ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

আবাসন মেলা

বাড়তি দামেও লোভনীয় অফারে আকৃষ্ট ক্রেতারা

ইফফাত শরীফ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৪৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৩, ২০২২
বাড়তি দামেও লোভনীয় অফারে আকৃষ্ট ক্রেতারা রিহ্যাব ফেয়ার স্টলে ফ্ল্যাট ক্রেতা

ঢাকা: রাজধানীর আফতাব নগরের বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত বেসরকারি কর্মকর্তা মো. শফিক সরকার। চাকরি জীবনে সিটি ব্যাংকের একটি শাখার ম্যানেজার ছিলেন।

চাকরি জীবনের সামান্য সঞ্চয় এবং অবসর সুবিধা হিসেবে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে স্থায়ী আবাসনের সন্ধানে এসেছেন আবাসন মেলায়। সাধ্যের মধ্যে খুঁজছেন মাঝারি আকারের ফ্ল্যাট। দুপুরে মেলায় ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন তিনি। মেলায় যেখানেই অফার বা ছাড় দেখছেন সেখানেই থেমে দাম জানা থেকে শুরু করে মনের ভেতর থাকা নানা প্রশ্ন স্টল কর্মকর্তাদের জিজ্ঞেস করছেন।

কি ধরনের ফ্ল্যাট খুঁজছেন জানতে চাইলে শফিক সরকার বাংলা নিউজকে বলেন, আমরা মধ্যবিত্ত পরিবার, তাই ১৫০০ স্কয়ার ফিটের ফ্ল্যাট খুঁজছি। আমার মূলত পছন্দ আফতাব নগর এবং খিলগাঁও এলাকা। আমি জানতে পারি মেলা থেকে ফ্ল্যাট কিনলে কোম্পানিগুলো ভালো অফার এবং ডিসকাউন্ট দেয়। আমার বাসার সামনে 'সেবা হোল্ডিং' এর একটা বিল্ডিং হচ্ছে। তাদের স্টল দেখলাম দাম বেশি চাচ্ছে। কিন্তু সঙ্গে ভালো অফার দিয়েছে, ফ্ল্যাট কিনলে হজে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেবে। এটা আমার পছন্দ হয়েছে, বাকিটা পরিবারের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেব।

সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করে এমন সব অফার 'সেবা হোল্ডিংস'র মতো মেলায় অংশ নেওয়া বেশির ভাগ কোম্পানিগুলো দিচ্ছে। কোনো কোনো কোম্পানি আবার ফ্ল্যাটের মোট দামের উপর সরাসরি ৫ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত ডিসকাউন্ট দিচ্ছে। এমন সব লোভনীয় অফার মেলায় আসা বেশিরভাগ ক্রেতাদের আকৃষ্ট করছে।

শুক্রবার (২৩ ডিসেম্বর) সকাল থেকে সরেজমিনে রাজধানীর আগারগাঁও’র বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আবাসন খাতের সবচেয়ে বড় সংগঠনের মেলা 'রিহ্যাব ফেয়ার- ২০২২'  প্রাঙ্গণ ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে। বেলা যত বাড়ছে ক্রেতাদের ভিড়ে মেলা প্রাঙ্গণ পরিপূর্ণ হচ্ছে। ক্রেতারা মেলা ঘুরে ঘুরে দেখছেন। তাদের মনে ফ্ল্যাট সংক্রান্ত যত প্রশ্ন আছে তা জিজ্ঞাসা করছেন স্টলে ঘুরে ঘুরে। অনেকে আবার তার বাজেট অনুযায়ী ফ্ল্যাট খুঁজছেন। পাশাপাশি কোম্পানিগুলো ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে নানা লোভনীয় অফার দিচ্ছে।  

ফ্ল্যাট কেনার বিষয়ে ব্যাংকের সহযোগিতা এবং বিল্ডার্স কোম্পানির সহযোগিতা প্রয়োজন বলে মনে করেন রাজধানীর দক্ষিণ বনশ্রীর বাসিন্দা (ক্রেতা) মো. শাহজাদা সরকার।

তিনি বলেন, ফ্ল্যাটের দাম এমন হওয়া প্রয়োজন যাতে করে সাধারণ মানুষ ফ্ল্যাট কিনতে পারেন। যেখানে মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্তরা (বিশেষ করে কম বেতনে চাকরি করে তার) কিনতে পারে সে রকম ফ্ল্যাট নীতি আমাদের থাকা উচিত। এ ব্যাপারে আমাদের বেশি বেশি কথা বলতে হবে। এ বিষয়ে সরকারের যেমন এগিয়ে আসতে হবে একইভাবে বিল্ডার্স কোম্পানিগুলোকেও এ বিষয়ে চিন্তা করা উচিত।  

বনশ্রীর বাসিন্দা শাহজাদা বলেন, এবারের আবাসন মেলা ভালোই হয়েছে। মেলায় এক সঙ্গে অনেক কোম্পানির সঙ্গে কথা বলে দামের পার্থক্য করা যাচ্ছে। মেলায় এসে ফ্ল্যাট সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যাচ্ছে। তবে মেলায় বেশিরভাগ স্টলই ফ্ল্যাটের দাম খুব বেশি চাচ্ছে। ৮০ লাখ থেকে এক কোটি টাকার বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে বেশির ভাগ (মাঝামাঝি আকারের) ফ্ল্যাট। এত দামে সাধারণ মানুষের কেনা খুব কষ্টকর হয়ে যায়।  

আবাসন খাতের সবচেয়ে বড় আয়োজন ‘রিহ্যাব ফেয়ার ২০২২’ শুরু হয়েছে গত বুধবার (২১ ডিসেম্বর)। যা চলবে ২৫ ডিসেম্বর দুপুর দুইটা পর্যন্ত। মেলা শুরু হওয়ার পর থেকে প্রতিদিন ভিড় বাড়ছে ক্রেতাদের। পাশাপাশি ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে কোম্পানিগুলো দিচ্ছে আকর্ষণীয় ছাড়। বেশির ভাগ কোম্পানিগুলো ফ্ল্যাটের মোট দামের উপর সরাসরি ৫ থেকে ২০ শতাংশ ডিসকাউন্ট দিচ্ছে। আবার কোনো কোনো কোম্পানি নানা রকম গিফট অফার করছেন যেমন, গাড়ি, টিভি, কাপল ট্রিপ ও হজের টিকেট ইত্যাদি।  

মেলায় ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের জন্য লোন বাবদ ৭ দশমিক ৫ থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত সুদের ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন।

মেলা উপলক্ষে ডাচ বাংলা ব্যাংক সুদের হার ৮ দশমিক ৫ শতাংশ হারে দিচ্ছে। পাশাপাশি অন্য ব্যাংকে যদি কারো লোন থাকে সে ক্ষেত্রে টেক ওভারের ক্ষেত্রে ডাচ বাংলা ৮ শতাংশ হারে লোন দিচ্ছেন। এখানে সর্বোচ্চ ২৫ বছর মেয়াদি দুই কোটি টাকা পর্যন্ত হোম লোন পাবে একজন গ্রাহক।

মধ্যবিত্তদের আবাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ব্রাক ব্যাংক সর্বনিম্ন ৭দশমিক ৫ শতাংশ হারে গ্রাহকদের লোন দিচ্ছে। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স কর্পোরেশন (আইএফসি) সঙ্গে যৌথ উদ্দোগে ব্রাক ব্যাংক মধ্যবিত্তের আবাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য গ্রাহকদের এ হোম লোনের ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। সর্বোচ্চ ৮৫ লাখ টাকা পর্যন্ত লোনের ক্ষেত্রে এ ৭.৫ শতাংশ সুদ হার পাওয়া যাবে।

মেলায় প্লট বুকিংয়ের উপর ৫০ শতাংশ ছাড় দিচ্ছে পূর্বাচল মেরিন সিটি। তাদের কাঠা প্রতি বুকিং সারাবছর ১০ হাজার টাকা। তবে মেলা উপলক্ষ্যে তারা কাঠা প্রতি ৫০ শতাংশ ছাড়ে ৫ হাজার টাকা করে বুকিং রাখছেন।  

মগবাজার এবং উত্তরায় ( ২১৫০ থেকে ২২০০ স্কয়ার ফিট) রেডি ফ্ল্যাট কিনলে ২ টনের এসি উপহার দিচ্ছেন 'এবিসি রিয়েল এস্টেট' কোম্পানি। কোম্পানির সেলস ও মার্কেটিং ম্যানেজার ফয়সাল বাংলা নিউজকে বলেন, মেলায় যদি কেউ আমাদের ফ্ল্যাট বুকিং দেয় তাদের আমরা আকর্ষণীয় ছাড় দিচ্ছি।  

মেলা চলাকালীন সময়ে যে কোনো ফ্ল্যাটের জন্য বুকিং করলে ১০ শতাংশ ছাড় দিচ্ছে 'এশিউর গ্রুপ'। এশিউর গ্রুপের মার্কেটিং এবং সেলস অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার মো. আবুল বাশার নিশান বলেন, আমাদের মিরপুরে সর্বনিম্ন ৮ হাজার টাকা স্কয়ার ফিটে ফ্ল্যাট পাওয়া যাচ্ছে। আর গুলশানে সর্বোচ্চ ৩০ হাজার টাকা স্কয়ার ফিটে ফ্ল্যাট পাওয়া যাচ্ছে।

আবাসন ব্যবসায়ী ও গৃহনির্মাণ শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রড, ইট, বালু, সিমেন্ট, শ্রমিক খরচ বৃদ্ধিসহ অন্যান্য বায় বেড়ে যাওয়ায় নির্মাণ ব্যয় বেড়ে গেছে ৩৫ থেকে ৪৩ শতাংশ। দাম বাড়ায় এখন অনেক আবাসন ব্যবসায়ী নতুন করে কোন প্রজেক্ট হাতে নিচ্ছে না। যার ফলে রেডি ফ্ল্যাটের উপর চাপ বাড়ছে। অন্যদিকে নতুন প্রজেক্ট কমে যাওয়ার ফলে আগামী বছর ফ্ল্যাট সংকট দেখা দিতে পারে বলে ধারণা করছেন আবাসন খাত সংশ্লিষ্টরা।

সেবা হোন্ডিংস এর ডেপুটি ম্যানেজার (সেলস) শরীফ আহমেদ বলেন, সামনে ফ্ল্যাটের বড় ধরনের সংকট হতে পারে একই সঙ্গে দাম সাধারণের নাগালের বাইরে চলে যাবে।  

তিনি বলেন, বেশির ভাগ কোম্পানিগুলোতে বর্তমানে নতুন প্রজেক্ট সাইন হচ্ছে না। সেক্ষেত্রে দাম বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। রেডি ফ্ল্যাট আগে যেখানে ছিল পাঁচ হাজার টাকা স্কয়ার ফিট, তা এখন আট হাজার টাকায় বিক্রি করলেও আমাদের তেমন লাভ থাকছে না।  

মেলা সম্পর্কে সেবা হোন্ডিংস’র ডেপুটি ম্যানেজার (সেলস) শরীফ আহমেদ বলেন, মেলায় সব কোম্পানি তাদের প্রোডাক্টগুলোর প্রেজেন্টেশন করে। তবে বিগত দিনের মেলাগুলোর তুলনায় এবারের মেলায় শুরুতে ক্রেতা কম ছিল। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্রেতার ভিড় বাড়ছে।  

সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করে ডোম- ইনো ছোট এবং মাঝারি আকারের ফ্লাট বিক্রি করছেন বলে জানান ডোম-ইনো'র অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার তানিজিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, আমাদের মিরপুর এলাকায় ১২০০-১৫০০ স্কয়ার ফিট, উত্তরাতে ১৫০০-২৫০০ স্কয়ার ফিট, ফার্মগেট জোনে ১ হাজার থেকে ১৩০০ স্কয়ার ফিট, শান্তিনগর ১ হাজার ১০ থেকে ২২০০ স্কয়ার ফিট ফ্ল্যাট আছে। এসব এলাকায় বর্তমানে ফ্ল্যাটের রেট চলছে প্রতি স্কয়ার ফিট ৭ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত।

ডোম-ইনো'র এ অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার বলেন, নির্মাণ সামগ্রীর বৃদ্ধির কারণে প্রতিনিয়ত ফ্ল্যাটের দাম বাড়ছে। গত বছরের তুলনায় এ বছর প্রতি ফ্ল্যাটে দাম ১০-২০ শতাংশ বেড়েছে। যা সামনে আরও বাড়তে পারে। তাই ফ্ল্যাটে ইনভেস্ট করার এখনই উত্তম সময় বলে মনে করেন এ কর্মকর্তা।  

বাংলাদেশ সময়: ১৪৪৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৩, ২০২২
ইএসএস/জেএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।