ঢাকা, বুধবার, ১০ পৌষ ১৪৩১, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

নিম্নমানের বিটুমিন আমদানি: আরো দুই আমদানিকারককে শোকজ

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪০৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৩০, ২০২১
নিম্নমানের বিটুমিন আমদানি: আরো দুই আমদানিকারককে শোকজ

চট্টগ্রাম: আমদানি নীতি না মেনে নিম্নমানের বিটুমিন আমদানি করায় আরও দুই আমদানিকারককে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে চট্টগ্রাম কাস্টমস। সাতদিনের মধ্যে জবাব না দিলে তাদের বিরুদ্ধে নিয়ম লঙ্ঘনের কারণে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার কথাও বলেছে কাস্টমস।

 

দুই আমদানিকারক হচ্ছে চট্টগ্রামের ‘জাহাঙ্গীর অ্যান্ড আদার্স’ এবং ‘হাসান কনস্ট্রাকশন’। দুটি প্রতিষ্ঠানই বিটুমিনের বড় আমদানিকারক। তারা নিম্নমানের বিটুমিন আমদানি করেছিল। কিন্তু একে একে তিনটি সরকারি ল্যাবে চালানের নমুনা পরীক্ষার পর দুটিতে মান উত্তীর্ণ হয়নি। এই কারণে দুই প্রতিষ্ঠানের নামে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করা হয়েছে।  

এর আগে মানসনদ জালিয়াতি করে নিম্নমানের বিটুমিন আমদানি করে বৈধভাবে ছাড়ের সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে আরেক আমদানিকারক ‘ন্যাশনাল ডেভলপমেন্ট লিমিটেডকে ৫০ লাখ টাকা শুল্কসহ জরিমানা করেছিল কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। একইসাথে জাল সনদ তৈরির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ‘সানশাইন এজেন্সি’র লাইসেন্স বাতিল করে কাস্টমস। তারই ধারাবাহিকতায় এখন দুই আমদানিকারকের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিচ্ছে কাস্টমস।  

চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস কমিশনার মোহাম্মদ ফখরুল আলম বলেন, নিম্নমানের বিটুমিন আমদানি করে ছাড় করার সুযোগ এখন নেই। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি সরকারি নির্দেশনা মেনে গুণমান নিশ্চিত করে বিটুমিন ছাড় দিতে। এখানে ল্যাব পরীক্ষায় যারা গুণগতমান নিশ্চিত করেছে কেবল তারাই ছাড় পেয়েছে।  

জানা গেছে, জুন মাসে নিম্নমানের ৫০ কন্টেইনার বিটুমিন এনে ঢাকার আমদানিকারক ‘ন্যাশনাল ডেভলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড’ ইস্টার্ণ রিফাইনারিতে নমুনা পরীক্ষার জন্য পাঠায়। পরীক্ষায় মান উত্তীর্ণ না হওয়ায় নেগেটিভ সনদ পায় প্রতিষ্ঠানটি। সেই রিপোর্ট জালিয়াতি করে পজিটিভ বা ভালো মান অভিহিত করে ভুয়া রিপোর্টটি কাস্টমসে জমা দেয়। শুল্কায়নের পর সেই রিপোর্টের ভিত্তিতে ৯ কন্টেইনার বিটুমিনের চালান ছাড় নিয়ে যায় আমদানিকারক। পরে জানতে পেরে চালানটির খালাস আটকে দেয় কাস্টমস। একই সাথে ছাড় নেওয়া বিটুমিনের চালানও ফিরিয়ে আনে। এরপর কাস্টমসে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। রিপোর্টে জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত থাকায় সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের বিরুদ্ধে শাস্তির সুপারিশ করা হয়। এরপর গত আগস্ট মাসে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ‘সানশাইন এজেন্সির’ লাইসেন্স বাতিল করে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। একই সাথে আমদানিকারক ‘ন্যাশনাল ডেভলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড’ অনিয়মের দায় স্বীকার করায় ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। সেই জরিমানাও ইতোমধ্যে পরিশোধ করা হয়েছে।  

জানা গেছে, বিটুমিনের বড় আমদানিকারক জিপিএইচ গ্রুপের প্রতিষ্ঠান জাহাঙ্গীর অ্যান্ড আদার্স গত জুলাই মাসে ২ লাখ ৩৮ হাজার কেজির একটি চালান চট্টগ্রাম বন্দরে আনে। প্রথমে নমুনা পরীক্ষার জন্য চালানটি ইস্টার্ণ রিফাইনারিতে পাঠানো হয়। সেখানে নিম্নমান বলে সনদ দেওয়া হয়। এরপর প্রতিষ্ঠানটি বিএসটিআইতে নমুনা পরীক্ষার জন্য পাঠায়। সেখানে রিপোর্ট ভালো আসে। বিষয়টি সন্দেহজনক হওয়ায় বুয়েটে নমুনা পরীক্ষার জন্য পাঠায় কাস্টমস। সেই পরীক্ষায় নিম্নমান বলে সনদ দেওয়া হয়। এরপরই চালানটির খালাস আটকে যায়। এই অবস্থায় আমদানিকারক চালানটি খালাসে নতুন কৌশল খুঁজতে থাকে। উচ্চ আদালতে গিয়ে রিট মামলা করে আমদানিকারক। কিন্তু সেই মামলায় রায় শেষ পর্যন্ত আমদানিকারকের পক্ষে আসেনি। পরে চালানটি আটক করে কাস্টমস এবং নিয়মানুযায়ী কারণ দর্শানো নোটিশ জারি করে। চিঠি পাঠানো হয় আমদানিকারকের নিয়োজিত সিঅ্যান্ডএফ ‘চৌধুরী সিন্ডিকেট’কে।  

জানা গেছে, জুলাইয়ের পর আরো অন্তত ৫টি বিটুমিনের চালান এনেছে জাহাঙ্গীর অ্যান্ড আদার্স। ইস্টার্ণ রিফাইনারির ল্যাবে পরীক্ষায় সবগুলোতেই নেগেটিভ অর্থ্যাৎ মান উত্তীর্ণ নয় রিপোর্ট এসেছে। সর্বশেষ ২২ সেপ্টেম্বরের চালানের নমুনা পরীক্ষায়ও নেগেটিভ রিপোর্ট এসেছে।  

এরপর গত জুলাই মাসে আরেক আমদানিকারক ‘হাসান কনস্ট্রাকশন’ প্রায় ১০ লাখ কেজি বিটুমিন আমদানি করে। কাস্টমসে বিল অব এন্ট্রি জমার পর গুণগতমান পরীক্ষার জন্য নমুনা নিয়ে পাঠানো হয় ইস্টার্ন রিফাইনারিতে। সেই চালানের নমুনা পরীক্ষায় নেগেটিভ রিপোর্ট আসে। পরে আমদানিকারক একইভাবে বিএসটিআইতে পাঠায় সেখানে পজেটিভ আসলে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ আবারও নমুনা পরীক্ষার জন্য বুয়েটে পাঠায়। সেই পরীক্ষায় নেগেটিভ রিপোর্ট আসে অর্থাৎ মান উত্তীর্ণ হয়নি। এই অবস্থায় সেই চালানটিও আটক করে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। এই কারণে গত ২৩ সেপ্টেম্বর আমদানিকারক এবং সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ‘ওয়ারিশা এন্টারপ্রাইজ’কে কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠানো হয়। সাত কার্যদিবসের মধ্যে জবাব না দিলে কঠোর আইনগত পদক্ষেপের কথা লিখিতভাবে জানিয়েছে কাস্টমস।  

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম কাস্টমসের সহকারী কমিশনার উত্তম চাকমা বলেন, ‘আমদানি নীতি আদেশ অনুযায়ী, নিম্নমানের পণ্য আমদানি যোগ্য নয়। তাই নিম্নমানের পণ্য আমদানি করে আমদানিকারক আমদানি নীতি আদেশ লঙ্ঘন করেছেন। কাস্টমস আইন অনুযায়ী যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তাই নীতি লঙ্ঘনের কারণে কেন আমদানিকারকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে না তা জানতে কারণ দর্শানো নোটিশ জারি করা হয়েছে। আগামী সাত কর্মদিবসের মধ্যে সেটি জানাতে বলা হয়েছে। অন্যথায় আইন অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহন করা হবে। ’

নিয়মানুযায়ী, বিটুমিনের মান যাচাইয়ের জন্য সরকার তিনটি প্রতিষ্ঠানকে নির্ধারন করে দেয়। এরমধ্যে ইস্টার্ণ রিফাইনারি ও বুয়েট এই ধরনের ল্যাব পরীক্ষায় অভিজ্ঞ। কিন্তু বিএসটিআই এই ধরনের মান পরীক্ষার কোন অভিজ্ঞতাই নেই। ফলে দেখা গেছে, মান সনদ পরীক্ষায় যখনই ইস্টার্ণ রিফাইনারিতে নেগেটিভ রিপোর্ট আসে, তখনই আমদানিকারক বিএসটিআই’র শরণাপন্ন হয়। আর বিএসটিআই সবসময়ই পজিটিভ রিপোর্ট দেয়। এরপর কাস্টমস নিজে বুয়েটে নমুনা পরীক্ষার জন্য পাঠায়। সেখানে নেগেটিভ রিপোর্ট আসে। অর্থাৎ ইস্টার্ণ রিফাইনারি ও বুয়েটে নেগেটিভ রিপোর্ট আসায় অর্থাৎ তিন প্রতিষ্ঠানের দুটিতে নেগেটিভ আসায় চালানটি ছাড় বন্ধ করে দেয়।

উল্লেখ্য, দেশে নিম্নমানের বিটুমিন আমদানির অভিযোগ দীর্ঘদিনের। দীর্ঘদিন ধরে এসব বিটুমিন আমদানি হলেও মান নিশ্চিত করা হয়নি। ফলে অহরহ নিম্নমানের বিটুমিন আমদানি হচ্ছিল। কোনভাবেই সেটি ঠেকানো যাচ্ছিল না। এতে করে সড়ক রক্ষণাবেক্ষনে হাজার কোটি টাকা গচ্চা যাচ্ছিল সরকারের। সর্বশেষ গত ২৫ মে বিটুমিনের মান নিশ্চিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় তিনটি নির্ধারিত ল্যাবে মান পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করে। এরপর থেকেই মূলত নিম্নমানের বিটুমিন আমদানির চক্রটি বিপাকে পড়ে। মান যাচাই বাধ্যতামূলক করার পর জুন মাসেই প্রথম কোনো চালান ধরা পড়লো কাস্টমসের হাতে।  

বাংলাদেশ সময়: ১৩৫০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৩০, ২০২১
নিউজ ডেস্ক 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।