ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২২ কার্তিক ১৪৩১, ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ০৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

চার হাজার রোজাদারের ইফতারের আয়োজন যেখানে

মিনহাজুল ইসলাম,স্টাফ করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৩১ ঘণ্টা, মার্চ ১৩, ২০২৪
চার হাজার রোজাদারের ইফতারের আয়োজন যেখানে ছবি: বাংলানিউজ

চট্টগ্রাম: বিশাল হাঁড়িতে সিদ্ধ করা হচ্ছে ছোলা। পাশেই বড় বড় কড়াইয়ে একে একে ভাজা হচ্ছে পেঁয়াজু, বেগুনি ও আলুর চপ।

নগরের কাজীর দেউড়ির আবুল হোসেন বাবুর্চির নেতৃত্বে সাতজন সহকারী বাবুর্চি দ্রুত হাতে কাজ করে যাচ্ছেন।  

প্রতিদিন আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদের ইফতারের জন্য এভাবেই তৈরি হচ্ছে ২ হাজার মানুষের ইফতার।

এই আয়োজনের মূল উদ্যোক্তা মসজিদের খতিব মাওলানা ছাইয়্যেদ মুহাম্মদ আনোয়ার হোসেন তাহের জাবেরী আল মাদানী।  

সামাজিক ও আর্থিক অবস্থান, শ্রেণি-পেশার ভেদাভেদ ভুলে এখানে প্রতিদিনই ইফতার করে থাকেন হাজারো মানুষ। যুগের পর যুগ ধরে সম্প্রীতির বন্ধনে বাঁধা এমন ইফতারের আয়োজন প্রসঙ্গে কথা হয় শাহী জামে মসজিদের খতিবের সহকারী মোহাম্মদ হাছান মুরাদের সঙ্গে।  

তিনি বাংলানিউজকে বলেন, গত ২০২০ ও ২০২১ সালের রমজানে করোনার কারণে ইফতার আয়োজন বন্ধ ছিল। প্রতিবছর রোজার প্রথম দিন থেকে আমাদের ইফতার আয়োজন শুরু হয়। রোজার প্রথম সপ্তাহে দেড় থেকে দুই হাজার এবং এরপর থেকে তিন থেকে চার হাজার রোজাদারের জন্য ইফতারের আয়োজন করা হয়। সম্পূর্ণ নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় তৈরি করা হয় ইফতারি। টাটকা ও স্বাস্থ্যসম্মত ইফতারি যাতে সবাই খেতে পারেন সেই চেষ্টা করা হয়। প্রতিদিন সকাল থেকে ইফতারের নানান আইটেম তৈরির কাজ শুরু হয়।

এদিকে আসরের নামাজের পর থেকেই মসজিদে ইসলামিক আলোচনা ও বারান্দায় রোজাদারদের মধ্যে শুরু হয় ইফতার বণ্টনের কাজ। একই মসজিদে যোহরের নামাজের পরে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের আয়োজনে ধর্মীয় ও মাসয়ালা নিয়ে আলোচনা করা হয়। প্রতিদিন অন্তত দেড় থেকে দুই হাজার মানুষের একসঙ্গে ইফতার আয়োজনের ব্যবস্থা রয়েছে এ মসজিদে। তবে রোজা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তিন-চার হাজার রোজাদার একসঙ্গে ইফতারে অংশগ্রহণ করেন। যেখানে ধনী-গরিব কোনো ভেদাভেদ নেই। সবাই পাশাপাশি বসে ইফতার করবেন। প্রত্যেক রোজায় দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, মাদরাসার অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ ও বিভিন্ন মসজিদের খতিবরা আলোচক হিসেবে থাকেন।  

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, নিয়মিত ইফতারসামগ্রীর মধ্যে রয়েছে খেজুর, শরবত, ছোলা, মুড়ি, জিলাপি, আলুর চপ, ছমুছা, অন্থন, পেঁয়াজু ইত্যাদি। এছাড়াও ব্যক্তিগতভাবে নানান ব্যক্তি আপেল, কমলা ও আম ইত্যাদি মৌসুমি ফল এবং  বিরিয়ানিও পরিবেশন করেন।

১৯৯৬ সাল থেকে এ মসজিদে খতিবের দায়িত্ব পালন করছেন মাওলানা ছাইয়্যেদ মুহাম্মদ আনোয়ার হোসেন তাহের জাবেরী আল মাদানী। ঐতিহ্যবাহী জুমা মসজিদের খতিবের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ছোট পরিসরে ২০০১ সাল থেকে শুরু হলেও বড় পরিসরে ২০০৮ সাল থেকে  ধনী-গরিবের বৈষম্যহীন সুবিশাল ইফতার  আয়োজন করা হচ্ছে। মাঝখানে গত ২০২০ ও ২০২১ সালে করোনা কারণে একসঙ্গে ইফতার আয়োজন বন্ধ রাখা হয়েছিল। ধনী-গরিবের বৈষম্যহীন ইফতারে নগরের নানা প্রান্ত থেকে ছুটে আসেন ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা। সেখানে সৃষ্টি হয় সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের এক অনন্য পরিবেশ।

ইফতার আয়োজকরা জানিয়েছেন, সারি সারি প্লেটে রাখা ইফতারি সামনে নিয়ে বসে থাকেন ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা। মসজিদের বারান্দায় সারিবদ্ধভাবে বসে আছেন শত শত মানুষ। একসাথে ইফতারে বসার ক্ষেত্রে ধনী-গরিব কোনো ভেদাভেদ নেই। পুরো রমজান মাসজুড়েই এই আয়োজন চলবে।  

শাহী জামে মসজিদের স্টাফ জহিরুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের মসজিদের স্টাফ ও আরও ১০ থেকে ১৫ জন মিলে ইফতার বণ্টন করে থাকি। মসজিদে যারা ইফতার করতে আসেন, সকলে ইফতার করে যেতে পারেন।

রান্নার দায়িত্বে থাকা আবুল হোসেন বাবুর্চি বাংলানিউজকে বলেন, প্রতিদিন ভোর ছয়টা থেকে ইফতারের নানান আইটেম তৈরির কাজ শুরু হয়। ভাজাপোড়া শুরু হয় সকাল দশটা থেকে। রোজাদারের জন্য ইফতার তৈরি করতে মাসজুড়ে ৮ জন বাবুর্চি কাজ করে। এই কাজ করতে কোন বিরক্ত লাগে না। খুশি মনে সকলে নিজের মতো করে কাজ করে।

খতিবের সহকারী মোহাম্মদ হাছান মুরাদ বলেন, ধণাঢ্য ব্যক্তিদের সহযোগিতায় এ ইফতারের আয়োজন করা হয়। এখানে যারা সহযোগিতা করেন তারা কেউ নামের জন্য করেন না। সবাই সওয়াবের উদ্দেশ্যে ইফতার আয়োজনে শরিক হন। এই আয়োজনে প্রতিবছর রোজা শুরুর আগে থেকে আমাদের কাছে ছোলা, তেল ও পেঁয়াজ ইত্যাদি দিয়ে মানুষ সহযোগিতা করে আসছেন। প্রত্যেকদিন রোজায় যোহরের নামাজের পরে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের আয়োজনে ধর্মীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়।

আন্দরকিল্লা জামে মসজিদের সঙ্গে মুঘলদের চট্টগ্রাম বিজয়ের ইতিহাস সুনিবিড়ভাবে জড়িত। কথিত আছে, কিল্লাটি মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুদের আস্তানা ছিল। ১৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ জানুয়ারি শায়েস্তা খাঁর ছেলে উমেদ খাঁ কিল্লার ভেতরে প্রবেশ করলে এর নাম হয়ে যায় আন্দরকিল্লা। পরে বিজয়ের স্মৃতি ধরে রাখতে সম্র্রাট আওরঙ্গজেবের নির্দেশে শায়েস্তা খাঁ ১৬৬৭ সালে সেখানে আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদটি নির্মাণ করেন। মসজিদে রয়েছে পাঁচটি প্রবেশদ্বার। সমতল ভূমি থেকে প্রায় ৩০ ফুট ওপরে পাহাড়ের টিলায় মসজিদটির অবস্থান।  

বাংলাদেশ সময়: ১৫২০ ঘণ্টা, মার্চ ১৩, ২০২৪
এমআই/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।