ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

ফুলের রাজধানী এখন ধূসর মাঠ, ঘুরে দাঁড়াতে প্রণোদনা প্রয়োজন

উত্তম ঘোষ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৪৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৩০, ২০২০
ফুলের রাজধানী এখন ধূসর মাঠ, ঘুরে দাঁড়াতে প্রণোদনা প্রয়োজন ফুলের ক্ষেত এখন ধূসর মাঠ। ছবি: বাংলানিউজ

যশোর: ফুলের রাজধানীখ্যাত যশোরের ঝিকরগাছার পানিসারার হাড়িয়া গ্রামের নারী ফুলচাষি সাজেদা বেগম। ২০০৪ সালে স্বামী ইমামুল হোসেন অসুস্থ হওয়ার পরে সংসারে হাল ধরেন সাজেদা।

অসুস্থ স্বামীর অনুপ্রেরণা আর স্বল্প পুঁজি নিয়েই বাড়ির পাশেই বর্গা নেওয়া ১০ কাটা জমিতে শুরু করেন জারবেরা ফুলচাষ। সততা আর উদ্যোমীর কারণে হয়েছিলেন সফলও।

বর্তমানে সাজেদার ফুলের বাগান দেড় একক। কিন্তু করোনা আর আম্ফান ঝড়ে সাজেদার সফলতার ফুলের বাগান ধ্বংসের মুখে। যে সময়ে নানা রঙের ফুলে সাজেদার ফুলের বাগান সৌন্দর্য উপভোগ করতো ক্রেতা-বিক্রেতা-দর্শনার্থী। সেই সময়ে সাজেদার ফুলের বাগানে ফুল নেই। তার সেই ফুলের জমিতে ধূসর মাঠে পরিণত হয়েছে। আবার কোন জমিতে ফুল গাছের উঠিয়ে সবজি বা ধান লাগিয়েছেন তিনি। করোনা পরিস্থিতির কারণে একদম ফুল বেচাকেনা না হওয়ায় আম্ফানে ক্ষতিগ্রস্ত ফুলের শেডগুলো পড়ে রয়েছে ঝড়ের পরবর্তী ৫ মাস পরেও।

গত মৌসুমের ঋণের কিস্তির চাপে এখন শুধু হতাশা আর দুচিন্তায় দিনপার করছেন তিনি। এমন অবস্থা দেশের ফুলের রাজধানীখ্যাত গদখালী-পানিসারার সাজেদা একা সেটা বলা ভুল হবে; তার মতো এ অঞ্চলের হাজারো ফুলচাষির দশা একই রকম।

করোনা পরিস্থিতির সঙ্গে ঘূর্ণিঝড় আম্ফান যোগ হয়ে দেশের ফুলের রাজধানী খ্যাত যশোরের গদখালী-পানিসারার ফুলচাষিদের অর্থ সংকট ও ফুলের চারার সংকট দেখা দিয়েছে।

করোনা পরিস্থিতিতে ফুল বিক্রি করতে না পারায় অর্থের অভাবে আম্ফানে ক্ষতিগ্রস্ত ফুলের শেড পড়ে আছে পরিত্যক্ত অবস্থায়। ফুলচাষের মৌসুম এলেও নতুনভাবে চাষাবাদ শুরু করতে না পারায় ফুল উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করছেন চাষিরা। এ পরিস্থিতিতে চাষিদের ক্ষতি কাটিয়ে উঠে ঘুরে দাঁড়াতে হলে সরকারের সহায়তা চেয়ে দুই বছরের স্বল্প সুদে ঋণ চেয়েছেন এ খাতের সংশ্লিষ্ট ফুলচাষি-ব্যবসায়ীরা।  

বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটি সূত্র মতে, যশোরের ঝিকরগাছা ও শার্শা উপজেলার ৭৫টি গ্রামের প্রায় সাড়ে ছয় হাজার হেক্টর জমিতে চাষ করা হয় হরেক রকমের ফুল। ঝিকরগাছার পানিসারা-গদখালী গ্রামগুলোর রাস্তার দুইপাশে দিগন্ত বিস্তৃত জমিতে সারাবছরই লাল, নীল, হলুদ, বেগুনি আর সাদা রঙের ফুলের সমাহার হয়ে থাকে।

শত শত হেক্টর জমি নিয়ে গাঁদা, গোলাপ, গ্ল্যাডিওলাস, রজনীগন্ধা, জারবেরা, কসমস, ডেইজ জিপসি, ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকাসহ বিভিন্ন প্রজাতির ফুলের চাষ হয়েছে এখানে। প্রতিদিন উপজেলার পানিসারার শত শত ফুলচাষির আনাগোনা শুরু হয় গদখালীর বাজারে।

দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছোট-বড় পাইকাররাও সেখান থেকে ফুল কিনে নিয়ে যান। এরপর বিভিন্ন হাতবদল হয়ে পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতার মাধ্যমে ফুল ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে, এমনকি দেশের বাইরেও। তবে করোনার কারণে এই কার্যক্রমে ছেদ পড়েছে গদখালী-ব্যবসায়ীসহ এই সেক্টরের সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমে।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, প্রতিবছর ৩শ কোটি টাকার ফুল উৎপাদন হয় এসব মাঠ থেকে।

কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রাণঘাতি করোনা ভাইরাস ও ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের থাবায় থমকে গেছে দেশে ফুলের রাজধানীখ্যাত গদখালী এলাকা। গত ৫ মাসে মাসে ফুলচাষি ও ব্যবসায়ীদের ৩শ কোটি বেশি টাকার ক্ষতি হয়েছে। হতাশায় ভেঙে পড়েছেন ফুল চাষের ওপর নির্ভর এলাকার হাজার হাজার মানুষ।

করোনায় ফুল বিক্রি করতে না পারায় নষ্ট হয়ে থাকা জমি ফেলে রেখেছে। কেউ বা অর্থের অভাবে আম্ফানে ক্ষতিগ্রস্ত শেড মেরামত করছেন না। ক্ষতির এই বোঝা কাটিয়ে উঠতে অনেক কৃষক তাদের জমিতে ফুলের বদলে ধান, পাট, সবজিসহ অন্যান্য ফসল আবাদ করছেন। এখনই ফুলের চাষ শুরু করতে না পারলে ব্যাহত হবে এবছরের ফুল উৎপাদন।

করোনা ভাইরাস ও সম্প্রতি ঘূর্ণিঝড় আম্ফানে ফুল সেক্টরের যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা অপূরণীয় বলেছেন ফুলচাষিরা। এই মুহূর্তে সম্ভাবনাময় এই সেক্টরটিকে টিকিয়ে রাখতে হলে এখই সরকারি সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন বলে দাবি করছেন তারা।  এমন অবস্থায় নতুনভাবে শুরু করার স্বপ্ন দেখছেন নারী ফুলচাষি সাজেদা। তবে অর্থের অভাবে তিনি ফুল চাষ করতে পারছেন না। ফুল চাষ শুরু করবেন কবে জানতে চাইলে তিনি জানান, আম্ফানে আমার জারবেরার ৪টি শেডই নষ্ট হয়ে গেছে। এগুলো যে মেরামত করবো টাকা নেই। ঘূর্ণিঝড় আম্ফানে তার দেড় বিঘা জমির দুটি জারবেরা শেড উড়ে যায়। কাছে টাকা নেই তাই কয়েকটি মিস্ত্রী নিয়ে, তার পাশাপাশি আমার দুই স্কুল ও কলেজপড়ুয়া সন্তানদের নিয়ে এই শেড মেরামত করছি। ব্যাংকে ১৩ লাখ টাকা এবং দুটি এনজিওতে সাত লাখ টাকার ঋণ রয়েছে।

গত চার মাসে এক টাকাও ঋণের কিস্তি দিতে পারিনি। ঋণের কিস্তি পরিশোধের জন্য ব্যাংক ও এনজিও থেকে চাপ দিচ্ছে। কী করবো বুঝতে পারছি না। গড়ে তোলা শেডগুলো হঠাৎ ভেঙে পড়ায়; শিশু কালের মতো করে আবার এই ফুলের শেডগুলো পরিচর্যা করতে হবে বলে তিনি জানান।

আম্ফান ও করোনায় তার ১৫ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে দাবি করছেন তিনি।

সাজেদার পঙ্গু স্বামী ইমামুল হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, আমার ২৫ বছরের জীবনে ফুল চাষে এমন ক্ষতির মুখোমুখি হয়নি কখনো। এমন খারাপ অবস্থা আমার জীবনে আর আসেনি। আমার ২টি টিনের শেড ছিল। প্রতিটি টিন এক হাজার ৫০ টাকা করে কিনে শেডটি তৈরি করেছিলাম। ঝড়ে শেডটি ভেঙে গেছে। এখন প্রতিটি টিন ২শ টাকা করে বিক্রি করেছি। টিন বিক্রির টাকা দিয়ে সংসার চালাচ্ছি। বর্তমানে সাত লাখ টাকার মতো মূলধন পেলে নতুনভাবে এই ফুল চাষ শুরু করতে পারবেন বলে তিনি জানান।

তা না হলে এই চাষ বাদ দিয়ে ধান চাষ করতে হবে বলেও জানান তিনি।

বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির সভাপতি আবদুর রহিম বাংলানিউজকে বলেন, দেশে ফুলের বাজার বছরে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার। দেশের চাহিদার ৮০ শতাংশ ফুল যশোর থেকে সরবরাহ করা হয়ে থাকে। করোনার কারণে গত ৫ মাস ফুল বিক্রির সুযোগ না থাকায় এবার ৪৫০ কোটি টাকার ফুল নষ্ট হয়েছে। এর মধ্যে শুধু যশোরে অঞ্চলে অন্তত ৩শ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।

ঘূর্ণিঝড় আম্ফানে ফুলক্ষেতের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বেচাকেনা বন্ধ থাকায় চাষিরা বাগান থেকে ফুল কেটে তা পশুখাদ্য হিসেবে ব্যবহার করছেন। এ অঞ্চলের ফুলচাষি ও ব্যবসায়ীরা চরম বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছেন। আগামী মৌসুমের বাজার ধরতে বর্তমানে সময়ে চাষিরা ফুলচাষ বীজবপন, পরিচর্য়া শুরু করে। কিন্তু মূলধনের অভাবে তারা শুরু করতে পারছে না।

যশোর অঞ্চলে প্রায় ১০ হাজার ফুলচাষি রয়েছে এই সংকটে। করোনা ও ঘূর্ণিঝড় আম্ফানে এই খাতে যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে, তা পুষিয়ে নিতে ৫শ কোটি টাকার কৃষি প্রণোদনা প্রয়োজন। আর সেটা দিতে না পারলে এই খাত বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়বে। ইতোমধ্যে অনেক চাষিই এই পেশা বাদ দিয়ে অন্য চাষে মনোযোগ দিয়েছেন বলেও তিনি জানান।

যশোরের জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম খান বাংলানিউজকে বলেন, মহামারি করোনা ও ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের তাণ্ডবে জেলার প্রায় সব ফুলচাষিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নষ্ট হয়ে গেছে ফুলের সব ক্ষেত। ক্ষতির এত হয়েছে যে কোনো কৃষক যেন এই খাতের বাইরে চলে না যায় সরকার এই জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। ইতোমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত তালিকা প্রস্তুত করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। দ্রুতই ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের প্রণোদনার আওতায় আনা হবে।

বাংলাদেশ সময়: ০৯৪৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৩০, ২০২০
ইউজি/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।