চট্টগ্রাম: দীর্ঘ ১০ বছর রেলওয়ের বিভিন্ন দফতরে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করেছেন অস্থায়ী বা টেম্পোরারি লেবার রিক্রুটমেন্ট (টিএলআর) শ্রমিকরা। ২০২০ সালের নিয়োগ বিধিতে তাদেরকে বেসরকারিভাবে কাজ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়।
রেলওয়েতে বর্তমানে ৪৭ হাজার ৬৩৭ জনবলের অনুমোদন রয়েছে। এর বিপরীতে কর্মরত আছে প্রায় ২৫ হাজার। বাকি প্রায় ২২ হাজার পদ শূন্য। তীব্র জনবল ঘাটতি সত্ত্বেও বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রায় ৮ হাজার অস্থায়ী কর্মী জুলাইতে চাকরি হারিয়েছেন।
উচ্চ আদালতের অন্তত ছয়টি রায়ে রেলওয়ের প্রায় এক হাজারেরও বেশি অস্থায়ী কর্মচারীকে স্থায়ী করতে বলা হয়। এ নিয়ে গঠিত হয় বিশেষজ্ঞ কমিটিও। কিন্তু তা বাস্তবায়ন না করে নতুন নিয়োগের পথে হাটছে রেলওয়ে। ফলে ক্ষুব্ধ দীর্ঘদিন ধরে রেলে কর্মরত অস্থায়ী টিআরএল শ্রমিকেরা।
তারা বলছেন, আইন অনুযায়ী নিরবিচ্ছিন্নভাবে তিন বছর অস্থায়ী পদে কর্মরতদের রাজস্ব খাতে স্থায়ীকরণের নিয়ম রয়েছে। টিএলআর কর্মচারীদের কেউ কেউ ১০ বছরও রেলে কাজ করছেন। তাদের বেশিরভাগের নতুন করে চাকরিতে আবেদনের বয়স নেই। রেলওয়ের অস্থায়ী কর্মচারীদের স্থায়ী করতে আদালতের রিট পিটিশনে অন্তত ছয়টি রায় কর্মচারীদের পক্ষে এসেছে। এতে এক হাজারেরও বেশি শ্রমিক রয়েছেন। এছাড়া আরো আড়াই হাজার অস্থায়ী কর্মচারীর করা অন্তত ১৫টি মামলা আদালতে বিচারাধীন।
এ সমস্যা সমাধানের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে স্মারকলিপি দিয়েছেন তারা। এছাড়াও রেলপথ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, সচিব, ও মহাপরিচালকের কাছেও স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে। এনিয়ে বিভিন্ন রেলওয়ে স্টেশনে আন্দোলন করছেন শ্রমিক সংগঠনের নেতারা। এরপরেও তাদেরকে চাকরি থেকে ছাঁটাই করা হচ্ছে, যা কোনো ভাবেই মেনে নিতে পারছেন না রেল শ্রমিক নেতারা।
জানা গেছে, বাংলাদেশ রেলওয়ের বিভিন্ন দফতরে স্থায়ী শূন্যপদের বিপরীতে অস্থায়ী দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কর্মরত প্রায় ৮ হাজার জন টিএলআর শ্রমিকদের অব্যহতি প্রদান করে। রেলওয়ে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে শ্রমিক নিয়োগ নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সেই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামসহ সারাদেশের সকল টিএলআর শ্রমিকেরা কর্মবিরতিসহ নানা আন্দোলন কর্মসূচি পালন করে। এছাড়াও রেল সংশ্লিষ্ট সকল দফতরে ও বিভাগীয় ব্যবস্থাপকের কাছে স্মারকলিপি প্রদান করেছে তারা। ২০২২ সালের জুন মাস পর্যন্ত সকল টিএলআর শ্রমিকদের সরকারের রাজস্ব খাত থেকে বেতন দেওয়া হয়। কিন্তু ১ জুলাই থেকে কোন বাজেট বরাদ্দ বা চাকুরির মঞ্জুরী এখনো হয়নি। বেতন ছাড়া দীর্ঘদিন শ্রমিকেরা পরিবার নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তারপরেও ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক রাখতে নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন সকল টিএলআর অস্থায়ী শ্রমিকরা।
রেলওয়ে ২০১৭ সালের তারিখে ৩ ডিসেম্বর এক চিঠির মাধ্যমে রেলওয়ে পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চলকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করে রেলওয়েতে ৩ বছরের অধিক সময় কর্মরত অস্থায়ী টিএলআর শ্রমিকদের রেলওয়েতে স্থায়ীকরণ প্রসঙ্গে। এরপর রেলওয়ে পশ্চিম অঞ্চলে একটি কমিটি গঠন করা হয়। সে কমিটি পরবর্তী কোন পদক্ষেপ নেয়নি। অস্থায়ী (টিআরএল) শ্রমিকদের বেশীরভাগই রেলওয়ের অপারেশনাল কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত গেইট কিপার, পয়েন্টস ম্যান, পোর্টার, বিদ্যুৎ, ক্যারেজ ও অন্যান্য।
বাংলাদেশ রেলওয়ে অস্থায়ী টিএলআর শ্রমিক সংগঠনের কেন্দ্রীয় শ্রমিক নেতা মোহাম্মদ হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, গত ৩০ জুন এক চিঠির মাধ্যমে চট্টগ্রাম সিআরবিতে হিসাব বিভাগে দীর্ঘদিন ধরে কর্মরত ৮০ জন অস্থায়ী শ্রমিক, কারখানায় বিদ্যুৎ ও বিভিন্ন দফতরের ১৩০ জনকে, লালমনিরহাট ডিভিশনের ক্যারেজ শাখায়, চট্টগ্রাম ডিভিশনের সিজিপিওয়াই লোকো শাখা সহ সারা দেশে অস্থায়ী শ্রমিকদের বিভিন্ন ভাবে অব্যহতি দেওয়া হয়। যা সম্পূর্ণ অমানবিক। এতে করে শ্রমিক অসন্তোষ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়।
তিনি আরও বলেন, রেলওয়ে নতুন ২০২০ নিয়োগ বিধিতে আউটসোর্সিং প্রক্রিয়া এনে রেলকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে একটি মহল। যার কারণে প্রায় ৮ হাজার দক্ষ শ্রমিককে ছাঁটাই করেছে। এর ফলে রেলওয়ের গুরুত্বপূর্ণ স্টেশন, গুরুত্বপূর্ণ লেভেল ক্রসিং বন্ধ হয়ে যাবে। অদক্ষ শ্রমিক নিয়োগের কারনে বাড়তে পারে রেল দুর্ঘটনা ঘটনাও। অপারেশনাল কর্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটবে। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী, রেল সচিব, রেলওয়ে মহাপরিচালক বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছি এবং আমাদের চাকুরী স্থায়ী করনের বিষয়টি আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করেছি।
বাংলাদেশ রেলওয়ে শ্রমিক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, রেলওয়ে একটি বিশেষায়িত জাতীয় প্রতিষ্ঠান। রেলের অনেক সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ করতে হয় স্থায়ী-অস্থায়ী কর্মচারীদের। নিয়োজিত টিএলআররা নানা বিষয়ে আন্তরিকতাসহ রেলের সম্পত্তি রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছেন। রেলওয়ের স্বার্থ ও মানবিক বিবেচনায় শুরু থেকেই বলেছি আমরা আউটসোর্সিং চাই না। রেলের নতুন আইনে এটা বাতিল করতেও বলা হয়েছে।
রেলওয়ে টিএলআর শ্রমিকদের সংগঠনগুলো এ সমস্যার দ্রুত সমাধান চেয়েছেন। সকল টিএলআর শ্রমিকদের চাকুরি বহাল করে তাদের স্থায়ীকরনের প্রক্রিয়া গ্রহণ করতে রেল মন্ত্রণালয়ের প্রতি আহ্বান জানান তারা।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, রেলওয়ের অস্থায়ী শ্রমিকদের স্থায়ীকরণের বিষয়টি আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রক্রিয়াধীন। রেলওয়ের আইন শাখার অনুমোদন সাপেক্ষে স্থায়ীকরণের বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে একাধিক কমিটিও গঠন করা হয়েছে। নতুন বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জরুরী ভিত্তিতে কিছু চতুর্থ শ্রেণির শ্রমিক নিয়োগ দেওয়া হবে। এর সঙ্গে দীর্ঘদিনের পুরোনো টিএলআর কর্মীদের স্থায়ীকরণের সম্পর্ক নেই।
গেইটকিপার সংকটের কারণে ২০১৬ সালে মানোন্নয়ন শীর্ষক একটি প্রকল্পের মাধ্যমে দুই অঞ্চলে প্রায় ১৮০০ চুক্তি-ভিত্তিক গেইটকিপার নিয়োগ দেওয়া হয়। বর্তমানে প্রায় ১৫০৫ জন কর্মরত আছেন। দীর্ঘ সময় নিয়োজিত অস্থায়ী কর্মচারীদের নিয়োগ না দিয়ে নতুন করে এই প্রকল্পের শ্রমিকদের নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু করেছে সংস্থাটি।
প্রকল্পের নিয়োগ করা গেইটকিপার/গেইটম্যানদের রাজস্বভুক্ত স্থায়ী শূন্য পদে নিয়োগের জন্য গত ১০ মে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে রেলওয়ে। এতে ২ বছর নিরবিচ্ছিন্নভাবে পূর্ণ হওয়া প্রকল্পের শ্রমিকদের আবেদনের শর্ত দেওয়া হয়েছে। অথচ ৩ বছর থেকে শুরু করে ১০ বছর পর্যন্ত রেলওয়েতে নিরবিচ্ছিন্নভাবে কাজ করার পরও রেলওয়ে এসব অস্থায়ী শ্রমিকদের নিয়োগ দিচ্ছে না।
কিন্তু রেলের ২০২০ সালে প্রণীত ক্যাডার বহির্ভূত কর্মচারী নিয়োগের নীতিমালায় প্রকল্পে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মচারীদের রাজস্বখাতে স্থায়ী করার সুযোগ নেই। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ দীর্ঘসময় ধরে কর্মরত অস্থায়ী কর্মচারীরা। এক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের রায়ও উপেক্ষা করা হচ্ছে বলেও মনে করছেন তারা।
বাংলাদেশ সময়: ১২২০ ঘণ্টা, জুলাই ১১, ২০২৩
বিই/পিডি/টিসি