চট্টগ্রাম: মিতু হত্যার কয়েকদিন পর সাইফুলের নির্দেশে মোখলেসুর রহমান ইরাদ ‘কিলিং মিশনে অংশ নেওয়া’ ওয়াসিম ও আনোয়ারের বিকাশ নম্বরে তিন লাখ টাকা পাঠিয়েছিলেন।
মঙ্গলবার (১৭ জুলাই) বিকেলে চট্টগ্রামের তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মো. জসিম উদ্দিনের আদালতে ইরাদ সাক্ষ্য দেন।
আদালতে দেওয়া সাক্ষ্যে ইরাদ জানান, ২০১৪ থেকে ১৭ পর্যন্ত ঢাকার মোহাম্মদপুরের বছিলায় র্যাব অফিসের বিপরীতে ‘মাল্টিয়ান প্রিন্ট অ্যান্ড প্যাকেজিং’ নামের প্রতিষ্ঠানটিতে তিনি এক্সিকিউটিভ অফিসার পদে ছিলেন। ২০১৬ সালের ৫ মে কোম্পানির এমডি সাইফুল ইসলাম স্যার আমাকে অ্যাকাউন্ট থেকে তিন হাজার টাকা নিয়ে বাবুল আক্তার স্যারের সঙ্গে কথা বলতে বলে। বাবুল আক্তার স্যারের প্রমোশন হয়েছে। যেখানে মিষ্টি পৌঁছাতে বলে, সেখানে পৌঁছাবে। উনার ফোন নম্বর দেন। আমি উনাকে ফোন দিই। তিনি আমাকে ৬ কেজি মিষ্টি, ২ কেজি করে আলাদা আলাদা তিন রকম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিয়া হলের পাশে বোনের বাসা আবুল কালাম আজাদের বাসায় দিয়ে আসতে বলেন। এই প্রথম আমি বাবুল আক্তার স্যারকে ফোন দিই।
এরপর মিতু হত্যার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে ইরাদ বলেন, ‘মিতু ভাবি মার্ডার হন ২০১৬ সালের ৫ জুন। এর দুই দিন পর সাইফুল স্যার আমাকে সঙ্গে নিয়ে বাবুল আক্তার স্যারের শ্বশুরবাড়ি ঢাকার বনশ্রীর মেরাদিয়াতে যান। সেখানে সারাদিন অবস্থান করে দুপুরের খাওয়া দাওয়া করি। বিকেল পর্যন্ত থাকি। বাবুল আক্তার স্যারের ছেলেমেয়ের সঙ্গে সেলফি তুলে ফেসবুকে শেয়ার করি। ’
‘বিকেল তিনটার দিকে সাইফুল স্যার আমাকে অফিসে যেতে বলেন। আমি বছিলায় অফিসে গিয়ে অ্যাকাউন্টসের মামুন স্যারের কাছ থেকে তিন লাখ টাকা গ্রহণ করি। টাকা নিয়ে আমি সাইফুল স্যারকে কল দিয়ে টাকাগুলো কী করবো জিজ্ঞেস করি। তিনি বলেন, তুমি মিষ্টি নিয়ে বাবুল আক্তারের বোনের বাসায় গিয়েছিলে যেখানে, সেখানে দিয়ে আস। আমি সেখানে টাকা দিয়ে এসে রাত ১০টায় সাইফুল স্যারকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে ওইদিনের কাজ শেষ করি। ’
ইরাদ আরও বলেন, ‘পরদিন বিকেল ৫টা, সাড়ে ৫টার দিকে এমডি স্যার (সাইফুল) আমাকে আবারও কল দিয়ে আবদুল্লাহ আল মামুন নামে একজনের নম্বর দেন এবং বাবুল আক্তার স্যারের বোনের বাসায় গিয়ে তার কাছ থেকে তিন লাখ টাকা নিতে বলেন। আমি যখন টাকা রিসিভ করি, তখন বাবুল আক্তার স্যারের বাবাও সেখানে ছিলেন। টাকার সঙ্গে আমাকে দুটি গ্রামীণ ফোনের মোবাইল নম্বর ও নাম দেওয়া হয়, আনোয়ার এবং ওয়াসিম। টাকা পেয়ে আমি আবার সাইফুল স্যারকে ফোন করি। তিনি ওই দুটি বিকাশ নম্বরে তিন লাখ টাকা পাঠাতে বলেন। ’
‘টাকা নিয়ে বাবুল আক্তার স্যারের বোনের বাসা থেকে নেমে আসার পর ওনার বাবা আমাকে জিজ্ঞেস করেন, আমি কোথায় যাচ্ছি? আমি তাকে বিকাশে টাকা পাঠাতে যাচ্ছি বলে জানাই। তিনিও আমার সঙ্গে যাবেন বললেন, সম্ভবত পান খেতে। পরবর্তীতে স্যারের বাবা ও আমি মোটরসাইকেল নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গাউসুল আজম মার্কেটের নিচতলায় যাই। আমি ভেতরে বিকাশের দোকানে যাই। বাবুল আক্তার স্যারের বাবা বাইরে ছিলেন। ’
বিকাশ নম্বরে টাকা পাঠানোর তথ্য দিয়ে ইরাদ বলেন, ‘আমি ওই দোকান থেকে দুই লাখ ৩০ বা ৪০ হাজার টাকার মতো সেন্ড করতে পারি। তারপর আমি বাবুল আক্তার স্যারের বাবাকে বাসায় দিয়ে অফিসে চলে যাই। এরপর আমি সাইফুল স্যারকে কল দিয়ে বলি যে, ২ লাখ ৩০ হাজার টাকা পাঠিয়েছি। তিনি বলেন, বাকি টাকা যেখান থেকে পার পাঠিয়ে দাও। পরে আমি মোহাম্মদপুর বছিলায় র্যাব অফিসের পাশে রিপন টেলিকম থেকে বাকি ৭০ হাজার টাকার মতো পাঠাই। ’ এরপর ২০২১ সালে পিবিআই তাকে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে ও যে মোবাইলে বাবুল আক্তারের ছেলেমেয়ের সঙ্গে তার ছবি ছিল সেটি জব্দ করে এবং পরে আদালতে জবানবন্দি দেন বলে ইরাদ সাক্ষ্যে জানান। সাক্ষ্য দেওয়ার পর ইরাদকে জেরা করেন আসামি পক্ষের আইনজীবী কফিল উদ্দিন, আহমেদ কামরুল ইসলাম চৌধুরী ও কামাল হোসেন চৌধুরী।
আসামি পক্ষের আইনজীবী কামাল হোসেন চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, তিনটা পার্সোনাল নম্বরে তিন লাখ টাকা পাঠানোর কথা বলেও এক পার্সোনাল নম্বরে ২৫ হাজার টাকার বেশি একদিনে পাঠানো যায় না। প্রকৃত সাক্ষীদের বাদ দিয়ে সাজানো সাক্ষী দেওয়া হয়েছে। আদালতে মিথ্যা সাক্ষী উপস্থাপন করা হয়েছে।
সাক্ষ্য শেষে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী পিপি আবদুর রশিদ বাংলানিউজকে বলেন, মিতু হত্যা মামলার বাবুল আক্তারের বন্ধু সাইফুলের কর্মচারী মোখলেসুর রহমান ইরাদের সাক্ষ্য ও আসামি পক্ষের জেরা শেষ হয়েছে। আগামী ৮ আগস্ট পরবর্তী সাক্ষীর জন্য দিন ধার্য করেছেন আদালত।
২০১৬ সালের ৫ জুন সকালে চট্টগ্রাম নগরের জিইসি মোড়ে ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে যাওয়ার সময় মিতুকে প্রকাশ্যে গুলি চালিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়। মামলার বাকি আসামিরা হলেন- মোতালেব মিয়া ওরফে ওয়াসিম, আনোয়ার হোসেন, এহতেশামুল হক ভোলা, শাহজাহান মিয়া, কামরুল ইসলাম শিকদার মুছা ও খায়রুল ইসলাম। ২০১৬ সালে মিতু খুন হওয়ার পর তার স্বামী, সে সময়ের পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তার বাদী হয়ে এ মামলা করেছিলেন। নানা নাটকীয়তা শেষে পিবিআইয়ের তদন্তে এখন তিনিই এ মামলার আসামি। এসপি বাবুল তার কিছুদিন আগেই চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশে ছিলেন। বদলি হওয়ার পর তিনি ঢাকায় কর্মস্থলে যোগ দিতে যাওয়ার পরপরই চট্টগ্রামে এ হত্যাকাণ্ড ঘটে।
বাংলাদেশ সময়: ১৯২০ ঘণ্টা, জুলাই ১৮, ২০২৩
এমআই/টিসি