ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

সব্জির রাজধানীতে এক দুপুর

চাষীর চাষে লজ্জা নেই!

মাহমুদ মেনন ও উত্তম ঘোষ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৪২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩, ২০১৬
চাষীর চাষে লজ্জা নেই! ছবি : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

যশোর থেকে ফিরে: টানা কোদাল চালিয়ে যাচ্ছিলেন চাষী সেরাজুল। মাঠে দিন কয়েক আগে ফুল কপি উঠে গেছে।

এবার শিমের চাষ ফেলবেন। দুপুরের কড়া রোদ। শীতের কাল হলেও ঠিক যখন মাথার ওপর সূর্য অবস্থান নেয় তখন তেজ কম থাকে না। সেদিকে সামান্য ভ্রুক্ষেপ নেই সেরাজুলের। কোদাল চালিয়ে চাষ দেওয়া জমিতে ঢ্যালাগুলো আরও গুড়িয়ে নিচ্ছিলেন।

শীতের দিনে রবিশষ্যের চাষে চাষীদের খাটুনি একটু বেশিই হয়। এক মওসুমে দুটি ফসল ফলিয়ে নেওয়ার সুযোগটা হাতছাড়া করেন না কেউই। তবে কেউ কেউ তিনটি ফসল তুলে নিতে চেষ্টা করেন। এবারের মওসুমে তিনটি ফসল ফলাতেই হবে সেরাজুলকে। সম্পন্ন গৃহস্থ হলেও এবছর ছেলেটির অসুস্থতায় লাখ পাচেক টাকা খরচ হয়ে গেছে, তাই বাবা হয়ে তাকে বাড়তি খাটুনিতে নামতে হয়েছে।

যশোর সদর উপজেলার চুড়ামনকাঠি ইউনিয়নে পাকা রাস্তার পাশে সেরাজুলের চাষের ক্ষেত। বাংলানিউজের ক্যামেরায় যখন ধরা পড়ছিলো তার কোদাল চালানো, আশেপাশের কিছুই যেনো অমনযোগী করতে পারছিলো না। একাগ্রচিত্তে কাজ করে যাচ্ছিলেন, আর তার সুচারু হাতে বিন্যস্ত হচ্ছিলো মাঠের মাটিগুলো।

অতঃপর মাথা তুললেন, বিষ্মিত হলেন, আর চাষীর চিরচরিত চেনা হাসিটা হাসলেন।

অনেক কাজ। কথা বলার ফুসরত নেই। তাও কিছুটা সময় দিলেন বাংলানিউজকে। চাষের প্রক্রিয়া বোঝালেন, জানালেন চাষের অর্থনীতিটাও।

পাশের জমি থেকে বাধাকপি কাটা হচ্ছিলো। ঝাঁকা বোঝাই করে পাশের পাকা সড়কে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাকে তোলা হচ্ছিলো সেই কপি। ওটি সেরাজুলের ভাইয়ের ক্ষেত। বললেন, এখানে ৯ শতাংশে ১ হাজার কপি উৎপাদন হয়েছে। প্রতি পিস পাঁচ টাকা দরে ৫ হাজার টাকার সব্জি ফললো এক চাষে।

এই চাষে খরচ কত? আর চাষীর লাভ কতো? সে প্রশ্নে ফের হাসি সেরাজুলের মুখে। জানালেন, এইটুকু জমিতে চাষ ফেলতে সাড়ে তিন থেকে চার হাজার টাকা নিদেন পক্ষে খরচ আছে। তাতে চাষীর আর কতই থাকে? সে প্রশ্নে বললেন, এবার বাজার খারাপ। আর শীত জেঁকে না পড়াতে বাধাকপি তেমন জমাট বাধতে পারেনি, আকার ছোট থেকে গেছে। ফলে পাঁচ টাকার ওপর দর উঠছে না। পুরোটাই চাষির কপাল। এবার হলো না, পরের চাষে হতে পারে, এই ভরসায় নতুন চাষ ফেলবে।

সেবারও যদি ক্ষতি হয়! তারপরেও কি চাষ করে যাবেন? উত্তরে সেরাজুল বললেন, ‘চাষীর চাষে লজ্জা নেই!’

‘ক্ষেতিতো ক্ষেত ফলাবেই। যা ফলে তাই সই। সব কিছুই আল্লাহর ইচ্ছা। ’

সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহের প্রতি তাকিয়ে গায়ে খেটে চাষীরা ফসল ফলান। মওসুমে তিনটি ফলন ফলাতে পারলে ঘরে কিছু না কিছু আয় ওঠেই। তবে খাটুনিটা গতরের ওপর দিয়ে যায়।

সেরাজুলকে এবার তিনটি ফসল তুলতে হবে। ফুলকপির পর এবার শিম দেবেন, আর সেটা উঠে গেলে চাষ ফেলবেন শসার। রমজানের কথা মাথায় রেখে শসার হিসাব। আশা করছেন তাতে দাম পাবেন আর মুনাফা হবে।

এরই মধ্যে আশপাশ থেকে এসে জড়ো হলেন আরও দুই চাষী। তারাও যোগ দিলেন আলোচনায়। জানালেন, নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করেই তারা ফসল ফলান। সবাই একই ফসল না দিয়ে বিভিন্ন রকম ফসলের চাষ করেন। এদের একজন এবার ফলিয়েছেন ভাঙ্গর বেগুন। মোটা লম্বাটে সবুজ রঙের একটি হাইব্রিড প্রজাতির এই বেগুন চোখে পড়েছে চুরামনকাঠি, হৈবতপুর এলাকায় ঘুরে প্রায় সর্বত্র। ২০ টাকা কেজি দরে এই বেগুন মাঠ থেকেই বিক্রি করতে পারছেন চাষীরা।  

এই হৈবতপুর ও চুড়ামনকাঠি সব্জির রাজধানী বলেই খ্যাত। দুটি ইউনিয়নের ভেতর দিয়ে ঘুরে ঘুরে তার সুস্পষ্ট প্রমাণ মিললো। শত রকমের সব্জির চাষ পড়েছে রাস্তার দুই ধারে বিস্তৃত মাঠে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে যশোর সদর উপজেলায় কেবল বেগুনেরই চাষ পড়েছে ৪৫০ হেক্টর জমিতে। এরমধ্যে হৈবতপুর ও চুড়ামনকাঠি ইউনিয়নের প্রায় ২৫০ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন জাতের বেগুন চাষ হয়েছে। এছাড়াও সদর উপজেলার ১০০ হেক্টর জমিতে পটল চাষ হয়েছে যার অর্ধেকই হৈবতপুর ও চুড়ামনকাঠি এলাকায়।

এছাড়াও রয়েছে কপি, পটল, টমেটো, কুমড়া, করলা, লাউ, কাকরোল, কাঁচা মরিচ, পুঁইশাকসহ বিভিন্ন ধরণের সবজি।

চাষীরা কেউ কেউ মাঠেই বিক্রি করে দিচ্ছেন। আর কেউ তুলে নিয়ে যাচ্ছেন সেখানকার বিখ্যাত সাতমাইল বাজারে। এরপর সেগুলো ব্যবসায়ীদের হাত ঘুরে ট্রাকযোগে চলে যাচ্ছে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বাজারে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, চলতি মওসুমে সদর উপজেলায় ১০০ হেক্টর জমিতে ফুল কপি, ৯০ হেক্টর জমিতে বাঁধাকপি, ৪০ হেক্টর জমিতে শালগমের চাষ হয়েছে। আর ৬০ হেক্টর জমিতে টমেটো চাষ হয়েছে। এরমধ্যে ১০ হেক্টর জমিতে আগাম জাতের টমেটো রয়েছে।

এছাড়াও সদর উপজেলার ২৫ হেক্টর জমিতে কাকরোল, ৪৪ হেক্টর জমিতে চিচিঙ্গা, ৪০ হেক্টর জমিতে ঝিঙা, ২৪০ হেক্টর জমিতে মিষ্টি কুমড়া, ১১০ হেক্টর জমিতে উস্তে, ১১০ হেক্টর জমিতে ডাঁটা, ২৫৮ হেক্টর জমিতে করলা, ৯৫ হেক্টর জমিতে পুঁইশাক, ৪৫ হেক্টর জমিতে ঢেঁড়শ, ৩৫ হেক্টর জমিতে লতি কচুঁ, ১৬০ হেক্টর জমিতে মুখী কচুঁ, ১০৫ হেক্টর জমিতে খিরাই, ৪০ হেক্টর জমিতে চাল কুমড়া, ৯৫ হেক্টর জমিতে লাউ, ৭৫ হেক্টর জমিতে কাচ কলা, ৬০ হেক্টর জমিতে বিচি কলা, ১১০ হেক্টর জমিতে সবুজ শাক, ২৫ হেক্টর জমিতে মেটে আলু, ১৫ হেক্টর জমিতে শঁসা, ৭৫ হেক্টর জমিতে ওল কঁচু, ৬০ হেক্টর জমিতে পেঁপে ও ১২০ হেক্টর জমিতে লাল শাকের চাষ করা হয়েছে।

যশোর সদর উপজেলা কৃষি অফিসার এস.এম খালিদ সাইফুল্লাহ বাংলানিউজকে বলেন, জেলার আটটি উপজেলার মধ্যে সদর উপজেলায় সবচেয়ে বেশি সবজি চাষ হয়। তবে সদর উপজেলার হৈবতপুর ও চুড়ামনকাঠি এলাকার ৯০ ভাগ জমিতে বারোমাস সবজি চাষ হওয়ায় ওই এলাকার নামই হয়ে গেছে সবজির রাজধানী।

ধানের উৎপাদন খরচের তুলনায় বিক্রি দাম কম হওয়ায় হৈবতপুর ও চুড়ামনকাঠি এলাকার কৃষকরা সবজি চাষে ঝুঁকে পড়েছেন। এছাড়াও দীর্ঘদিন সবজি চাষ করায় যে কোন সবজির ফলন ভালো হয়।

আর যেখানে চাষীর চাষে লজ্জা নেই সেখানে এমন ফলনতো ফলতেই থাকবে।

বাংলাদেশ সময় ০৮৪২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৩, ২০১৫

** পট পট পট, ফুটছে চাল... হচ্ছে মুড়ি (ভিডিও এক্সক্লুসিভ)
** এ ‘মণিহার’ আমায় নাহি সাজে!

** ধানের ফলনে কৃষকের হাসি, দামে বেজার
** শনিবারের বিশেষ প্রতিবেদন: যশোরের যশ, খেজুরের রস
** শুক্রবারের বিশেষ প্রতিবেদন: ‘জন্ম যদি তব বঙ্গে! তিষ্ঠ ক্ষণকাল’
** সুন্দরবন এক্সপ্রেস থেকে: আউশের চিড়া ও তার কারিগরের গল্প

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।