ঢাকা, শনিবার, ১৩ পৌষ ১৪৩১, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

সেই তিমিরে থেকে গেছে সোনাগাজী উপকূলের অপার সম্ভাবনা 

সোলায়মান হাজারী ডালিম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১২৭ ঘণ্টা, আগস্ট ২০, ২০২১
সেই তিমিরে থেকে গেছে সোনাগাজী উপকূলের অপার সম্ভাবনা  সেই তিমিরে থেকে গেছে সোনাগাজী উপকূলের অপার সম্ভাবনা। ছবি: বাংলানিউজ

ফেনী: ফেনীর সোনাগাজী উপকূলে মৎস্য আহরণের সম্ভাবনা তিমিরেই থেকে গেছে। সাধারণত যেখানে লাভের সম্ভাবনা থাকে, সেখানে বিনিয়োগ হয়।

কিন্তু এ অঞ্চল নিয়ে কোনো উদ্যোগই নিচ্ছে না কেউ।

সোনাগাজীতে মৎস্য আহরণের অপার সম্ভাবনার কথা ব্যাপক আলোচিত। তবে মাঠের চিত্র ঠিক বিপরীত। বছরের পর বছর পার হয়ে গেলেও তাই স্থানীয় জেলেদের জীবিকায় যোগ হয়নি বাড়তি আয়।

জেলা মৎস্য বিভাগ সূত্র জানায়, ফেনী উপকূলের মোট আয়তন ১২শ হেক্টর নদী এলাকা। সরাসরি বঙ্গোপসাগরে যুক্ত না হওয়ায় সাগরে মাছ শিকারে জলরাশির আয়তন জেলা মৎস্য অফিস বিবেচনায় ধরে না।

বাংলাদেশ বাঙ্কার সাপ্লায়ার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি মিজানুর রহমান মজুমদার বাংলানিউজকে বলেন, দেশের সমুদ্র সীমার সাড়ে ৬শ কিলোমিটার বর্তমানে মাছ ধরার বাইরে রয়েছে। এ সম্পদ যত দ্রুত কাজে লাগানো যাবে ততই মঙ্গল। দেশ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, যদি ফিসারি ঘাট থাকতো, তবে আহরিত মাছের পরিমাণ অনেক বেশি হতো। যথাযথ সুবিধা না থাকায় অন্যান্য অঞ্চলের জেলেরা মাছ শিকার করে এখানে ভিড়তে পারে না। ফলে গড়ে উঠছে না মাছের পাইকারি বাজার।

তিনি বলেন, এখানে ফিসারি ঘাট বা ল্যান্ডিং স্টেশন নেই। ফলে মাছের বাণিজ্যিকীকরণ ঘটেনি। তাই গড়ে ওঠেনি হিমাগারও। এ দু’টি সুবিধা না থাকলে মৎস্যশিল্প গড়ে উঠবে না। অন্যদিকে এসব সুবিধা যোগ করা গেলে মাছের বাজার সৃষ্টি হবে। অন্যান্য স্থানের ফিসিং বোট এখানে ভিড় করবে। ফেনীর ব্যবসায়ীরা এখানে পুঁজি বিনিয়োগ করবে। জেলেরা মাছের ন্যায্য দাম পাবে। পাশাপাশি পুরো এলাকাতেই এর প্রভাব পড়বে।

বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে পাঁচ বছর মেয়াদি সাসটেইনেবল কোস্টালে মেরিন ফিসারিজ প্রকল্পের আওতায় ল্যান্ডিং স্টেশন করার বিষয়ে একটি আলোচনা রয়েছে। তবে এ প্রকল্প চর খন্দোকারে বাস্তবায়নের কথা রয়েছে বলে জানান জেলা মৎস্য কর্মকর্তা।

তিনি বলেন, ফেনী উপকূল সরাসরি সাগর তীরবর্তী নয়। সন্দ্বীপ চ্যানেলের অংশ। বড় ফেনী নদীর মোহনায় সবচেয়ে বেশি মাছ পাচ্ছেন জেলেরা।

জেলেপাড়ার সর্দার কৃষ্ণধন বাংলানিউজকে জানান, তাদের পাড়ায় ৮৫টি পরিবার বাস করে। এসব পরিবারের মোট সদস্য সংখ্যা সব মিলিয়ে সাড়ে পাঁচশো জন। এছাড়া ১০টি মাছ ধরার বড় ইঞ্জিন নৌকা ও ৭০টি ছোট নৌকা রয়েছে বলে জানান তিনি।

তবে মাছ ধরার সরঞ্জাম ও সামর্থ্য অপ্রতুল বলে মন্তব্য করেন জেলে নুর আলম। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, এখানকার জেলেরা আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল। মাছ ধরার বড় নৌকা নেই। ফলে ফেনী নদীর মোহনা এবং নদী এলাকাতেই মাছ ধরতে হয়। বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরার সুযোগ থাকলেও সামর্থ্য না থাকায় তা সম্ভব হয় না।

ইতোপূর্বে সোনাগাজী উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার দায়িত্বে ছিলেন সহকারী মৎস্য কর্মকর্তা বিজয় কুমার পাল। তিনি জানান, উপজেলায় ১ হাজার ৬২৪ জন জেলের তালিকাভুক্ত রয়েছেন। এদের মধ্যে ইলিশ মাছ ধরেন এমন জেলের সংখ্যা প্রায় ২৫০ জন।

জেলে নেতারা বলছেন, ফিসারি ঘাট বা ল্যান্ডিং স্টেশন না থাকায় তারা নোয়াখালীর মুছাপুর অথবা কুমিরাতে গিয়ে মাছ বিক্রি করেন।

নিলামে বিক্রির জন্য সাধারণত সোনাগাজীর চরখোন্দকার, জেলেপাড়া ও মুছাপুরের ল্যান্ডিং স্পটে মাছ নিয়ে যাওয়া হয়। এক্ষেত্রে অনেক সময় ন্যায্য দাম পাওয়া যায় না। স্থানীয় প্রভাবশালী মহল এই অস্থায়ী ফিসিং ঘাট পরিচালনা করেন। এক্ষেত্রে মাছ ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে কৌশলে কমদামে মাছ কিনে নেন।

জগন্নাথ জলদাস বলেন, বেশিরভাগ সময় বাকিতে মাছ বিক্রি করতে হয়। টাকা পেতে দুই-তিন দিন বা সপ্তাহ খানেকও লেগে যায়। সেক্ষেত্রে পরিবার চালাতে কষ্ট হয়। অন্যদিকে মাথার ওপর ঋণের বোঝা।

অপরদিকে ছোট ও বড় ফেনী নদীর মোহনায় ভিন্ন জেলা থেকে আসা জেলেদের অবাধে জাটকা নিধনের ফলে মাছ পাচ্ছে না বলে অভিযোগ করেন তারা।

জেলেরা জানান, প্রতিবাদ করতে গেলে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হয় তাদের। গুণতে হয় উল্টো জরিমানা। এমনকি কোম্পানীগঞ্জ আড়তে মাছ বিক্রি করতে হয় পানির দরে। এমন অভিযোগ করেছেন সোনাগাজীর চর চান্দিয়া ইউনিয়নের উপকূলীয় এলাকার জেলেরা।

জেলেপাড়ার সর্দার কৃষ্ণধন ও মো. শফিউল্লাহ ছুট্টু মহাজন বলেন, বরিশাল, ভোলা, রামগতি ও নোয়াখালী অঞ্চলের জেলেরা নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল ব্যবহার করে দেড়শ থেকে আড়াইশ গ্রাম ওজনের ইলিশ পোনা নিধন করে।

আলী আফসার নামে অপর এক জেলে অভিযাগ করে বলেন, তাদের ব্যবহৃত জালগুলো দুই ইঞ্চি ফাঁক বিশিষ্ট এবং নদীর তলদেশ থেকে উপরের দিকে খাড়াভাবে ঝুলিয়ে রাখা হয়। ফলে সাগর থেকে মোহনা পার হয়ে ফেনী নদীতে বিশেষত ইলিশ মাছের পরিমাণ কমে যাচ্ছে।

নুর আলম নামে এক জেলে বলেন, আমাদের ব্যবহৃত জালগুলো সাড়ে চার থেকে পাঁচ ইঞ্চি ফাঁক বিশিষ্ট জাল। এগুলো যখন মোহনা দিয়ে ভাসানো হয় মাঝে মাঝে কারেন্ট জালে আটকে যায়। এতে জেলেরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অথচ এতে কোনো অপরাধ না থাকলেও দোষ আমাদের ঘাড়েই পড়ে। বাড়াবাড়ি করলে নদীতেই শারীরিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটে এবং কোম্পানীগঞ্জে মাছ আড়তে উল্টো আমাদের বিরুদ্ধে বিচার হয়।

ফেনীর সোনাগাজী উপকূলে আহরিত মাছের মধ্যে রয়েছে ইলিশ, বাটা, কোরাল, ছুরি, পোয়া, চান্দা, চিংড়ি, আইল (বুলেট), গাঙ কই, কেচকি, বোম, বাইন, বাইলা, হোন্দরা বাইলাসহ প্রায় ৩০ প্রজাতির মাছ। এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে উপকূলীয় জেলে ও মৎস্য বিভাগ।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম বলেন, ফেনী উপকূলে সর্বশেষ বার্ষিক আহরিত মাছের পরিমাণ ১ হাজার ১৭৭ দশমিক ৩ টন। এর মধ্যে নদী থেকে ইলিশের উৎপাদন ৯৪ দশমিক ৮ টন, সাগর থেকে ৩২ দশমিক ৫ টন। অন্যান্য মাছ নদী থেকে ৯৬৫ টন, সমুদ্র থেকে ৮৫ টন। উপকূলে পাওয়া ইলিশ মাছের ওজন সাধারণত ৬০০ হতে ৮০০ গ্রাম পর্যন্ত হয়ে থাকে।

বাংলাদেশ সময় ১১২৭ ঘণ্টা, আগস্ট ২০, ২০২১
এসএইচডি/কেএআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।