চট্টগ্রাম: লবণ দেওয়া কাঁচা চামড়া স্তূপ করে রাখা। সেই চামড়ার দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে আছেন মো. ইউনুস।
আতুরার ডিপো এলাকায় নিজের চামড়া গুদামে রোববার (২ জুলাই) দুপুরে লবণযুক্ত চামড়া পরিচর্যা করছিলেন তিনি। বললেন, এখন ঢাকার ট্যানারিগুলোর লোকজনের হাতে আমাদের ভাগ্য। তারা কবে আসবে, কবে বেচবো সেই আশাতে দিন কাটছে। এর আগের বছরগুলোতে লাখ লাখ টাকা লোকসান দিয়েছি। বাকি টাকা পাইনি। এবারও ধারকর্জ করে নেশার কারণে চামড়া কিনেছি। হয়তো এটাই শেষবার।
বৃহত্তর চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার সমবায় সমিতি লিমিটেডের কার্যালয়ে বসেছিলেন সহ-সভাপতি মো. আবদুল কাদের সর্দার। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, কাঁচা চামড়া পচনের হাত থেকে রক্ষার প্রথম ধাপ হচ্ছে দ্রুত লবণ দেওয়া। গত বছর যে লবণের বস্তা (৭৪ কেজি) কিনেছিলাম ৯০০ টাকা এবার তা কিনতে হয়েছে ১ হাজার ২০০ টাকা থেকে ১ হাজার ২৫০ টাকা। চামড়া কেনার পর দক্ষ কর্মী দিয়ে সাফ করে (ঝিলাই) লবণ লাগানোর কাজে প্রতি পিসে খরচ পড়েছে ১০৫ টাকা, আগের বছর ছিল ৭০-৭৫ টাকা। সব মিলে এবার কঠিন যুদ্ধ করতে হয়েছে জাতীয় সম্পদ চামড়া পচনের হাত থেকে বাঁচাতে। তারপরও আমরা শঙ্কিত। কারণ চট্টগ্রামে একটি মাত্র ট্যানারি আছে। ঢাকার ট্যানারি যদি চট্টগ্রামের চামড়া ন্যায্য দামে না কেনে, যদি কাঁচা চামড়া রপ্তানির অনুমতি না মেলে তাহলে আমরা সর্বস্বান্ত হয়ে যাব।
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, কোরবানির দিন মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীরা মাঠে নামে। তারা চামড়ার বর্গফুটের হিসাব বোঝে না, গ্রেড বোঝে না, চামড়ায় অদক্ষ কসাইয়ের ছুরির দাগ দেখে না। গরুর দামের ওপর চামড়ার বর্গফুট হিসাব হয় না। সুন্দর একটি গরুর দাম লাখ টাকা হতে পারে কিন্তু চামড়া পাওয়া যায় ১২-১৬ বর্গফুট। আবার ৬০ হাজার টাকার গরুর চামড়া ২৫-৪০ বর্গফুটও হয়। আমরা কোরবানির লবণযুক্ত চামড়া গড়ে ২০-২১ ফুট ধরে ট্যানারিতে দিয়ে থাকি। যদি চামড়া আমাদের ঢাকার ট্যানারিতে পাঠাতে হয় তাহলে প্রতি পিসে কেনা দামের সঙ্গে লবণ, ঝিলানি, গাড়ি ভাড়া, আড়ত ভাড়া, লোড-আনলোড শ্রমিকের মজুরি ইত্যাদি মিলে আরও ৩০০-৩৫০ টাকা খরচ।
তিনি জানান, একটি চামড়ায় ১০-১২ কেজি লবণ দিতে হয়। প্রতি কেজি লবণ প্রায় ১৭ টাকা কিনতে হয়েছে।
সূত্র জানায়, বৃহত্তর চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার সমবায় সমিতি লিমিটেডের সদস্যভুক্ত আড়তদার ১১২ জন হলেও এবার চামড়া কিনে গুদামজাত করেছেন ৮০ জন। এর বাইরে ২ শতাধিক চামড়া ব্যবসায়ী আছেন। লবণযুক্ত চামড়া দুই-তিন মাসের মধ্যে টানারিতে পাঠিয়ে দিতে পারলে মান ভালো থাকবে বলে। চট্টগ্রাম শহরের চার লাখ কোরবানির কাঁচা চামড়া সংগ্রহের প্রস্তুতি নিলেও আড়তদাররা রোববার (২ জুলাই) পর্যন্ত প্রায় ৩ লাখ ২০ হাজার চামড়া সংগ্রহ করেছেন। এর মধ্যে গরু-মহিষের চামড়া ২ লাখ ৫৫ হাজার, বাকিগুলো ছাগল ও ভেড়ার।
চট্টগ্রামে ষোলশহর জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া কামিল মাদ্রাসায় গাউসিয়া কমিটি চামড়ায় লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করেছে। এ ছাড়া বিভিন্ন এলাকায় বেশ কয়েকটি বড় মাদ্রাসা নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় লবণযুক্ত চামড়া সংরক্ষণ করেছে। চট্টগ্রাম শহর এলাকার বাইরে বিভিন্ন উপজেলা, জেলায়ও চামড়া ব্যবসায়ীরা লবণযুক্ত চামড়া সংরক্ষণ করেছেন। একসময় চট্টগ্রামে বেশ কয়েকটি ট্যানারি থাকলেও এখন রিফ লেদার ছাড়া আরও কোনো ট্যানারি চালু নেই। তাই সিংহভাগ চামড়া ঢাকার বিভিন্ন ট্যানারি কিনে থাকে।
কাদের লেদারের মালিক মো. আবদুল কাদের সর্দার জানান, এবার তিনি ৪ হাজার পিস গরুর, ১ হাজার পিস মহিষের ও ২ হাজার পিস ছাগলের চামড়া লবণ দিতে সক্ষম হয়েছেন।
আড়তদার মো. শাহিন চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, এবার ৫ হাজার চামড়ার কাট কেটে, লেজ ফেলে মাংস সাফ করে লবণ দিয়ে রেখেছি। আমরা কী দামে চামড়া কিনছি সেটা মনিটরিং করতে লোকজনের অভাব নেই। কিন্তু সেই চামড়া বিনা রশিদে ট্যানারি মালিকের কাছে বিক্রি করছি, বাকিতে বিক্রি করছি, নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করছি সেগুলো দেখার কেউ নেই। ব্যাংক আমাদের ব্যবসায় ঋণ দেয় না।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৫০ ঘণ্টা, জুলাই ২, ২০২৩
এআর/পিডি/টিসি