চট্টগ্রাম: নগরের শুলকবহর ওয়ার্ডের হাজী এম সিরাজ জামে মসজিদ সড়কের মাসুদ কলোনির পাশে বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা এক কারখানা থেকে খটখট শব্দ কানে ভেসে আসে। ভেতরে ঢুকতেই দেখা মিললো কয়েকজন কারিগর বেশ মনোযোগী কাজে।
জানা যায়, একসময় নগরে ১০-১২টি তাঁতশিল্প প্রতিষ্ঠান ছিল। কিন্তু একে একে সব বন্ধ হয়ে যায়। নিবু নিবু হারিকেনের আলোর মতো প্রায় ৩ দশক ধরে ঠিকে আছে এই একটি প্রতিষ্ঠান। আগে এখানে ১৮ থেকে ২০টি হ্যান্ডলুম মেশিনে কাপড় বোনা হতো। ছিল পর্যাপ্ত কারিগর। এখন মেশিন আর কারিগর কমে ৮-১০ টি মেশিনে কাজ চলছে। তাঁতশিল্পের দৈন্যদশায় কারিগররাও অন্য পেশায় চলে গেছেন।
কারখানায় প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারি শামছুল ইসলামকে পাওয়া গেল না কথা হলো তাঁর ছেলে মামুনের সঙ্গে। কেমন আছেন জিজ্ঞেস করতেই কিছুটা অভিমান যেন ঝরে পড়ল কণ্ঠে। মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিলেন ভালো নেই। ঈদের পরেই তল্পিতল্পা গুটিয়ে চলে যাচ্ছেন শহর থেকে।
তিনি জানালেন, সেই ১৯৯৬ থেকে এই জায়গায় কারখানা। যদিও বাবা শামসুল ইসলাম স্বাধীনতার পর থেকেই এ কাজে জড়িত। কিন্তু এখন বিদেশি পণ্যের প্রসারে অনেকটা কোণঠাসা দেশি তাঁতশিল্প। তার উপরে কারিগর সংকট-কাঁচামালের দাম বৃদ্ধিতে আর কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। আগে কারখানায় অনেক রকমের তাঁত পণ্য তৈরি হলেও এখন শুধু থামি তৈরি হয়। লুঙ্গির চাহিদা থাকলেও টাকার অভাবে পারছেন না তৈরি করতে।
‘অনেকের কাছে ধন্না দিয়েছি কিন্তু মেলেনি কোনো সরকারি সহায়তা। তাই ঈদের পর বন্ধ করে দিয়ে কারখানা ঢাকা চলে যাবো। সেখানে আরেকটি নতুন কারখানা দেওয়ার চেষ্টা করবো। ’
কারখানায় মনের মাধুরী মিশিয়ে থামি বুনে চলেছিলেন এক ষাটোর্ধ্ব কারিগর। চোখেমুখে তাঁর রাজ্যের ক্লান্তি আর কঙ্কালসার চেহেরা জানান দিচ্ছিল এ কারখানার দৈন্যদশার।
কথা প্রসঙ্গে তিনি জানালেন, ১০ পাউন্ড সুতায় ১২-১৩ থামি তৈরি করা যায়। আগে এ সুতা ৮০০-৯০০ টাকায় পাওয়া গেলেও এখন প্রায় ২০০০ টাকা। এর উপরে আছে রঙ আর কারিগর মজুরি। থামি বিক্রি হয় পাইকারিতে ২০০ বা তার চেয়ে একটু বেশি। খরচ মিটিয়ে তাই লাভ উঠে না। তাদের মজুরিও আর বাড়াতে পারছেন না মালিক।
শামছুল ইসলাম টেক্সটাইলে উৎপাদিত থামিগুলোর ক্রেতা মূলত টেরিবাজার আর খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা। আর কিছু পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্রেতাও আছেন এ তালিকায়।
প্রশ্নের জবাবে মামুন বলেন, বাবার হাত ধরে এ কাজটি শিখেছি তাই করে যাচ্ছি। পুরো করোনায় কারখানা বন্ধ ছিল। কেউ এগিয়ে আসেনি। বর্ষাকালে এখানে পানি উঠে। তখন কারখানা বন্ধ করে রাখতে হয়। বিদ্যুৎ বিলও বেড়েছে। তাই ঋণ নিয়ে যে কারখানা চালাবেন তারও উপায় নেই। খরচ বাড়লেও বাজারে তাদের তাঁত পণ্যের দাম বাড়েনি তাই এই সিদ্ধান্ত।
বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের তথ্যমতে, হস্তচালিত তাঁত শিল্প বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ কুটির শিল্প। ২০১৮ সালের তাঁত শুমারি অনুযায়ী তাঁত শিল্পে বছরে ৪৭ দশমিক ৪৭ কোটি মিটার কাপড় উৎপাদিত হয়, যা দেশের বস্ত্র চাহিদার প্রায় ২৮ ভাগ পূরণ করে। জিডিপিতেও তাঁত শিল্প খাতের অবদান শূন্য দশমিক ১০ শতাংশ। আর বর্তমানে এ শিল্পের সাথে তাঁতিসহ প্রত্যক্ষভাবেই জড়িত রয়েছেন প্রায় নয় লাখ মানুষ ।
বাংলাদেশ সময়: ১০২২ ঘণ্টা, মার্চ ১৯, ২০২৪
পিডি/টিসি