ঢাকা, মঙ্গলবার, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

বছরে ১০ কোটি টাকার ডাব বিক্রি হয় নাটোরে

মো. মামুনুর রশীদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০১৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৯, ২০২০
বছরে ১০ কোটি টাকার ডাব বিক্রি হয় নাটোরে

নাটোর: ডাবে পর্যাপ্ত পরিমাণ ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম ও ফসফরাসসহ অন্যান্য পুষ্টিগুণ থাকায় করোনাকালে নাটোর জেলার সবখানেই বেড়েছে ডাবের কদর। পাশাপাশি চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ডাবের দামও বেড়েছে অনেকাংশে।

বাজারে স্থানভেদে একেকটি ডাব কমপক্ষে ৫০ টাকা ও সর্বোচ্চ ৮০ টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে।

কৃষি সংশ্লিষ্ট বলছেন, প্রতিদিন অন্তত ১০ হাজার পিস ডাব বিক্রি হয় নাটোরে। যার আনুমানিক মূল্য আড়াই লাখ টাকা। এ হিসেবে বছরে এখানকার উৎপাদিত প্রায় ১০ কোটি টাকার ডাব নিজ জেলার চাহিদা মিটিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে যাচ্ছে। আর এ ডাব বিক্রি করে অন্তত শতাধিক মানুষ তাদের জীবন-জীবিকা চালাচ্ছেন অনায়াসে।  

ডাব বিক্রি করে লাভবান হচ্ছেন কৃষক, ভ্যানচালক, পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা। তাদের মতে, ডাব এখন দেশের অর্থনীতিতে বিরাট ভূমিকা রাখছে। এ বিবেচনায় ডাবের উৎপাদন বাড়াতে পারলে কৃষি অর্থনীতিতে একটি বড় পরিবর্তন আসবে।     

কৃষি বিভাগ জানিয়েছেন, এবার জেলায় ডাবের বাম্পার ফলন হয়েছে। তাই নিজ জেলার চাহিদা মিটিয়ে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে যাচ্ছে গড়ে ১০ থেকে ১২ হাজার পিস ডাব। বিশেষ করে জেলার বাইরে রাজশাহী, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সান্তাহার, দুপচাঁচিয়া, দিনাজপুর, রংপুর, সৈয়দপুর, ঠাকুরগাঁও এবং ঢাকার বেপারীরাও নাটোর থেকে ডাব কিনে নিয়ে যান।

এছাড়া জেলার বিভিন্ন উপজেলার প্রায় সব হাট-বাজার ও  শহরের ওলি-গলিতে ভ্যান গাড়িতে করে কেনা-বেচা হচ্ছে এসব ডাব। শহরের বিভিন্ন সড়কের পাশে চোখ মেললে দেখা যাবে ছেলে-বুড়ো সবাই পান করছেন কচি কচি ডাবের পানি। ভ্যাপসা গরমে ডাবের পানি প্রাণ জুড়াচ্ছে। অনেক ব্যবসায়ীরা দোকানে বসেই পানির পরিবর্তে ডাবের পানি পান করছেন।

আবার অনেকে চিকিৎসকের পরামর্শে রোগীর পথ্য হিসেবেও কিনে নিয়ে যাচ্ছেন ডাব। ডাব বিক্রেতারা ভ্যানে করে ঘুরে ঘুরে কিংবা শহরের বিভিন্ন মোড়ে দাঁড়িয়ে এবং রেলস্টেশন ও বাসস্ট্যান্ডে ডাব বিক্রি করছেন। তবে ডাবের মূল্য অনেক বেশি হলেও করোনাকালে বাসযাত্রী, ট্রেনযাত্রী বা পথচারীরা কোমল পানীয়র পরিবর্তে পান করছেন ডাবের পানি।  

শহরের মাদ্রাসা মোড় এলাকার ডাব বিক্রেতা রফিকুল ইসলাম ও সাজেদুল ইসলাম জানান, তারা গড়ে প্রতিদিন তিন থেকে চারশ’ ডাব বিক্রি করে থাকেন। আগের চেয়ে মানুষের মধ্যে ডাব খাওয়ার প্রবণতা অনেক বেড়েছে। প্রতিদিন তারা বিভিন্ন গ্রাম অথবা স্থানীয় মোকাম থেকে পাইকারি দরে ডাব কেনেন এবং খুচরা মূল্যে তারা বিক্রি করেন। প্রতিটি ডাবে পাঁচ থেকে ১০ টাকা করে লাভ হয়। এতে স্বাচ্ছন্দ্যে তাদের সংসার চলে।

নাটোর রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় সদর উপজেলার হারিগাছা গ্রামের ডাব বিক্রেতা মো. আব্দুস সামাদ জানান, আগের চেয়ে মানুষের মধ্যে ডাব খাওয়ার প্রবণতা অনেক বেড়েছে। তাই ডাব বিক্রির হার বেড়েছে এবং বিক্রেতার সংখ্যা অনেকগুণ বেড়েছে। ফলে ডাব বিক্রি করে তার মতো অনেকের সংসার ভালোই চলছে।  

তিনি বলেন, অনেক স্থানে ব্যাপকভাবে বিক্রি হচ্ছে ডাব। পাশাপাশি ট্রেনের উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলে এনে অনেক ডাব নিয়ে যাচ্ছেন বেপারীরা। প্রতিদিন ডাব বিক্রি করে গড়ে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা করে আয় করি। গত ১৫ বছর ধরে ডাব বিক্রি করেই সংসার চালাচ্ছি এবং ছেলে-মেয়েদের মানুষ করছি।

নাটোর আড়তে ডাব বিক্রি করতে আসা সাগর হোসেন নামে একজন জানান, গত ২০ বছর ধরে তিনি ডাবের ব্যবসা করে আসছেন। তার মতে, আগে যারা ডাবের পানি পান করতেন না, মহামারি করোনা আসার পর তারাও নিয়মিত ডাবের পানি পান করছেন। এজন্য ডাব বিক্রির হার বেড়েছে।

     

বাগাতিপাড়া উপজেলার কামার পাড়া গ্রামের আফজাল হোসেন জানান, তিনি প্রতিদিন গ্রামে গ্রামে ঘুরে ডাব সংগ্রহ করে নাটোর আড়তে ১৫০ থেকে ১৬০ পিস করে ডাব এনে পাইকারি বিক্রি করেন। তার মতো অন্তত অর্ধশতাধিক ব্যক্তি প্রতিদিন বিভিন্ন গ্রাম থেকে ডাব এনে আড়তে বিক্রি করেন। যা লাভ হয়, তা দিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে চলে তাদের সংসার।  

একই এলাকার ভ্যানচালক তসলিম উদ্দিন জানান, প্রতিদিন তার নিজ এলাকা থেকে ডাব বহন করেই ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা করে আয় হয়। এছাড়া অন্যান্য ভাড়া খেটে তার আরও আয় হয়।  

শহরের নিচে বাজার এলাকায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে ডাব কিনছিলেন সানজিদা পারভীন। তিনি জানান, চিকিৎসকের পরামর্শে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বাবার জন্য ডাব কিনতে এসেছেন। ৬০ টাকা পিস দরে পাঁচটি ডাব কিনেছেন। তবে ডাবের দাম তুলনামূলক একটু বেশি বলে তিনি দাবি করেন।

   

দিঘাপতিয়া এম কে কলেজের প্রভাষক মাহবুর রহমান জানান, করোনাকালে ডাব অনেক উপকারী বলে জেনেছেন। তাই প্রতিদিন তিনি একটি করে ডাবের পানি পান করেন। শহরের প্রতিটি ডাব ৫০ থেকে ৬০ টাকা দরে বিক্রি হলেও গ্রামাঞ্চলে একই ডাব ৩৫ টাকা থেকে ৪০ টাকা পিস বিক্রি হচ্ছে। ডাবের চাহিদা বাড়ায় বিক্রেতারাও সুযোগ পেয়ে ডাবের দাম বেশি নিচ্ছেন। বিষয়টি প্রশাসন দ্বারা মনিটর করা জরুরি। একই কথা জানালেন আরো অনেকে।  

শহরের মেডিপ্যাথ ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক ডা. মাসুদ জানান, করোনাকালে তৃষ্ণার্ত অবস্থায় বাইরে কোথাও পানি পান করার চেয়ে একটি ডাবের পানি পান করা অনেক নিরাপদ। তাছাড়া ডাবের পানিতে পটাশিয়াম থাকায় এ করোনাকালে রোগবালাই থেকে অনেকটা মুক্ত থাকা সম্ভব। একই কথা জানালেন শহরের স্থানীয় কয়েকজন ব্যবসায়ী।

এদিকে দিন দিন ডাবের উৎপাদন বৃদ্ধি ও ভালো বেচা-কেনাকে কেন্দ্র করে নাটোর শহরের হরিশপুর বাইপাস ও ভবানীগঞ্জ মোড়ে গড়ে উঠেছে ডাবের আড়ত। সকাল হলেই ব্যবসায়ীরা জেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে ডাব নিয়ে আসেন এসব আড়তে। এছাড়া মান ভালো ও পানি সুপেয় হওয়ায় সুখ্যাতি আছে নাটোরের ডাবের। মোকামের 

নাটোর শহরের ভবানীগঞ্জ মোড়ের ডাবের আড়তদার ও জান্নাত ফল ঘরের সত্ত্বাধিকারী মো. আব্দুল জলিল জানান, তার আড়তে প্রতিদিন গড়ে পাঁচ/ছয় হাজার ডাব পাইকারি বিক্রি হয়। প্রতি ১০০টি ডাব সর্বনিম্ন আড়াই হাজার ও সর্বোচ্চ তিন হাজার টাকায় বিক্রি হয়। প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা গড়ে ১২ থেকে ১৫ জন পাইকারি ক্রেতা তার আড়ত থেকে ডাব কিনে নিয়ে যান। একই কথা জানালেন হরিশপুর বাইপাস এলাকার ডাবের আড়তদার মো. রুহুল আমিনও।

  

ডাবের পাইকারি ক্রেতা জয়পুরহাটের আবু বক্কর সিদ্দিক জানান, নাটোর এলাকার ডাবের কদর তার এলাকায় অনেক বেশি। কারণ এখানকার ডাবের পানি অনেক বেশি হয় এবং মিষ্টিও বেশি। তাই নাটোর থেকে প্রতিদিন ডাব কিনে নিয়ে তার এলাকায় বেশি দামে বিক্রি করেন।   

ডাবের গুণাগুণ সম্পর্কে নাটোরের সিভিল সার্জন ডা. কাজী মিজানুর রহমান বাংলানিউজকে জানান, ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম এবং ফসফরাস মানুষের শরীরের জন্য খুবই প্রয়োজন। যা বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করে। বাজারের কোমল পানীয় পান না করে প্রতিদিন একটি করে ডাব পান করা স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। কেননা কোমল পানীয়র চেয়ে ডাবের পুষ্টিগুণ অনেক বেশি।  

নাটোর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (ডিডি) সুব্রত কুমার সরকার বাংলানিউজকে জানান, জেলায় ২২৫ হেক্টর জমিতে ডাব গাছ আছে। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ৭২ হেক্টর, নলডাঙ্গায় ১৫ হেক্টর, সিংড়ায় ৫৭ হেক্টর, গুরুদাসপুরে ৩৫ হেক্টর, বড়াইগ্রামে ১০ হেক্টর, লালপুরে ৩০ হেক্টর ও বাগাতিপাড়ায় ছয় হেক্টর জমিতে ডাবের আবাদ হয়েছে। যেখান থেকে বছরে দুই হাজার ৪১৫ মেট্রিক টন ডাব উৎপাদন হবে। গত বছর ২১২ হেক্টর জমিতে ডাবের আবাদ হয়েছিল। আর ডাব উৎপাদন হয়েছিল দুই হাজার ২২৬ মেট্রিক টন।

তিনি বলেন, ডাবের চাহিদা বাড়ায় অনেকেই নতুন করে ডাব গাছ লাগাচ্ছেন। ডাব গাছ আরও বাড়ানোর প্রক্রিয়া চলছে। এরই মধ্যে গত বছরের চেয়ে ১৮৯ হেক্টর বেশি জমিতে ডাবের চাষাবাদ হয়েছে। এ বছর জেলায় ৪৭৫টি উন্নত জাতের ও অধিক উৎপাদনশীল ভিয়েতনামি জাতের নারকেল গাছের চারা রোপণ করা হয়েছে। আগামী দুই/এক বছরের মধ্যে তা উৎপাদনে যাবে। কৃষকরাও নারকেল গাছের চারা সংগ্রহ করে রোপণ করছেন। স্থানীয় নার্সারিগুলোতে নারকেল গাছের চারা বিক্রি হয়েছে ব্যাপকভাবে।  

ডিডি সুব্রত কুমার সরকার আরও বলেন, ডাবের উৎপাদন যেমন একদিকে বেড়েছে, অন্যদিকে মানুষের মধ্যে ডাব পানের প্রবণতাও অনেকাংশে বেড়েছে। চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ডাবের দামও বেড়েছে আগের চেয়ে অনেক বেশি। তাই বাণিজ্যিকভাবে ডাব উৎপাদন করা গেলে অর্থনৈতিকভাবে মানুষ লাভবান হবেন। আর্থিক বিবেচনায় ডাব এখন অর্থকরী ফসল। তাই এ ব্যাপারে কৃষকদের কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।  

বাংলাদেশ সময়: ০৯৫৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৯, ২০২০
এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।