ঢাকা, মঙ্গলবার, ২০ কার্তিক ১৪৩১, ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

চমেক হাসপাতালে বেপরোয়া ওষুধ পাচার চক্র

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৩২ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৩, ২০২৩
চমেক হাসপাতালে বেপরোয়া ওষুধ পাচার চক্র ...

চট্টগ্রাম: চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা সামগ্রীসহ ৬৯ ধরনের সরকারি ওষুধ বাইরে পাচার হচ্ছে। এই পাচার চক্রে আছেন হাসপাতালের কতিপয় কর্মকর্তা থেকে শুরু করে নার্স, ট্রলিম্যান, ওয়ার্ডবয়, চুক্তিভিত্তিক ওয়ার্ডবয়, ফার্মাসিস্ট, পরিচ্ছন্নতা কর্মী।

 

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর অভিযানে প্রায়ই এই চক্রের সদস্যরা আটক হলেও থেমে নেই তাদের কার্যক্রম। দালালদের হাত ঘুরে এসব ওষুধ চলে যাচ্ছে বিভিন্ন ফার্মেসীতে।

কোটি টাকার ওষুধ বরাদ্দ থাকলেও পায় না রোগীরা। ফলে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীকে চড়া মূল্যে বাইরের ফার্মেসী থেকে কিনতে হচ্ছে ওষুধ।

স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট বিশ্ব ব্যাংকের সহযোগিতায় ‘নিজ পকেট থেকে গৃহস্থালি ব্যয় সংকোচনের কৌশল’ শীর্ষক টেকনিক্যাল রিপোর্টে উল্লেখ করেছে, সরকারি হাসপাতাল থেকে মাত্র ৩ শতাংশ রোগী ওষুধ পান এবং ১৪ দশমিক ৯ শতাংশ রোগীর পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়। অধিকাংশ রোগীকে বেসরকারি ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনতে হয় এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে সেবা নিতে হয়। এতে রোগীর নিজ পকেট থেকে ব্যয় বেড়ে যায় এবং প্রায়ই রোগী আর্থিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হন।

চমেক হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ১৯৬০ সালে ৫০০ শয্যা নিয়ে যাত্রা শুরু করা এই হাসপাতালটি বর্তমানে ১৩১৩ শয্যাবিশিষ্ট। শয্যার তুলনায় প্রায় তিনগুণ রোগী ভর্তি থাকে হাসপাতালে। ওয়ার্ডে রোগীর জন্য চিকিৎসকরা প্রেসক্রিপশনে যেসব ওষুধ লিখেন তা নার্স ইনচার্জ এর কাছে যায়। সেটি রেজিস্ট্রার কিংবা সহকারী রেজিস্ট্রারের স্বাক্ষর হয়ে যায় স্টোরে। স্টোর থেকে প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ওষুধ নিয়ে আসা হয়।  

জানা গেছে, নার্স ইনচার্জরা না গিয়ে ওষুধ আনতে ওয়ার্ড বয়দের পাঠায়। ওই সময় রোগীর জন্য যে পরিমাণ ওষুধ, স্যালাইন, ইনজেকশন এবং অন্যান্য চিকিৎসা সরঞ্জাম আনার কথা, তা অপ্রতুল দেখানো হয়। এসব ওষুধ সরিয়ে রাখে চক্রের সদস্যরা। সার্জারি, মেডিসিন, শিশুরোগ, অর্থোপেডিক্স, গাইনি, হৃদরোগ, ক্যাজুয়্যালিটি এবং অপারেশন থিয়েটারের (ওটি) ওষুধ এভাবে পাচার চক্রের হাত ধরে বাইরে চলে যায়। অনেক সময় রোগীর জন্য কিনে আনা ওষুধও চুরি হয়ে যায়।

পুলিশ বলছে, রোগীদের ওষুধ পাচার করে- এমন ১৫টি চক্র হাসপাতালে সক্রিয়। প্রায়ই এই চক্রের সদস্যদের আটক করা হচ্ছে। চলতি বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি হাসপাতালের গেট থেকে ওষুধসহ গ্রেফতার করা হয় স্থায়ী কর্মচারী আশু ও অস্থায়ী কর্মচারী সৈয়দকে।  তাদের কাছ থেকে সাড়ে ৩ লাখ টাকার ওষুধ উদ্ধার করা হয়। সর্বশেষ ২০ এপ্রিল সকালে সরকারি ওষুধ চুরি করে নিয়ে যাওয়ার সময় ৩৩ নম্বর গাইনী ওয়ার্ডের অফিস সহায়ক রতনকে গ্রেফতার করা হয় বলে জানান চমেক পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ নুরুল আলম আশেক।

গত বছরের ১০ মার্চ দুদকের ৪ সদস্যের তদন্ত টিম অভিযানে এসে ওষুধের স্টোরের হিসেবের সঙ্গে ফার্মেসিতে নিয়ে আসা হিসাবের মিল পায়নি। এসব হিসাব সঠিকভাবে রেজিস্ট্রার খাতায় লেখাও হয়নি। এনিয়ে ফার্মেসিতে দায়িত্বরতকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে কোনো সদুত্তরও পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছিলেন দুদক চট্টগ্রাম কার্যালয়-১ এর উপ পরিচালক মো. নাজমুচ্ছায়াদাত।

তবে হাসপাতালের ওষুধ স্টোর শাখার ইনচার্জ ডা. হুমায়ুন কবির জানান, আমরা ফার্মেসি এবং ওয়ার্ডে ওষুধ সরবরাহ দেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করে থাকি। ওয়ার্ডের ইনচার্জ ছাড়া কারও কাছে ওষুধ সরবরাহ করা হয় না।

সরকারি হাসপাতাল থেকে ওষুধ চুরি হলে স্পেশাল ড্রাগ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ ১৯৮২ সালের বিশেষ আইনের ২০ ধারায় মামলা নথিভুক্ত করা এবং আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়ার আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে এ আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়ায় ওষুধ পাচার চক্র পার পেয়ে যাচ্ছে। আইনজীবীরাও বলছেন, পুলিশ ‘ভুল ধারায়’ চার্জশিট দাখিল করলে মূল আসামিরা পার পেয়ে যাবে।

গত বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি ও ৭ জুলাই চমেক হাসপাতাল থেকে ওষুধ চুরির ঘটনায় দুটি মামলা হয়। এর মধ্যে গত ১ জুলাই চমেকের এক অফিস সহায়কের বাসায় থেকে উদ্ধার হয় ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা মূল্যের কয়েক বস্তা সরকারি ওষুধ। ৭ জুলাই হাসপাতালের নিচতলার ৬ নম্বর লিফটের সামনে থেকে চুরি যাওয়া সরকারি ওষুধসহ আসামি সুমন বড়ুয়াকে গ্রেফতার করা হয়। তাকে সহায়তা করে পরিচ্ছন্নতা কর্মী শাহ আলম।

দুই মামলায় হাসপাতালের আটজন চুক্তিভিত্তিক ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দেয় পুলিশ। চলতি বছরের ২৪ জানুয়ারি ২৭ ধরনের ওষুধ চুরির মামলায় পাঁচজনকে অভিযুক্ত করা হয়, যারা সবাই হাসপাতালের মৌখিক চুক্তিভিত্তিক ওয়ার্ডবয়। চার্জশিটে উল্লেখ করা হয়, এই মৌখিক চুক্তিভিত্তিক ওয়ার্ডবয়রাই ওষুধ চুরির ঘটনা ঘটাচ্ছে। আসামিরা অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের কাছে সরকারি ওষুধ বিক্রি করে। তাই সরকারি ওষুধ ক্রেতাদের শনাক্ত করা যায়নি।

মামলা দুটির তদন্ত কর্মকর্তা পাঁচলাইশ থানার এসআই নুরুল আলম আশেক বলেন, তদন্তে যা পেয়েছি তাই চার্জশিটে তুলে ধরেছি। দণ্ডবিধির দুটি চুরির ধারায় তদন্ত করে চার্জশিট দাখিল করেছি।

বাংলাদেশ সময়: ১৩২০ ঘণ্টা,  এপ্রিল ২৩, ২০২৩
এসি/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।