চট্টগ্রাম: কয়েক দফা নমুনা ডিম দেওয়ার পর পুরোদমে ডিম ছেড়েছে মা মাছেরা। গত শনিবার মানিকছড়ি ও ফটিকছড়ি উপজেলায় প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়।
রোববার (১৮ জুন) রাত সাড়ে ১১টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত জোয়ার ও ভাটার সময় মা মাছেরা নদীর অন্তত ১০টি স্থানে ডিম ছাড়ে। ডিম আহরণকারীরা একেকটি নৌকায় ৫০ কেজির ওপরে ডিম সংগ্রহ করতে পেরেছেন।
হালদা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত ৫ বছরের মধ্যে এবার সবচেয়ে বেশি ডিম সংগ্রহ করা হয়েছে। তবে, এখনো সঠিক পরিমাণটি বের করা সম্ভব নয়। কি পরিমাণ ডিম সংগ্রহ করেছেন সেটি বলা যাবে আরও পরে। এবার প্রচণ্ড দাবদাহ ও ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাবে হালদা নদীতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় ডিম ছাড়তে দেরি হয় বলে মনে করছেন তারা।
রোববার দুপুর থেকে সোমবার বেলা ১১টা পর্যন্ত নদীর হাটহাজারীর উত্তর মাদার্শা ইউনিয়নের রামদাসমুন্সিরহাট, মাছুয়াঘোনা ও আমতুয়া, নাপিতের ঘাট, পোড়া কপালী, গড়দোয়ারা ইউনিয়নের নয়াহাট, রাউজানের পশ্চিম গুজরা ইউনিয়নের আজিমের ঘাট, কাগতিয়া ও খলিফারঘোনা এলাকায় অন্তত ৩০০টি নৌকায় জেলেরা ডিম সংগ্রহ করেছেন।
ডিম সংগ্রহকারী মুহাম্মদ কামাল সওদাগর বলেন, পাঁচটি নৌকায় ১২ থেকে ১৪ জন লোক নিয়ে ডিম সংগ্রহ করছি। প্রতিটি নৌকায় ১০ কেজি পরিমাণ ডিম সংগ্রহ করেছেন। গত কয়েক বছরের মধ্যে রেকর্ড পরিমাণ ডিম পেয়েছি।
শনিবার সকালে জোয়ারের শুরুতে এবং দুপুর ও বিকেলে সাত থেকে আটটি স্থানে ২০০-৩০০ গ্রাম ডিম পেয়েছিলেন তাঁরা। পরে রাত সাড়ে ১১টায় মিলল কাঙ্ক্ষিত ডিমের দেখা। এর আগে গত ১৭ মে রাতে এবং ১৮ মে দিনের জোয়ারে এই মৌসুমের প্রথম অল্পসংখ্যক নমুনা ডিম ছাড়ে মা মাছ। এরপর আর কোনো জোয়ারে মা মাছ ডিম ছাড়েনি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হালদা রিসার্চ অ্যান্ড ল্যাবরেটরি সূত্রে জানা যায়, প্রজনন মৌসুমের শুরুতে হালদা নদীতে স্বাভাবিকের চেয়ে লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছিল প্রতি লিটারে সাড়ে ৩ হাজার মিলিগ্রাম, যা স্বাভাবিক অবস্থায় থাকে ২০ থেকে ৩০ মিলিগ্রাম। তবে গত ২০ দিনের বজ্রবৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে সে লবণাক্ততা কমে এসেছে। গত বছর মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহের পরিমাণ ছিল সাড়ে ৬ হাজার কেজি। এর আগে ২০২১ সালে ৮ হাজার ৫০০ কেজি।
হালদা গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, মা মাছের ডিম ছাড়া নিয়ে এতে আমরা শঙ্কিত ছিলাম। পুরো মৌসুমে ডিম ছাড়ার পরিমাণ খুব কম ছিল। তবে গতকাল রাত সাড়ে ১১টা থেকে নদীর প্রায় ২০টি স্থানে প্রচুর পরিমাণ ডিম ছাড়া শুরু হয়।
এবার বেশ দেরি করেই ডিম ছাড়া শুরু করেছিল কার্পজাতীয় (রুই, কাতলা, মৃগেল, কালবাউশ) মা মাছেরা। অন্যান্যবার এপ্রিলের শুরু ও মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে চার থেকে পাঁচবার ডিম ছাড়ে মা মাছ।
জালুবায়ু পরিবর্তন সহ নানা কারণে গত কয়েক বছর ধরে কম ডিম ছাড়ছে মা মাছ। ২০২০ সালে হালদা থেকে রেকর্ড পরিমাণ ২৫ হাজার কেজি ডিম সংগ্রহ করা হলেও পরের দুই বছর তা কমে অর্ধেকেরও নিচে নেমে যায়। হালদা নদীতে গত বছর বৃষ্টি না হওয়ায় ডিম ছাড়েনি মা মাছ। চট্টগ্রামে ৪৫ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে কম বৃষ্টি হয়েছে সেবার। ২০২১ সালে বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢল না নামার কারণে ডিম সংগ্রহ হয়েছে অল্প। সে সঙ্গে যুক্ত হয় ঘূর্ণিঝড়। তাই হালদা নদীর পানিতে বাড়ে লবণাক্ততা। তাই সে বছরও আশানুরূপ ডিম সংগ্রহ করতে পারিনি ডিম সংগ্রহকরীরা। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০২২ সালের ২২ মে মা মাছ ডিম ছেড়েছিল। তখন ভারি বৃষ্টির সঙ্গে পাহাড়ি ঢলের প্রকোপ ছিল। যার কারণে মা মাছ ডিম ছাড়ার একটা অনুকূল পরিবেশ পেয়েছিল। ফলে রেকর্ড পরিমাণ ডিম ছেড়েছে মা মাছ।
হালদা গবেষক ড. মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, রোববার মধ্যরাতে জোয়ারের সময় আমতুয়া পয়েন্টে কার্পজাতীয় মা মাছ পূরোদমে ডিম ছাড়ে এরপর এই ডিম জোয়ার বাড়ার সাথে সাথে নাপিতের ঘাট, আজিমারঘাট, মাছুয়াঘোনা হ্যাচারী সংলগ্ন পুরালি স্লুইজ গেইট, নোয়াহাট সহ হালদার বিভিন্ন স্পনিং গ্রাউন্ডে এই ডিম ছড়িয়ে পড়ে। শনিবারের বজ্রপাতসহ ব্যাপক বৃষ্টির প্রভাবে হালদায় পাহাড়ি ঢল নেমে এসে ডিম ছাড়ার অনুকুল পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এই বছর হালদা নদী থেকে প্রচুর পরিমাণে ডিম সংগ্রহ করা হয়েছে। এতে ডিমসংগ্রহকারী সহ হালদা সংশ্লিষ্ট সবার মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠেছে।
হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইউএনও মুহাম্মদ শাহিদুল আলম বলেন, হালদা নদীর পরিবেশ স্বাভাবিক রাখতে হাটহাজারী উপজেলা প্রশাসন সবসময় কঠোর অবস্থানে ছিল। প্রশাসনিকভাবে যা যা করণীয়, সবই করা হয়েছে। এবার ডিম ছাড়ার বিষয়ে শুধু প্রাকৃতিক বিষয়ই বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফারহানা লাভলী বলেন, ডিম সংগ্রহ কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করছি। রেণু ফোটানো ও পোনা সংরক্ষণের জন্য আমাদের একটি টিম কাজ করছেন। তারা মোট ডিম সংগ্রহের পরিমাণ বের করবেন। ডিম আহরণ ও সংরক্ষণের হিসাব পেতে একটু সময় লাগবে।
বাংলাদেশ সময়: ১০৩০ ঘণ্টা, জুন ২০, ২০২৩
বিই/পিডি/টিসি