চট্টগ্রাম: মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, চট্টগ্রাম জেলা সংসদেরে উদ্যেগে শনিবার (১৬ ডিসেম্বর) নগরের চেরাগী পাহাড়ে মুক্তিযুদ্ধের আলোকচিত্র প্রদর্শনী, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
উদীচী চট্টগ্রাম জেলা সংসদের সভাপতি ডাক্তার চন্দন দাশের সভাপতিত্বে ও সহ সম্পাদক জয় সেনের সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন একুশে পদকপ্রাপ্ত কবি ও প্রাবন্ধিক আবুল মোমেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী নুরুল আবসার ও অমল কান্তি নাথ।
সভায় একুশে পদকপ্রাপ্ত কবি ও প্রাবন্ধিক আবুল মোমেন বলেন, 'কোথাও নির্বাচন হয় না। সবজায়গায় ক্ষমতাসীনের পক্ষে সিলেকশন হয়।
তিনি বলেন, 'নাগরিক সমাজ প্রশ্ন তুলবে। প্রতিবাদ জানাবে। এটা হতে পারতো আমার এ রাজ্য পছন্দ হচ্ছে না তাই আমি ভোট দিতে যাব না। কিন্তু এখন টা হচ্ছে না। এখন হচ্ছে এ ভোটের ত অর্থ নেই। তাই গেলাম না। এটা মানে আমি আমার দায়িত্বকে এরালাম। এখানে বলা উচিত ছিল আমি তোমাদের রাজনীতি তাই পছন্দ করছি না। আমার একটি নতুন ধারা রাজনীতি চায়। এটার সময় এসেছে। একটি তরুণ সমাজ এখন ভাবছে। বিষয়গুলো লক্ষ্য করছে। তাদের মধ্যে পড়াশোনা করার আগ্রহও বেড়েছে। প্রযুক্তির সঙ্গে তারা পরিচিত। '
আবুল মোমেন বলেন, '২০০৮ সালের পর একটা সুযোগ ছিল বাংলাদেশকে একটি ট্র্যাকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অনুযায়ী চলার। সেদিক থেকে এ যে উত্থান পতনটি হচ্ছে বিএনপিকে নিয়ে তার ভেতর দিয়ে আমরা কয়েকটি জিনিস লক্ষ্য করি। একটি হচ্ছে সমাজে ক্রিমিনাইলেজেশন ও কমিউনালেজেশন হয়েছে। রাজনীতি, প্রশাসন ও সমাজের অন্যন্য ক্ষেত্রের ভেতর দিয়ে আমরা দেখছি ক্রিমিনাল এক্টিভিটি করে ক্ষমতায় আসা যায়, ভালো থাকা যায় এবং সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়া যায়। আবার কমিউনাল হলেও একইভাবে তাদের মধ্যে কোনো অসুবিধা হয়। সমাজের ভেতরে এ জিনিসটি দানা বেঁধেছে এখন। ভাগ করা গোস্টহী হচ্ছে। মানুষ ভালো মন্দের বিচারটি এখন করছে না। কিংবা কখনও কখনও জেনে বুঝেই মন্দকে ছাড় দিচ্ছে। নানা রকম বিবেচনায় কোনো মন্দকে ছাড় দিচ্ছে আবার কোনো মন্দের বিরুদ্ধে কথা বলছে। এর মধ্যে কোনো নৈতিক মানদণ্ড নেই। কঠিন সামাজিক পরিস্থিতি যাচ্ছে যেখান থেকে উদ্ধার হওয়া বেশ কঠিন হবে বলে আমি মনে করি। '
তিনি আরও বলেন, 'ষাটের দশকের সঙ্গে তুলনা করলে বিশ্ববিদ্যালয়ে সে ধরণের প্রফেসররা নেই যারা জাতির উদ্দেশ্যে কথা বলতে পারে, যারা নৈতিক একটি অবস্থান গ্রহণ করতে পারে। ছাত্র রাজনীতির দিকে তাকালেও দেখা যাবে ষাটের দশকে সঙ্গে কোনো তুলনা হয় না। শ্রমিক রাজনীতি থেকে শুরু করে সব জায়গায় আজ একটি অবক্ষয় দেখা যাচ্ছে। সংস্কৃতির অঙ্গনেও কিন্তু নানা রকমটেকনোলজি এসেছে, আমাদের অনেকের ব্যক্তিগত দক্ষতাও বেড়েছে। ্নাটকের কাজ হচ্ছে, আবৃত্তি হচ্ছে। গান বাজনে হচ্ছে। কিন্তু সাংগঠনিকভাবে জনগণকে সম্পৃক্ত করে জনমূখী একটা সংস্কৃতি জাগরণ এটা কিন্তু আমরা দেখতে পাই না। মানুষের মধ্যে একতা ব্যক্তিগত অর্জনের প্রতিযোগিতা চলছে। ফলে মানুষের সঙ্গে শিল্পীদের একটি বিচ্ছিন্নতা হয়েছে। রাজনীতি থেকে সংস্কৃতি বিলুপ্ত হয়েছে। শিক্ষা থেকেও সংস্কৃতি বিলুপ্ত হয়েছে। শিক্ষা কেবল মাত্র পরীক্ষা পাস, জিপিএ -৫ পাওয়া এগুলোর মধ্যে আটকে গেছে। ফলে আমরা কোনো জায়গা থেকে সামাজিক প্রগতির গতিশীল কাজ হবে সে যোগান পাচ্ছি না। '
কবি বলেন, 'হতাশ হওয়াটা ঠিক হবে না। যদি আমেরিকার দিকে তাকায় তারা স্বাধীনতা লাভ করেছিল ১৭৭২ সালে। তারা ১৮০২ সালেও ভাল ছিল না। বিভেদ ও বিবাদ ছিল। গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল। ইউরোপেও গণতন্ত্র চর্চা ১০০ বছরের বেশি সময় লেগেছে। আমাদেরটা একটি সামন্ত-আধাসামন্ত গ্রামভিত্তিক সমাজ ছিল। সেখান থেকে আমরা নাগরিক সমাজে উত্তরণ ঘটছে। কিন্তু নাগরিক জীবনে যে আইনের শাসন দরকার হয় সেটা সম্পর্কে নাগরিকদের অত সচেতনতা নেই। কোনো সিস্টেমম নেই। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা যদি বসাতে হয় তাহলে আইনের শাসন লাগবে। মানুষের মর্যাদা রক্ষা পেতে হবে। আইনগতভাবে গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে একটি অবস্থানে পৌঁছিয়েছে। আমেরিকায় এখনও সাদা-কালো বিভেদ আছে। জর্জ লরেন্সকে যে হত্যা করল সে শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসার কিন্তু নিস্তার পায়নি। তার ৩০ বছরের জেল হয়েছে। তাই আইনের একটি প্রক্রিয়া যখন চালু থাকবে তার মাধ্যেমে সমাজে এক ধরণের স্থিতি আসে। আমরা সেটা নিশ্চিত করতে পারিনি। '
আবুল মোমেন বলেন, 'আমরা কেবলমাত্র ক্ষমতাকে ঘিরে রাজনীতি করেছি। কে ক্ষমতায় যাবে, বিএনপি না আওয়ামী লীগ। এরকম একটি চক্করে পড়েছি। সমাজের অন্যন্য জায়গায় যে ক্ষমতায়ন করা দরকার সে জায়গায় যাচ্ছি না। আমার শিক্ষা, স্বাস্থ্য অধিকার ঠিক করতে হবে, আমার নাগরিক অধিকারগুলোকে সংরক্ষন করতে হবে। নারীর অধিকার, সংখ্যালঘুর অধিকার এগুলো রক্ষা করতে হবে। এগুলোর জন্য বিভিন্ন নাগরিক ফোরাম হতে পারত। কিন্তু আমরা বড় দুইদলের তোষামোদী করে বেড়াচ্ছি। আমাদের পেশাজীবি, সংস্কৃতি কর্মীরাও এ লাইনে কাজ করেন। এটা একটা সুস্থ গনতান্ত্রিক সমাজের লক্ষণ নয়। '
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সঙ্গীত ভবন, রাগশ্রী, অদ্বিতীয়া, শ্রুতিনন্দনের শিল্পীরা সম্মিলিত গান পরিবেশন করেন। উদীচী চট্টগ্রাম জেলা সংসদের শিল্পীরা গণসঙ্গীত ও মুক্তিযুদ্ধের রণসঙ্গীত পরিবেশন করেন।
এছাড়া সুরাঙ্গন বিদ্যাপীঠ ডান্স একাডেমি ও অদ্বিতীয়ার শিল্পীরা নৃত্য পরিবেশন করেন। আবৃত্তি পরিবেশন করেন বোধন আবৃত্তি পরিষদ ও উচ্চারক আবৃত্তিকুঞ্জের শিল্পীরা।
সাংস্কৃতিক পর্ব পরিচালনা করেন উদীচী চট্টগ্রাম জেলা সংসদের সাধারণ সম্পাদক শীলা দাশগুপ্তা।
এর আগে, সকালে উদীচী চট্টগ্রাম জেলা সংসদের শিল্পীরা মুক্তিযুদ্ধের রণসঙ্গীত গেয়ে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানান। এসময় জেলার সভাপতি চন্দন দাশ, সহ সভাপতি বিধান বিশ্বাস, সুমন সেন ও তপন শীল, সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য জয় সেন, ভাস্কর রায়, ইমন সেন এবং সাংস্কৃতিক সংগঠক শিমুল সেন উপস্থিত ছিলেন।
বাংলাদেশ সময়: ২১২০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৬, ২০২৩
পিডি/টিসি