ঢাকা, বুধবার, ১০ পৌষ ১৪৩১, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

কেন ‘নির্বাক’ কাঁচা চামড়ার আড়তদাররা?

মাসুদ আজীম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৪৩ ঘণ্টা, আগস্ট ২৬, ২০১৮
কেন ‘নির্বাক’ কাঁচা চামড়ার আড়তদাররা?

ঢাকা: ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ী ও আড়তদারদের জন্য সবচেয়ে আনন্দের। বিশেষ করে পুরান ঢাকার আড়তদারদের কাছে। কিন্তু তা এখন ইতিহাসের গল্প মাত্র! এখানকার কাঁচা চামড়ার ব্যবসায়ীদের মতে বাংলাদেশের চামড়া শিল্প পুরোটাই ধ্বংসের মুখে।

চামড়া ব্যবসায়ীদের সূত্রে জানা গেছে, ঈদের আগে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা পাওনা ছিল ট্যানারি মালিকদের কাছ থেকে। গত কয়েক বছরের চামড়ার টাকা পরিশোধ করেনি তারা।

আর এ পরিস্থিতি শুরু হয়েছে যখন থেকে হাজারীবাগ থেকে চামড়া শিল্পকে সাভারের হেমায়েতপুরে সরানো শুরু হয়েছে।  

এদিকে চামড়া ব্যবসার ক্ষেত্রে খুচরা ব্যবসায়ীরা আড়তদারদের হাতে আর আড়তদাররা ট্যানারি মালিকদের হাতে বন্দি। কেননা এ শিল্পের ব্যাপক প্রসার নেই বাংলাদেশে। তাই টাকার সঙ্কুলান না পেয়ে বিপদে আছেন এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাও।  

আবার ট্যানারি মালিকরাও অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে উঠতে পারছে না বলে আড়তদাররা জানিয়েছেন। একারণে কাঁচা চামড়া আড়তে সংগ্রহের কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও চামড়ার ক্রেতা বা ট্যানারি মালিকদের দেখা মিলছে না এখনও। সব মিলিয়ে এ পরিস্থিতি চলমান থাকলে দেশের ভালো মানের চামড়া পাচার হয়ে যেতে পারে, এমনটাই আশঙ্কা আড়তদারদের। কারণ এ ছাড়া ব্যবসা টিকিয়ে রাখা বা চামড়া বিক্রেতাদের দেনা শোধ করার আর কোনো উপায় থাকবে না।

রোববার (২৬ আগস্ট) দেশের কাঁচা চামড়ার আড়তদারদের মূল কেন্দ্রবিন্দু রাজধানীর পোস্তা এলাকায় গিয়ে দেখা যায় সবার চোখে মুখে হাতশার চিত্র। অন্যান্য বছরের এ সময়ের হাসিখুশি আড়তদাররা কথাই বলতে চাইছেন না সাংবাদিকদের সঙ্গে। অনেক আড়তের মালিকরা পরিচয় গোপন করছেন।  

পরিবহন করা হচ্ছে চামড়া।  ছবি: শাকিল আহমেদ

ঈদের আগে বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মারচেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি দেলোয়ার হোসেন জানিয়েছিলেন, তাদের পাওনা প্রায় ৩০০ কোটি টাকা আটকে রেখেছে ট্যানারি মালিকরা। অথচ তারা প্রতি ঈদের আগেই ব্যাংক থেকে মোটা অংকের ঋণ নিতে পারছে বা নিচ্ছে। কিন্তু পরিশোধ করছে না।

আর ঈদের পর রোববার সংগঠনটির সিনিয়র সহ-সভাপতি সেকান্দার আলী বাংলানিউজকে জানিয়েছেন, এখনও প্রায় বিগত বছরের পাওনা ২০০ কোটি টাকা রয়ে গেছে। একজন আড়তদার সর্বোচ্চ তার মোট পাওনার ১৫ শতাংশ পেয়েছে। এভাবে তো ব্যবসা চালানো সম্ভব না।
এ বিষয়ে আজমত খাঁ নামের আরেক আড়তদার বাংলানিউজকে বলেন, আমরা হলাম এ ব্যবসার মধ্যস্বত্ত্বভোগী। আমরা যাদের কাছ থেকে চামড়া কিনি তাদের টাকা দিতে পারছি না। ট্যানারি মালিকরা ঈদের আগে ব্যাংকের শেষ কর্মদিবসে এসে অল্প কিছু টাকা দিয়েছে। আমি মাত্র ১০ শতাংশ টাকা পেয়েছি। যে কারণে প্রস্তুতিহীন ব্যবসা। অর্থাৎ আমি নিজেই জানি না যে কি পরিমাণ চামড়া নিতে পারবো! তাই চামড়া বিক্রেতাদের জানাতে পারি নাই এবং তাদের পাওনা তো পরের কথা, নিয়মানুসারে তাদের চামড়া কেনার টাকা সেভাবে দিতে পারি নাই। আর যেহেতু হাতে টাকা নেই তাই অবশ্যই চামড়া কম দামে কিনেছে ব্যবসায়ীরা। এ যাবৎকালের সর্বনিম্ন দাম এবার।

আবার লবণের জন্য চামড়া নষ্ট হচ্ছে ব্যাপক হারে উল্লেখ করে আরেক ব্যবসায়ী বলেন, লবণের দাম কোনো কারণ ছাড়াই বেড়েছে। দাম বাড়ানোর জন্য যোগান কমিয়ে দিয়েছে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে। আর আমাদের কাছে কোনো কেমিক্যাল নেই। আমরা কিনতেও পারি না। আমরা চামড়া সংগ্রহ করবো আর ট্যানারি মালিকরা তা নিয়ে যাবে টাকা দিয়ে। কিন্তু তারা এখনও আসছে না। কারণ তাদের কাছে দেবার মত কোনো টাকা নেই বলে জানাচ্ছে। আগের পাওনা টাকার হিসাব আমাদের বাদ দিতে হবে। কারণ তাদের না দেয়া ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় নেই। আবার চামড়ার মান আড়তে থেকে যেভাবে নষ্ট হচ্ছে তাতে রফতানি করাও সম্ভব হবে না। কিন্তু এগুলা ভালো মানের চামড়া ছিল।

এদিকে রাজ্জাক সন্সের মালিক রিজভী চৌধুরী জানান, এ ব্যবসায় আমরা কখনও টাকা বাকী রাখি নাই। কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ীদের টাকা আগেই দিয়ে দিয়েছি। তাই আমরা ভালো চামড়া পেতাম। এবার রাখতে হয়েছে। এবার তো আমাদের হাতে চামড়া এসেছে। এ অবস্থা চলমান থাকলে সামনের বার আমাদের হাতে কাঁচা চামড়া আসবে না। তার আগেই পাচার হয়ে যাবে।

এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, যারা আমাদের অবিভাবক তাদের অনেকেই ট্যানারি মালিকদের কাছ থেকে পুরো টাকা পেয়েছে। আমরা পাইনি। অথচ তারা টাকা পেয়ে ভালো ব্যবসা করে আমাদের সমস্যাগুলা দেখছে না। আমরা সংঘবদ্ধ থাকতে পারলে এতো সংকট সৃষ্টি হত না। সরকার যে দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে সে দামের কাছাকাছিতেও আমরা যেতে পারবো না। অনেক কম দামে চামড়া বিক্রি করতে হবে। সরকার বলছে চামড়া রফতানি করবে না, ট্যানারি মালিকরা এখনও আসছে না চামড়া কিনতে। এদিকে চামড়া পচে যাচ্ছে। এগুলা সব সিন্ডিকেটের অংশ। ট্যানারি মালিকরা এলে অন্তত যা দাম আছে তাতেই বেচা যেত। কিন্তু যা বুঝছি তারা যখন আসবে তখন আমাদের বাঁচার তাগিদেই লোকসানে চামড়া বিক্রি করতে হবে। সর্বোপরি সিন্ডিকেটই এ ব্যবসা ধ্বংস করছে। না ট্যানারি মালিকরা ঋণ নিয়ে শোধ করছে না আর সরকারও কিছু বলছে না কেন?

এ বিষয়ে বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মারচেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র সহ-সভাপতি হাজী সেকান্দার আলী বাংলানিউজকে জানান, যেমন ধরেন আমার ব্যবসা ছোট। আমি ট্যানারি মালিকদের কাছে অল্প টাকা পাইতাম। তারা তা দিয়ে দিয়েছে। ছোট ব্যবসায়ীরা পেলেও সবার তো ব্যবসা ছোট না। তবে বেশিরভাগ ব্যবসায়ীরাই টাকা পায় নি। এটাই মূল বিষয়।

বাংলাদেশ সময়: ০২৪০ ঘণ্টা, আগস্ট ২৭, ২০১৮
এমএএম/এসএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।