চট্টগ্রাম: কোনোভাবেই যেন থামানো যাচ্ছে না চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপ। প্রায় প্রতিদিনই চট্টগ্রাম, ফেনী কুমিল্লা, চাঁদপুরসহ পূর্বাঞ্চলের রেলওয়ে স্টেশন বিট পুলিশিং কার্যক্রম চালাচ্ছে পুলিশ।
হঠাৎ পাথর নিক্ষেপের প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ায় ট্রেনের সেই স্বাচ্ছন্দ্য আর আনন্দদায়ক ভ্রমণ যেন ম্লান হচ্ছে।
সর্বশেষ মঙ্গলবার (২২ ফেব্রুয়ারি) রাতে সিলেট থেকে ছেড়ে আসা পাহাড়িকা এক্সপ্রেস চট্টগ্রামের কুমিরা এলাকায় পৌঁছালে বাহির থেকে দুর্বৃত্তের পাথর নিক্ষেপে মো. আবির (৭) নামের এক শিশুর পাঁচটি দাঁত ভেঙ্গে যায়। শিশুটি চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
এর আগে রোববার (১৩ ফেব্রুয়ারি) ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে চলাচলরত বিরতিহীন যাত্রীবাহী সোনার বাংলা এক্সপ্রেস ট্রেনে পাথর নিক্ষেপে জানালার কাচ ভেঙে নাজিম উদ্দীন (৩৫) নামে এক যাত্রী আহত হন।
২০১৩ সালে ভাটিয়ারীতে চলন্ত ট্রেনে বাইরে থেকে ছোঁড়া পাথরের আঘাতে নিহত হন প্রকৌশলী প্রীতি দাশ (২৪)। ২০১৯ সালের ১ নভেম্বর চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়া সুবর্ণ এক্সপ্রেস ট্রেনে ছোড়া ঢিল থেকে অল্পের জন্য বেঁচে যায় ১৩ মাস বয়সী শিশু।
রেলওয়ে আইনের ১২৭ ধারা অনুযায়ী, ট্রেনে পাথর ছোড়া হলে সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ডসহ ১০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান আছে। ৩০২ ধারা অনুযায়ী, পাথর নিক্ষেপে কারও মৃত্যু হলে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে। তবে এসব আইনে কারও শাস্তি হয়েছে, এমন নজির নেই।
এমন ঘটনা রোধে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ তৎপর থাকলেও মনোবিকৃতি ঘটা ব্যক্তিদের শনাক্ত করা যাচ্ছে না। জিআরপি সূত্রে জানা যায়, ট্রেনে পাথর ছোড়ার ঘটনায় জড়িত ৮০ ভাগই বস্তির শিশু-কিশোর এবং মাদকাসক্ত ব্যক্তি। বস্তির শিশুদের আটক করা হলেও প্রমাণের অভাবে মুচলেকা নিয়ে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, গত নয় মাসে রেলওয়ের বিভিন্ন রুটে ১১০টি চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে পাথর নিক্ষেপের এসব ঘটনায় আহত হয়েছেন ২৯ জন যাত্রী। ট্রেনের জানালার গ্লাস ভেঙেছে ১০৩টি। চট্টগ্রাম জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি চলন্ত ট্রেনে পাথর ছোঁড়া হয় পাহাড়তলী এবং সীতাকুণ্ডের বাড়বকুণ্ডে।
পাহাড়তলী ও সীতাকুণ্ডের রেলপথে দুইপাশে অনেক বস্তি ও জঙ্গল ঘিরে দিন-রাত চলে বখাটেদের আড্ডা, মাদক সেবন সহ নানান অসামাজিক কার্যকলাপ। ফলে এসব এলাকা ভয়ংকর হয়ে উঠেছে ট্রেন যাত্রীদের জন্য।
মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, যারা চলন্ত ট্রেনে পাথর ছুঁড়ছে, তারা সেটাকে অপরাধ বলে মনে করে না। শুধু আনন্দ পেতে অনেকে এই কাজ করছে। আবার অনেকে হয়তো ভাবে, পাথর ছোঁড়া হলে ট্রেন থামবে কিংবা কিছু জিনিসপত্র কুড়িয়ে পাওয়া যাবে। মূলত, এটা করে তারা অসুস্থ আনন্দ পাচ্ছে।
জানা গেছে, চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপ বন্ধে রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীতে আরও দেড় হাজার জনবল চেয়েছে রেলপথ বিভাগ। সম্প্রতি রেলপথ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়, বিদ্যমান জনবলের সঙ্গে আরও ১ হাজার ৫০০ জনবল বাড়ানো হলে চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপ বন্ধে পদক্ষেপ নিতে সুবিধা হবে। এ ঘটনা এড়াতে ট্রেনের জানালায় তারের জাল (নেট) বসানোর সুপারিশ করা হয়েছে বৈঠকে।
পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের আওতাধীন রেলপথের যে জায়গাগুলো থেকে চলন্ত ট্রেনে পাথর ছোঁড়া হয় সেগুলো হচ্ছে- চট্টগ্রামের পাহাড়তলী, সীতাকুণ্ডের বাড়বকুণ্ড, ফেনীর ফাজিলপুর-কালীদহ এবং নরসিংদী সদর, জিনারদী ও ঘোড়াশাল এলাকা।
চট্টগ্রাম রেলওয়ে পুলিশ সুপার মো. হাছান চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের নিয়মিত কার্যক্রম এবং অভিযান চলমান রয়েছে। এর পরেও কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে। তারপরেও চিহ্নিত এলাকাগুলোতে আমরা অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করবো৷ এছাড়াও বিভিন্ন পয়েন্টে নেমে মানুষকে বুঝাচ্ছি পাথর নিক্ষেপের কুফল সম্পর্কে। শিক্ষকরা পাঠদানে এ বিষয়টি তুলে ধরছেন।
তিনি আরও বলেন, জুমার দিনেও আমরা সংশ্লিষ্ট মসজিদে গিয়ে বক্তব্য দিচ্ছি। তাদেরকে সচেতন করছি। পাথর নিয়ে কেউ হাঁটলেও তাকে আটক করছি। বাচ্চা হলে মা বাবার কাছ থেকে মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দিচ্ছি।
বাংলাদেশ সময়: ১৩৩০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০২১
বিই/টিসি