চট্টগ্রাম: ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে আরও একটি বছর। পূর্ণতা-অপূর্ণতার বছরটিতে বিভিন্ন ঘটনায় আলোচনায় ছিল চট্টগ্রাম।
অপরিকল্পিত নগরায়নের এ নগরীতে ডেঙ্গু যেমন সারাবছর মাথাব্যথার কারণ ছিল, তেমনি স্যালাইনের দাম বাড়া কিংবা ডাব সিন্ডিকেট কম ভোগায়নি ভোক্তাদের।
চলতি বছর সবচেয়ে বেশি ভুগিয়েছে ডেঙ্গু। রেকর্ড সংখ্যক আক্রান্তের পাশাপাশি মৃত্যুও ছিল বেশি। চলতি বছরের ২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৪ হাজার ডেঙ্গু রোগী মিলেছে, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ৩ গুণ। এছাড়া মৃত্যুতেও ছাড়িয়েছে সব রেকর্ড। চলতি বছর ডেঙ্গুতে চট্টগ্রামে ১০৭ জনের মৃত্যু হয় বলে জানিয়েছে সিভিল সার্জন কার্যালয়। গত বছর ডেঙ্গুতে মৃত্যু ছিল ৪৭ জন। এবছর সেপ্টেম্বর মাস ছিল ডেঙ্গুর পিক পয়েন্ট। এই মাসে ৩ হাজার ৮৯২ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন।
স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডেঙ্গুর এমন পরিস্থিতির পিছনে সিটি করপোরেশনের গাফিলতি দায়ী৷ মশার ওষুধ না ছিটানো কিংবা আশপাশের নালা-নর্দমাগুলো পরিস্কার না রাখার কারণে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে। তাছাড়াও নগরবাসীকে বাসাবাড়ি পরিস্কার রাখতে ও সচেতন হতে পরামর্শ দিয়েছেন তারা। এখনই বিষয়গুলোতে নজর না দিলে ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে বলেও হুঁশিয়ারি দেন স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
এদিকে ডেঙ্গুর প্রকোপের মধ্যে ডাব ও ওষুধ সিন্ডিকেট মাথাচাড়া দিয়েছে এ বছর। ১০০ টাকা দামের ডিএস-১ স্যালাইনের দাম গিয়ে দাঁড়ায় ৩০০ টাকায়। সরবরাহ ঠিক থাকলেও কৃত্রিম সংকট বাড়িয়ে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয় বলে দাবি করে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর। কয়েকদফা অভিযানেও নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি স্যালাইনের দাম। একই অবস্থা ছিল ডাবের বাজারেও। প্রতিটি ছোট বা মাঝারি মানের ডাব কিনতেই খরচ করতে হয়েছে অতিরিক্ত টাকা।
এ বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের (চমেক) ৪ শিক্ষার্থীকে কলেজ ছাত্রাবাসে আটকে রেখে মারধরের অভিযোগ ওঠে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। এর মধ্যে দুইজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় আইসিইউতেও রাখা হয়। এর জেরে গঠিত তদন্ত কমিটি ১৬ মার্চ ৭ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার করে।
এছাড়াও ছোট-বড় ঘটনায় সারাবছর খবরের শিরোনাম হয়েছিল দেশের দক্ষিণ পূর্ব অঞ্চলের এ বিদ্যাপীঠ। এ বছরের ৮ অক্টোবর দুই শিক্ষানবিশ চিকিৎসককে দায়িত্বরত অবস্থায় মারধর করে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। এ নিয়ে বেশ কয়েকদিন উত্তেজনা বিরাজ করে প্রতিষ্ঠানটিতে।
অন্যদিকে, চলতি বছরের ৬ নভেম্বর তুচ্ছ ঘটনার জেরে দুই কর্মচারীর মারামারিতে প্রাণ যায় একজনের। দুইজনই চমেক ফরেনসিক মর্গের কর্মচারী।
সরকারি ওষুধ চুরি করে আলোচনায় ছিলেন এই প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা। প্রতিনিয়ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে ওষুধ চুরি করছেন তারা। চলতি বছরের ৯ ও ২০ এপ্রিল ওষুধ চুরির অপরাধে ২ কর্মচারীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তাছাড়া গত ৬ ডিসেম্বরও একই অপরাধে ৩ জনকে গ্রেফতার করে। বারবার এমন ঘটনা ঘটলেও কোনোভাবে লাগাম টানা যাচ্ছে না এ অপরাধের।
শুধু তাই নয় বছরজুড়ে দালালের উৎপাত ছিল উল্লেখযোগ্য হারে। এ নিয়ে পুলিশের অভিযানে বেশ কয়েকজন দালাল আটক হয়। তবে তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই পুলিশের কাছে। চমেক পুলিশ ফাঁড়ির দাবি, এক বছরে ২৫-৩০ জন দালাল আটক করা হয়। তবে তাদের আদালতে চালান দিলেও দুর্বল আইনের কারণে তারা হাজত থেকে বেরিয়ে আসে এবং একই অপকর্মে লিপ্ত হয় বলে দাবি চমেক পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ নুরুল আলম আশেকের।
হাসপাতাল থেকে শিশু চুরির মত ঘটনাও ছিল এবছর। চলতি মাসের ১৯ ডিসেম্বর এমন ঘটনা ঘটে চমেক হাসপাতালে। আইসিইউ থেকে চুরি যাওয়া নবজাতককে একদিন পর উদ্ধার করা হয় ফেনী থেকে। এ ঘটনায় আটক করা হয় দুইজনকে।
স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার আরেকটি অংশ বেসরকারি খাত। চট্টগ্রামে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা খাতের বিপুল বিস্তার ঘটেছে। ক্রমবর্ধমান বেসরকারি খাতের বিকাশ, নিয়ন্ত্রণ এবং নজরদারির বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে ভাবা হয়নি বিগত সময়ে। যেহেতু নজরদারি অনুপস্থিত তাই মান নিয়ন্ত্রণের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। এ জন্য মানসম্মত সেবার প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে নিরন্তর নজরদারি প্রয়োজন বলে মত সংশ্লিষ্টদের।
ঘটনাবহুল আরও একটি বছর শেষে নতুন বছরের অপেক্ষা। সংকট কাটিয়ে আসন্ন ২০২৪ সালে হবে সমৃদ্ধির- এমন প্রত্যাশা সাধারণ মানুষের।
বাংলাদেশ সময়: ১১৪৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩০, ২০২৩
এমআর/এসি/টিসি