ঢাকা, শনিবার, ১৯ পৌষ ১৪৩১, ০৪ জানুয়ারি ২০২৫, ০৩ রজব ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

পোশাক খাত: সংকট কাটিয়ে সম্ভাবনার হাতছানি

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭১৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১, ২০২৫
পোশাক খাত: সংকট কাটিয়ে সম্ভাবনার হাতছানি

ঢাকা: ২০২৪ সালে নানাবিধ সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে তৈরি পোশাক খাত। বহুবিধ সংকটে দেশের প্রধান রপ্তানি শিল্প যেমন ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে তেমনি সমস্যার আড়ালে সমাধানের নতুন দিগন্তও দেখা গিয়েছে।

বিদায়ী বছরের সবচেয়ে বড় ঘটনা ছিল ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী সরকারের পতন, যা দেশের পোশাক খাতকেও ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সময়ে সৃষ্ট শ্রমিক অসন্তোষ ও পোশাক শিল্পের ঝুট ব্যবসার দখলকে কেন্দ্র দীর্ঘ সময় ধরে শ্রম অসন্তোষ চলতে থাকে। শ্রম অসন্তোষের দিনপঞ্জি অনুযায়ী ২০২৪ সালে ১৪০টি কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। এর মধ্যে তৈরি পোশাক শিল্পের ৭৬টি, নিট পোশাক কারখানার ৫০টি এবং টেক্সটাইল খাতের ১৪টি কারখানা রয়েছে। আর এ জন্য কর্ম হারিয়েছেন প্রায় এক লাখ শ্রমিক।

পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, ২০২৩ সাল শেষে পোশাক খাতে শ্রমিকদের জন্য বৃদ্ধি পাওয়া প্রায় ৫৬ ভাগ মজুরি কার্যকর করার মধ্যেই জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি, চাহিদামতো ঋণের যোগান না পাওয়া, শিল্পজুড়ে শ্রম অসন্তোষ, সুদহার বেড়ে যাওয়া, পোশাক শিল্পের প্রণোদনার ৬০ ভাগ তুলে দেওয়ার ঘোষণা এবং  আইনশৃঙ্খরার অবনতির ঘটনা ঘটে। এসব সমস্যা তৈরি পোশাক শিল্পে সংকট তৈরি করলেও অতীতের পোশাক শিল্পের শিশুশ্রম বন্ধে সৃষ্ট সংকট, রানা প্লাজা বিপর্যয়ের সময় বিশ্বজুড়ে ইমেজ সংকট ও কোভিড-১৯ মহামারির মোকাবিলা করে দক্ষতা অর্জনের মতোই বড় সংকট মোকাবিলার নতুন দরজা খুলে গেছে।

বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির প্রভাব

গত বছর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধও বিশ্বজুড়ে প্রভাব ফেলে, তৈরি করে অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা। বছরজুড়ে তেলের বাজারের ওঠানামার কারণে বিশ্বজুড়ে মূল্যস্ফীতি ঘটে। দেশও মূল্যস্ফীতির মুখোমুখি হয়। এতে ভোক্তাদের ওপর ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি করে, ক্রয় ক্ষমতা প্রভাবিত হয়। এ সময় ইউরোপের বাজারের ক্রেতারা তৈরি পোশাক ক্রয়ে ৫ শতাংশ দাম কমিয়েছে।

উদ্যোক্তারা জানান, বছরজুড়ে মজুরির পাশাপাশি, গ্যাস, বিদ্যুৎ এবং পরিবহনের দাম বৃদ্ধির কারণে অন্যান্য উৎপাদন খরচ বেড়েছে, সাথে ক্রমবর্ধমান ব্যাংকের সুদের হার বাড়তি চাপ তৈরি করেছে।  ব্যাংক সুদের হার ১৪ শতাংশ ১৫ শতাংশে ওঠে। এসব বাড়তি চাপের কারণে অনেক ছোট এবং মাঝারি ধরনের কারখানা ক্ষতির সম্মুখীন হয়, যার ফলে সারা বছর ধরে তৈরি পোশাক শিল্প সংকটকাল পার করেছে।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের কারণে দেশে নতুন স্বপ্নের সঞ্চার হয়েছে। কিন্তু তৈরি পোশাক শিল্পকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়ে গণআন্দোলন চরম আকার ধারণ করলে তৈরি পোশাক শিল্পে এর প্রভাব পড়ে। এর সাথে যুক্ত হয়, আন্দোলন চলাকালে দেশব্যাপী ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট, যা বিদেশে ক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগে বাধা তৈরি হয়। সংকট তৈরি হয় ক্রয়াদেশ নিতে ও পোশাক জাহাজিকরণে। অথচ ওই সময়টাই ছিল তৈরি পোশাকের বড় মৌসুম শীত ও ক্রিসমাস ক্রয়াদেশের। ফলে বছর শেষে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মূল্যস্ফীতি কমে আসা ও অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর শুরুর প্রেক্ষাপটে পোশাক রপ্তানি যে হারে বৃদ্ধি হওয়ার কথা ছিল, সে হারে তৈরি পোশাক রপ্তানি বাড়েনি।

বিজিএমইএৎএর সাবেক পরিচালক শোভন ইসলাম বলেন, শুরু থেকে আমরা অনেকগুলো সমস্যা ফেস করেছি। এর মধ্যে লোহিত সাগরে ঝামেলা ছিল, ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ চলছিল এবং তেলের দাম বেড়ে গিয়ে বছরের শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এতে চাহিদা কমে গিয়েছিল। এ জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে গ্রোথ বেশি একটা হয়নি। কিন্তু পুরো বিষয়টিকে বিবেচনা করলে এটা ১১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।

তিনি বলেন, আমরা দুই ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হয়েছি। প্রথম হলো বৈশ্বিক ও দ্বিতীয়ত অভ্যন্তরীণ ফাইনান্সিয়াল প্রবেলম। আমাদের অর্থিক খাত খুবই অস্থির ছিল। বিশেষ করে ব্যাংক খাতটা খুবই অস্থির ছিল। এত বড় একটি খাত যেখান থেকে ৮৪ ভাগ রপ্তানি হয়। বছরের শুরু থেকে মাঝমাঝি এসে আর্থিক খাত মুখ থুবড়ে পড়ার অবস্থা তৈরি হয়। ব্যাংকগুলো তারল্য সমস্যা চরম আকার ধারণ করে। টাকার মানের অবনতি হয়। যদিও রপ্তানি ক্ষেত্রে এটা ইতিবাচক। তবে ওভারঅল ক্ষতি গুনতে হয়।

শোভন ইসলাম বলেন, রাজনৈতিক বিষয়ে আমি বলতে চায় না; ফাইনান্সিয়াল প্রেক্ষিতে থেকে বলতে চাই। এ সময়ে বাণিজ্যে অস্থিরতা তৈরি হলেও ব্যাংকিং খাতের উন্নয়নে যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, এটা ইতিবাচক দিক। রেগুলেটরি, রেস্ট্রিকশন তৈরিতে সরকার যে পদক্ষেপ নিয়েছে, এতে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। যদিও ব্যাংক খাতে তারল্য সমস্যা আছে, কিন্তু একটি ইতিবাচক দিকে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে ধন্যবাদ দিতে হয় যে, তিনি ব্যাংক খাতকে স্থিতিশীল করতে সমর্থ হয়েছেন। এটা আমাদের অনেক সাহায্য করবে। কিন্তু এই সময়ে শ্রমিক অসন্তোষ হয় এবং আইনশৃঙ্খলার অবনতি হয় আমরা এই অস্থীতিশীল অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছি। ভালমন্দ মিলে এটাই আমাদের চ্যালেঞ্জিং বছর;  উল্লেখ করেন  এই উদ্যোক্তা নেতা।

চলতি বছরে রপ্তানিতে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে বাংলাদেশ পোশাক খাত। প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় রপ্তানি আয়ে পিছিয়ে পড়েছে। এই চ্যালেঞ্জের মধ্যেই বাংলাদেশ ১১ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে। কিন্তু এই প্রবৃদ্ধি তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় আমরা পিছিয়ে পড়েছি। সারা বিশ্বে তৈরি পোশাকের ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। সেখানে  আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলোর প্রবৃদ্ধি এর চেয়ে বেশি। সেখানে ভারতের ১৩ শতাংশ এবং ভিয়েতনামের ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।

নতুন বছরে চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি সম্ভাবনা

নানামুখি সমস্যার পাশাপাশি সম্ভাবনাও দেখা দিয়েছে পোশাক খাত। এ বিষয়ে শোভন ইসলাম বলেন, আমরা বায়ারের যে কাজগুলো করি, কাজগুলো একটি চুক্তি ভিত্তিক কাজ। আমরা যে কাজটি করি সেগুলো ঠিকমতো এবং সময়মতো ডেলিভারি দেই। সারা দেশে আমাদের যে ইমেজ সংকট হয়েছে, যেকোনভাবেই স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার মধ্য দিয়ে ইমেজ পুনরুদ্ধার নিশ্চিত করতে হবে; এটা প্রথম অগ্রাধিকার। এরপর দ্বিতীয় অগ্রাধিকার হলো, সরকারের প্রতি অনুরোধ যেকোনোভাবেই হোক আইনশৃঙ্খলা পুরোপুরি ফিরিয়ে আনা ও আইনের শাসন নিশ্চিত করা। এটা যদি নিশ্চিত করা যায় তাহলে পরিবর্তিত অবস্থার প্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রে যে সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে, সেটা কাজে লাগানো সম্ভব হবে।

পোশাক রপ্তানিতে ইতিবাচক দিক

সমস্যার মুখোমুখি হলেই তৈরি পোশাক নতুন সম্ভাবনার দিগন্তের প্রবেশ করেছে। দেশের পোশাক শিশু শ্রম সংকট, রানা প্লাজা বিপর্যয় ও করোনা মহামারির সময়ে তৈরি পোশাক সংকটে পড়ে। কিন্তু প্রতিবারই সংকটকে সক্ষমতার সাথে মোকাবিলা করে ভালো কিছু হয়েছে। এগিয়ে গেছে তৈরি পোশাক শিল্প। ২০২৪ সালে যেসব সমস্যার মুখামেুখি হয়েছে পোশাক শিল্প, এগুলো পেছনে ফেলে আগামী বছরে সম্ভাবনা দেখছেন এখাতের উদ্যোক্তারা।

বিজিএমইএ-এর পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বাংলানিউজকে বলেন, নতুন সরকারের সময়ে অন্যতম সমস্যা ছিল ব্যাংক খাতের তারল্য সমস্যা ও উচ্চ সুদহার। গত সরকারের সময়ের এস আলম, সালমান এফ রহমানের মতো উদ্যোক্তাদেরর হাত থেকে ব্যাংক খাতকে বের করে আনা হয়েছে। এর ফলে এ খাতের প্রকৃত সমস্যাটা চিহ্নিত হয়েছে। আগামী বাড়তি সুদ হার ও তারল্য সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি সঠিক উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব হবে।

ট্যাক্স ভ্যাট সমস্যা

ট্যাক্স, ভ্যাট, নিবন্ধনসহ কাস্টমসের ক্ষেত্রে বাড়তি ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে পোশাক খাতকে। বিষয়টি নিয়ে আগের সময়ে রাজস্ব বিভাগের সঙ্গে কথা বলা যেত না। বর্তমান সরকারের সময়ে সমস্যাগুলো নিয়ে কথা বলা যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সমস্যাগুলো সমাধানের রাস্তা তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন মহিউদ্দিন রুবেল।

হঠাৎ বন্যায় সড়কের সমস্যা

২০২৪ সালে বন্যার কারণে রপ্তানিতে সমস্যা হয়েছে। এমন সমস্যায় আগে কখনো পড়তে হয়নি উদ্যোক্তাদের। এ সমস্যা সমাধানে বিকল্প সড়কের পাশাপাশি মোংলা বন্দর ব্যবহারের যৌক্তিকতা তৈরি হয়েছে।

শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক উন্নয়ন

২০২৪ সালে বড় শ্রমিক অসন্তোষের কারণে শ্রমিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে নতুন অভিজ্ঞতা দেখছেন এ খাতের উদ্যোক্তারা। প্রথমত, শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে কারখানার নিরাপত্তা সৃষ্টি করা এবং প্রয়োজনে একাধিক এলাকায় শিল্প প্রতিষ্ঠান তৈরি করা, যাতে অন্য এলাকায় উৎপাদন সরিয়ে নিয়ে কার্যাদেশ সময় মতো ডেলিভারি করা যায়। আশুলিয়া থেকে অন্য এলাকায় উৎপাদন সরিয়ে অনেক রপ্তানি চেইন ঠিক রাখা সম্ভব হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের সরকার পরিববর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দেশের তৈরি পোশাক শিল্পের সামনে এক নতুন দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে। উদ্যোক্তারা মনে করছেন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট ব্যবসাবান্ধব। তিনি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অবসান করতে পারবেন। এর ফলে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র যে মূল্যস্ফীতিতে হাবুডুব খাচ্ছে তা থেকে বের হয়ে আসতে পারবে। আর এর ফলে বাংলাদেশের দুই প্রধান বাজার  নতুন করে প্রসারিত হবে। বাড়বে দেশের রপ্তানি আয়।

বাংলাদেশ সময়: ০৭১৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০১, ২০২৫
জেডএ/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।