ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

দিল্লি, কলকাতা, আগরতলা

ক্যামেরা সৈনিক (পর্ব-২)

পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিশ্ব জনমত গড়ে তুলতে ক্যামেরা হাতে নেন

সুদীপ চন্দ্র নাথ, আগরতলা করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৪৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৬, ২০১৫
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিশ্ব জনমত গড়ে তুলতে ক্যামেরা হাতে নেন ছবি : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

আগরতলা: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সম্মাননাপ্রাপ্ত আলোকচিত্রী রবীন সেন গুপ্ত। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ক্যামেরা হাতে তিনি দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে ছুটে বেড়িয়েছেন।

কী ছিল সে অনুপ্রেরণা, যা মাত্র আট মাসের নতুন দাম্পত্য জীবনকে পেছনে ফেলে নিয়ে গেলো একেবারে যুদ্ধের ময়দানে। মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার অনুপ্রেরণা কোথা থেকেই বা পেয়েছিলেন?

এর উত্তরে রবীন জানান, প্রথম থেকেই তিনি মার্কসীয় মতাদর্শে বিশ্বাসী, মার্কসীয় মতাদর্শ সব সময় সাধারণ ও মেহনতি মানুষের হয়ে কাজ করে। তিনি ছাত্রজীবনে ১৯৫২ সালে ফটোগ্রাফির সঙ্গে যুক্ত হন। তাছাড়া রুশ ভাষা জানার সুবাদে ভিয়েতনামের রুশ প্রতিনিধিদলের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয় তার।

তখন জানতে পারেন ভিয়েতনাম যুদ্ধের ঘটনা। বড় শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই এবং জয় ছিনিয়ে আনা তাকে রোমাঞ্চিত করে। এসব ঘটনা তার কৈশোর বয়সেই মনের মধ্যে বিদ্রোহী মনোভাবের জন্ম দেয় যা যৌবনে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার অনুপ্রেরণা যোগায়।

ক্যামেরা কাঁধে বাংলাদেশে পৌঁছে খুঁজতে থাকেন কোথায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সাধারণ মানুষের ওপর পাশবিক অত্যাচার চালাচ্ছে, ছবি তোলার জন্য তিনি এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ছুটে বেড়ান। তার উদ্দেশ্য ছিল হানাদার বাহিনীর নির্মম অত্যাচারের ঘটনা বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরা এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিশ্ব জনমত গড়ে তোলা।

পাকিস্তান বাহিনী যখন বাঙালি সাধারণ মানুষের বাড়ি-ঘর, আবাস এলাকায় ঢুকে রাতের আধারে গণহারে রাইফেলের গুলিতে ঝাঁজরা করছে বুক; তা যেমন তিনি লুকিয়ে-লুকিয়ে ছবি তোলেছেন। তেমনি টেপ রেকর্ডারে রেকর্ড করেছেন বন্দুকের গুলি, কামানের আওয়াজ ও অসহায় মানুষের কান্না। সঙ্গে সঙ্গে তিনি চোখে দেখা ঘটনার ধারাভাষ্যও রেকর্ড করে রাখতেন। এমন ঘটনা এক বা দু’দিন নয় মাসের পর মাস সারা রাত ধরে তিনি করে গেছেন। পরে এই ঘটনা শোনানো হতো বেতারে।

হানাদার বাহিনীর বর্বরতার কাহিনী তুলে ধরতে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে গড়ে তোলা হয় স্বাধীন বাংলা বেতার। পাকিস্তানের স্বৈরশাসনের চোখ এড়িয়ে প্রথমে চট্টগ্রামের কালুরঘাট এলাকার বেতার কেন্দ্র থেকে যুদ্ধের তাজা শব্দের এই সব রেকর্ড চালানো হতো। পাকবাহিনী বেতার কেন্দ্রের খবর জানতে পেরে বোমাবর্ষণে তা নষ্ট করে ফেলে।

চট্টগ্রামের বেতার কেন্দ্র ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর আগরতলার পাশে শালবাগানে (৩ এপ্রিল ১৯৭১) চার কিলোহার্জের একটি বেতার কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। এই বেতার কেন্দ্র থেকেও তার রেকর্ড চালানো হতো।

তখন আকাশবাণী আগরতলা কেন্দ্র থেকে এসব রেকর্ডের সঙ্গে দেশাত্মবোধক গান পরিবেশন করা হতো। আব্দুল জব্বর, মামুদ, শহিদুল ইসলাম, স্বপ্না রায়সহ আরও অনেকেই আকাশবাণী আগরতলায় গান গাইতেন। পরে পাকবাহিনী এই কেন্দ্রেও অসংখ্য শেল নিক্ষেপ করে। তাই এসব শিল্পীদের নিয়ে যাওয়া হয় কলকাতায়।

মুক্তিযুদ্ধের ছবি ও রেকর্ড সংগ্রহের পাশাপাশি এসব শিল্পীদের আগরতলা থেকে কলকাতায় পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নেন রবীন সেন গুপ্ত। পরে শিল্পীরা কলকাতা থেকে পরিবেশন করেন দেশাত্মবোধক গান।

সব মিলিয়ে রবীন মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে এক হাজারেরও বেশি ছবি তোলেন। সেই সঙ্গে অনেক ‍অসহায় মানুষের আর্তনাদ ও ঘাতক বাহিনীর বুলেটের আওয়াজ ধরা আছে তার কাছে। ইচ্ছে ছিল এসব ছবি ও রেকর্ড দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের এক পূর্ণাঙ্গ তথ্যচিত্র তৈরি করবেন। কিন্তু হঠাৎ করে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুতে সব পরিকল্পনা ভেস্তে যায়।

তবে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা নিয়ে তথ্যচিত্র তৈরি না করা হলেও মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা নিয়ে রবীন লিখেছেন- একাধিক বই। এগুলোর কদর রয়েছে ভারত এবং বাংলাদেশে। ইতিহাসের সঙ্গে রবীনও স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৫৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৬, ২০১৫
আইএ

** মুক্তিযুদ্ধে আগরতলার সেই ক্যামেরা-সৈনিক

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।