঞ্চুরি...
আতাপাত্তু: হ্যাঁ, তাদের বিপক্ষে তিনটা সেঞ্চুরি আছে। বিশ্বকাপে ১৭৮ রান করেছি, প্রথম টি-টোয়েন্টি সেঞ্চুরিও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ছিল। আমি তাদের বিপক্ষে খেলতে ভালোবাসি। সবাই জানে অস্ট্রেলিয়া সেরা দল, তাদের বিপক্ষে ভালো করার আনন্দ অন্যরকম।
বাংলানিউজ: অপরাজিত ১৭৮ রানের ওই ইনিংসটা নিয়ে একটু বিস্তারিত বলবেন, এটা তো মেয়েদের ক্রিকেট ইতিহাসেরই সেরা ইনিংসগুলোর একটা। আমি আসলে জানতে চাচ্ছি মনের ভেতর কী চলছিল বা এমন...
আতাপাত্তু: শুরুতে কিছুটা ধীরস্থিরভাবেই খেলছিলাম। কারণ প্রথম দিকেই আমরা কয়েকটা উইকেট হারিয়ে ফেলেছিলাম। এজন্য একটু ধীরে খেলতে হচ্ছিল। এরপর একটা সময় অনুভব করলাম, এখন ঠিক আছে, আমি বিগ শট খেলতে পারি। যখন এটা মনে হলো, এরপর থেকে বাউন্ডারি মারা শুরু করলাম। সতীর্থ, কোচরাও সমর্থন দিচ্ছিল।
অনেকে ভাবে অস্ট্রেলিয়া বড় দল, আমরা তাদের সঙ্গে লড়াই করতে পারবো না। কিন্তু আমি বলতাম, দেখো, তারা ভালো দল তবে আমাদেরও সামর্থ্য আছে তাদের খেলার। অস্ট্রেলিয়া দল হিসেবে দারুণ, অনেক অভিজ্ঞ বোলার তাদের আছে কিন্তু আমি পারবো; করেও দেখিয়েছি। যদি কেউ বলে এটা পারবে না, আমি করে দেখাতে চেষ্টা করি।
বাংলানিউজ: খেলা হিসেবে ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ কেমন দেখেন?
আতাপাত্তু: আমার মনে হয় এই সময়টা ক্রিকেটের জন্য খুব নিরাপদ। শ্রীলঙ্কাতেই দেখুন, অনেক মেয়ে আমাকে দেখে ক্রিকেটে এসেছে। আমি তাদের উদ্বুদ্ধ করি, সাহস যোগাই, অনুপ্রাণিত করি। এখন ক্রিকেট নিরাপদ। যখন আমি ক্রিকেট শুরু করি, তখন অর্থনৈতিকভাবেও তেমন লাভজনক ছিল না খেলা। এখন ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট আছে, বোর্ডও অনেক টাকা দিচ্ছে।
বাংলানিউজ: জীবনের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন?
আতাপাত্তু: আমি নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে খুশি, তেমন বড় চাওয়া নেই। আরও কয়েক বছর ঠিকঠাক খেলতে চাই। ভালো ক্রিকেটার হতে চাই। এরপর কোচ হওয়ার ইচ্ছে আছে।
বাংলাদেশ সময়: ১২২১ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৪, ২০২২
এমএইচবি/আরইউ