চট্টগ্রাম: শ্রমবিরোধ ও শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে চট্টগ্রাম বিভাগের চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলা নিয়ে চট্টগ্রামে ২টি শ্রম আদালতে ২ হাজার ২৪টি মামলা বিচারাধীন। পাঁচ বছর ধরে ঝুলছে প্রায় পাঁচশয়ের অধিক মামলা।
বিচারাধীন এসব মামলার বেশিরভাগই গার্মেন্ট খাতের শ্রমবিরোধ ও শ্রম আইন লঙ্ঘন থেকে সৃষ্ট। কারখানা বন্ধ ঘোষণা, চাকরিচ্যুতি, অবসরের পর সুবিধাদি না দেওয়া, বেতন আটকে রাখা, বিলম্বে বেতন দেওয়ার অভিযোগে করেছেন শ্রমিক-কর্মচারীরা।
অন্যদিকে কাগজে কলমে শ্রম অধিকার নিয়ে সচেতন মহল সোচ্চার হলেও বাস্তবতা ভিন্ন। শ্রমিকের অধিকার বুঝিয়ে দিতে এখনো গড়িমসি করে অনেক প্রতিষ্ঠান। শ্রমিকের অধিকার আদায়ে তাই গঠন করা হয় শ্রমিক আদালত। ধীরগতির বিচারের কারণে শ্রমজীবী বিচারপ্রার্থীরা কাঙ্ক্ষিত সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। শ্রম আদালতে জমেছে মামলার স্তূপ।
চটগ্রাম শ্রম আদালত সূত্রে জানা যায়, ২টি আদালতে ২ হাজার ২৪টি মামলা বিচারাধীন। এর মধ্যে প্রথম শ্রম আদালতে মামলা রয়েছে ১ হাজার ৪৭৯টি এবং দ্বিতীয় শ্রম আদালতে ৫৪৫টি। এর মধ্যে ৫ শতাধিক মামলা রয়েছে, যেগুলো ৪ থেকে ৫ বছরেও নিষ্পত্তি হয়নি। দুটি আদালতে ১ বছরে (এপ্রিল ২০২৩ থেকে মার্চ ২০২৪ পর্যন্ত) নিষ্পত্তি হয়েছে ৪৭৫টি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বেতন-ভাতার পাওনা আদায়, চাকরিতে পুনর্বহাল ও ক্ষতিপূরণসহ বিভিন্ন অভিযোগে দেশের শ্রম আদালতগুলোতে মামলা করেন শ্রমজীবীরা। চট্টগ্রামের ২টি শ্রম আদালতে নানা জটিলতায় মামলার জট লেগে গেছে।
শ্রম আদালতের প্রধান বিচারককে বলা হয় চেয়ারম্যান। যিনি জেলা ও দায়রা জজ পদমর্যাদার একজন বিচারক। মামলার সিদ্ধান্ত দেওয়ার দিন অতিরিক্ত আরও দুজন সদস্য বা বিচারক থাকেন এজলাসে। সেখানে দুপক্ষই আইনজীবীর মাধ্যমে মামলা পরিচালনা করে থাকেন। শ্রম আদালতগুলোতে মামলা শুনানির জন্য ধার্য তারিখ হয় বছরে তিন থেকে চারবার। ফলে মামলার বিচার কার্যক্রম শেষ হতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। এতে অনেক শ্রমিকই মালিক পক্ষের সঙ্গে আপস মীমাংসায় যেতে বাধ্য হন। আর তখনই কেবল মামলা কিছুটা দ্রুত নিষ্পত্তি হয়। এছাড়াও বিচারক না থাকা, মালিক-শ্রমিক প্রতিনিধিদের অনুপস্থিতি, সমন জারিতে বিলম্ব, জবাব দাখিলে আইনজীবীদের বারবার সময় নেওয়া, প্রতিনিধিদের মতামত প্রদানে বিলম্বের কারণে শ্রম আদালতে মামলার বিচার ঝুলে আছে।
শ্রম আইনে মামলার দীর্ঘসূত্রতা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা ও দায়রা জজ আদালতের আইনজীবী ব্যারিস্টার মোহাম্মদ আসিফ ইশতিয়াক চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, আইনুযায়ী শ্রম আইনে মামলাসমূহ ৬০ দিনে নিষ্পত্তির নিয়ম রয়েছে। এ সময়ের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি না হলে উপযুক্ত কারণ ব্যাখ্যা করে আরও ৯০ দিন সময় দেওয়া যাবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, অধিকাংশ মামলা ৯০ সপ্তাহেও নিষ্পত্তি হয় না। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, শ্রম আইনে বলা হয়েছে- দুই বা ততোধিক বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চের মাধ্যমে ট্রাইব্যুনাল চলবে। শ্রম আইন অনুযায়ী আদালতে দুজন সদস্য থাকেন। তাদের অনুপস্থিতির জন্য অনেক সময় মামলার কাজে বিলম্ব হয়। আবার অনেক সময় মালিক পক্ষের অনুরোধে আইনজীবীরা বিলম্ব করেন। দ্রুত নিষ্পত্তি না হওয়ায় মামলাজট বাড়ছে এবং মামলা করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন চাকরিচ্যুত শ্রমিকরা।
চট্টগ্রাম প্রথম শ্রম আদালতের রেজিস্ট্রার আরিফুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের শ্রম আদালতে বর্তমানে বিচারাধীন রয়েছে ১ হাজার ৪৭৯টি মামলা। আদালতে জানুয়ারিতে মামলা করা হয় ৪৮টি ও নিষ্পত্তি হয় ৩৭টি, ফেব্রুয়ারিতে ২১টি মামলা করা হয় ও নিষ্পত্তি হয় ৪৪টি এবং মার্চে ৪৬টি মামলা করা হয় ও ৭৯টি মামলা নিষ্পত্তি করা হয়। ৫ বছরেও নিষ্পত্তি হয়নি ৪৫৬টি মামলা। এছাড়াও উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ আছে ১১০টি মামলায়।
চট্টগ্রাম দ্বিতীয় শ্রম আদালতের বেঞ্চ সহকারী কাউসার হাসান বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের আদালতে ৫৪৫টি মামলা বিচারধীন রয়েছে। এছাড়া গত এপ্রিল মাসে ৬৩টি মামলা নিষ্পত্তি করা হয়েছে।
শ্রম আদালতে মামলার প্রসঙ্গে ব্যারিস্টার সোহরাওয়ার্দী আরাফাত খান বাংলানিউজকে বলেন, শ্রমিকের অধিকার আদায়ে মামলা করা হলেও সময়মতো এসব মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ায় ধৈর্যহারা হয়ে অনেকে আর খোঁজ নিতে আসেন না। ফলে এসব মামলার ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে। মালিকপক্ষ পার পেয়ে যায়, শ্রমিক আর প্রতিকার পান না। তাছাড়া দুইপক্ষই বারবার সময় নেওয়ার কারণে মামলা নিষ্পত্তিতে দেরি হয়। তবে মালিক-শ্রমিক প্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্টদের আন্তরিকতার মাধ্যমে মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করা সম্ভব।
তিনি আরও বলেন, শ্রম বিরোধ নিষ্পত্তিতে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার অন্যতম একটি অংশ হল বিকল্প পদ্ধতিতে বিরোধ নিষ্পত্তি। এতে মামলার জট নিরসন যেমন হয়, ঠিক তেমনি এটি সাশ্রয়ী। তাছাড়া এই পদ্ধতিতে বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে উভয়পক্ষ বিজয়ী অবস্থায় থাকে, তদ্রুপ শ্রমিক মালিকের সম্পর্কের উন্নয়ন হয়।
চট্টগ্রাম কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরের উপ-মহাব্যবস্থাপক শিপন চৌধুরী বলেন, শ্রমিকদের অধিকার নিয়েই আমাদের কাজ। শ্রম আইনের বেশিরভাগ অধ্যায় নিয়ে কাজ করতে হয়। যেমন: শ্রমিকদের ঠিকমতো মালিকপক্ষ পাওনাদি পরিশোধ করছে কিনা, শ্রমিকদের নিয়োগপত্র ও আইডি কার্ড দিলো কিনা, কারখানায় শ্রমিকদের কাজ করার পরিবেশ আছে কিনা, মাতৃত্বকালীন ছুটি দেওয়া হচ্ছে কিনা, ইত্যাদি নানা বিষয়াদি আমরা দেখে থাকি। অসংগতি পেলে শ্রম আদালতে আমরা আইন ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করে থাকি।
বাংলাদেশ সময়: ১৩৪৭ ঘণ্টা, মে ১, ২০২৪
এমআই/এসি/টিসি