ঢাকা, মঙ্গলবার, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ খাতে বিনিয়োগের বিকল্প নেই

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮২৫ ঘণ্টা, মার্চ ১৮, ২০২৩
ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ খাতে বিনিয়োগের বিকল্প নেই

ঢাকা: তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সভাপতি ফারুক হাসান বলেছেন, বিগত সময়ে আমরা যে মডেল ফলো করে শিল্পকে এগিয়ে নিয়েছি, তার ওপর ভিত্তি করে আগামীতে কাঙ্খিত প্রবৃদ্ধি অর্জন করা কঠিন হবে। আমাদের বেশ কিছু বিষয়কে অগ্রাধিকার দিতে হবে।

আগামীতে আমাদের প্রতিযোগী সক্ষমতা বাড়াতে বিশেষ পদক্ষেপ নিতে হবে। বিশেষ করে ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজখাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই।

তিনি বলেন, বিশেষভাবে, নন-কটন খাতে আমাদের বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। বিগত চার দশকে আমাদের তৈরি পোশাক রপ্তানি ৪৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছালেও আমাদের পণ্যের ম্যাটেরিয়াল ডাইভারসিফিকেশন হয়নি।

শনিবার (১৮ মার্চ) রাজধানীর উত্তরায় বিজিএমইএ কমপ্লেক্সে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।

লিখিত বক্তব্যে ফারুক হাসান বলেন, কোভিড-১৯ এর ক্ষত সেরে উঠতে না উঠতেই আমরা একটি নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছি। সাম্প্রতিক সময়ে ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনার কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে এক অস্থির পরিস্থিতি বিরাজ করছে, যার প্রভাব পড়েছে আমাদের অর্থনীতি ও শিল্পে।

আমাদের প্রধান বাজারগুলোতে, বিশেষ করে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি রেকর্ড পর্যায়ে পৌঁছেছে। এসব উন্নত দেশের ভোক্তারা ভোগ্যপণ্যের ব্যয় কমিয়ে দিয়েছেন, ফলে কমে আসছে পোশাকের চাহিদা। তাই পোশাকের অর্ডার কমিয়ে দিয়েছে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো। তবে অফ প্রাইস বা ডিসকাউন্টেড পণ্যের প্রতি ক্রেতাদের আগ্রহ বাড়ছে।

আবার আমরা দেখছি যে ক্রেতারা তাদের সোর্সিং কৌশল পরিবর্তন করছেন, একসঙ্গে বড় অর্ডার না দিয়ে ছোট ছোট প্লটে অর্ডার দিচ্ছেন, ফলে কারখানা পর্যায়ে আমাদের উৎপাদন পরিকল্পনা বিপর্যস্ত হচ্ছে।

অপরদিকে, বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য নীতিতে যে পরিবর্তনগুলো আসছে সে বিষয়গুলোতে আমাদের যথেষ্ট প্রস্তুতির প্রয়োজন আছে নতুবা আমাদের বড় ধরনের সংকটের মধ্যে পড়তে হবে। বিশেষ করে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, মানবাধিকার ও ডিউ ডিলিজেন্স প্রটোকল গ্রহণ করছে, যেগুলো প্রতিপালন করতে আমাদের সক্ষমতা তৈরি করতে হবে। আবার এ প্রটোকলগুলো ভোক্তা পর্যায়ে যেন কোনো হয়রানি  তৈরি না করে সে বিষয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে।

এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য আমরা সরকারের সঙ্গে একান্তভাবে কাজ করে যাচ্ছি। আমরা নেশন ব্র্যান্ডিংয়ের পাশাপাশি অ্যাপারেল ডিপ্লোমেসি উদ্যোগ নিয়ে কাজ করছি, যা আপনারা দেখছেন। বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তোরণের পথটি মসৃণ করতে ট্রানজিশন পিরিয়ড বাড়িয়ে ছয় বছর করার জন্য আমরা সরকারের মাধ্যমে সব প্রেফারেন্স গিভিং দেশগুলোকে অনুরোধ করছি।

তবে আশার বিষয় হচ্ছে, এতসব চ্যালেঞ্জের মধ্যে থেকেও আমরা রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে পেরেছি। ২০২২ সালে আমাদের পোশাক রপ্তানি হয়েছে ৪৫ দশমিক ৭০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যা ২০২১ এর তুলনায় ২৭ দশমিক ৬৪ শতাংশ বেশি। আর ২০২৩ এর জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে আমাদের মোট পোশাক রপ্তানি হয়েছে ৮ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ২০২২ এর একই সময়ের তুলনায় ১০ দশমিক ১২ শতাংশের বেশি। তবে আমরা যে প্রবৃদ্ধি দেখছি তা মূলত মূল্যভিত্তিক প্রবৃদ্ধি। কিন্তু পরিমাণের দিক থেকে কোনো প্রবৃদ্ধি হয়নি, বরং ঋণাত্মক হয়েছে।

রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধির পেছনে মূলত তিনটি কারণ রয়েছে: প্রথমত, বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি, জ্বালানি তেলসহ অন্যান্য কাঁচামালের মূল্য বাড়ার কারণে আমাদের উৎপাদন খরচ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। যার প্রভাব পোশাকের মূল্যের ওপর পড়ছে।

দ্বিতীয়ত, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমাদের শিল্পে উচ্চ-মূল্য সংযোজিত পণ্যে উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ হয়েছে। আমাদের বেশ কিছু কারখানা অপেক্ষাকৃত উচ্চ মূল্যে পণ্য রপ্তানি করছে যেমন- জ্যাকেট, এক্টিভ ওয়্যার এবং স্যুট। এর ফলে পোশাকের ইউনিট প্রাইস বেড়েছে। অতএব, আমাদের যে হারে মূল্যভিত্তিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে সেই অনুপাতে পরিমাণভিত্তিক/ভলিউমে প্রবৃদ্ধি হয়নি।

তৃতীয়ত নতুন বাজারগুলোতে রপ্তানির ক্ষেত্রেও আমরা ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। ২০০৯-১০ অর্থবছরে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সরকার বাজার বহুমুখীকরণের জন্য যে প্রণোদনা দিয়েছিল, তার ফলে অপ্রচলিত বাজারগুলোতে আমাদের পোশাক রপ্তানি উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে

• ২০০৮-০৯ অর্থবছরে নতুন বাজারে পোশাক রপ্তানি ছিল ৮৪৯ মিলিয়ন ডলার, শেয়ার ছিল ৬ দশমিক ৮৭ শতাংশ।

• ২০২১-২২ অর্থবছরে নতুন বাজারে পোশাক রপ্তানি ছিল ৬ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন, শেয়ার ছিল ১৪ দশমিক ৯৬ শতাংশ।

• চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি সময়ে নতুন বাজারে পোশাক রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৫ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার, শেয়ার ছিল ১৮ দশমিক ১৩ শতাংশ।

• চলতি অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে ভারতে রপ্তানি হয়েছে ৭৫৩ দশমিক ৯২ মিলিয়ন ডলার, প্রবৃদ্ধি ৬১ দশমিক ৫৭ শতাংশ, জাপানে ১ দশমিক ০৮ বিলিয়ন ডলার, প্রবৃদ্ধি ৪৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ, দক্ষিণ কোরিয়ায় ৩৮৭ দশমিক ৬৩ মিলিয়ন ডলার, প্রবৃদ্ধি ৩৯ দশমিক ৮১ শতাংশ।

এছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে আমাদের রপ্তানি বেড়েছে। বিশেষ করে সংযুক্ত আরব আমিরাতে ১৮ দশমিক ৪০ শতাংশ, সৌদি আরবে ৪৭ দশমিক ০৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।

আমরা এসব নতুন বাজারগুলোতে সম্ভাবনা উন্মোচনের জন্য নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যাচ্ছি। গত মাসে বাণিজ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে আমরা সৌদি আরব সফর করেছি এবং সেখানকার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে সৌদি আরবে আমাদের রপ্তানি বাড়ার জন্য বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সভা করেছি।

আপনারা জানেন যে, গত বছরে আমরা দক্ষিণ কোরিয়া সফর করেছি এবং সেখানে বাজার সম্প্রসারণের সুযোগ এবং বিনিয়োগের সম্ভাবনা নিয়ে আমরা সেখানকার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করেছি। এছাড়া, গত ২ বছরে বেশ কয়েকবার ভারত সফর করেছি এবং সেখানে দ্বি-পাক্ষিক বাণিজ্য বাড়াতে আলোচনার পাশাপাশি আমরা কীভাবে সাপ্লাই চেইন কোলাবোরেশন করতে পারি, বিশেষ করে কাঁচামাল আমদানি সহজ করাসহ অন্যান্য বিষয়গুলো নিয়ে সেখানে রোড শো ও সভা করেছি। এ বছরের মে মাসে বিজিএমইএ থেকে আমরা অস্ট্রেলিয়াতে বাংলাদেশ অ্যাপারেল সামিট আয়োজন করতে যাচ্ছি। এ ব্যাপারে আমরা আপনাদের বিশদভাবে পরবর্তীতে জানাবো।

২০১৮-১৯ অর্থবছরের রপ্তানি অনুযায়ী আমাদের মোট পোশাক রপ্তানির প্রায় ৭৪ দশমিক ১৪ শতাংশই ছিল কটনের তৈরি, যা ১০ বছর আগে ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ছিল ৬৯ শতাংশ, অর্থাৎ বিগত ১০ বছরে আমাদের শিল্পটির কটন নির্ভরতা বরং বেড়েছে। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ মোট ২০ লাখ ৫২ হাজার টন ফাইবার আমদানি করে, যার ৯৩ দশমিক ৫৭ শতাংশ ছিল কটন। যেখানে বিশ্বের মোট টেক্সটাইল কনজাম্পশনের প্রায় ৭৫ শতাংশই নন-কটন এবং কটনের শেয়ার মাত্র ২৫ শতাংশ। বর্তমানে বৈশ্বিক পোশাক বাণিজ্যের ৫২ শতাংশ পণ্য নন-কটনের, সেখানে আমাদের রপ্তানির মাত্র ২৬ শতাংশ নন-কটন।  

বর্তমান বিশ্বে ভোক্তাদের ক্রমাগত জীবনযাত্রার পরিবর্তন এবং টেকসই ও পরিবেশবান্ধব পোশাকের চাহিদা বাড়ার পরিপ্রেক্ষিতে নন- কটনের পণ্য চাহিদা বাড়ছে। সুতরাং এখাতে আমাদের বিপুল সম্ভবনা রয়েছে। আমরা যদি নন-কটনে আমাদের শেয়ার বাড়াতে পারি তবে আমাদের রপ্তানি বাড়বে, নতুন বিনিয়োগ আসবে, কর্মসংস্থান বাড়বে, এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সেবা খাতে ব্যাপক সুযোগ তৈরি হবে। সর্বোপরি সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ রাজস্ব আহরণের পরিমাণ বাড়বে।

সংবাদ সম্মেলনে আর‌ও উপস্থিত ছিলেন বিজিএমইএ'র পরিচালকরা ও পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা ।  

বাংলাদেশ সময়: ১৮২৫ ঘণ্টা, মার্চ ১৮, ২০২৩
এমকে/আরআইএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।