ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

দুই বছর পর হালখাতা, ৬০ শতাংশ বকেয়ার আশঙ্কা

গৌতম ঘোষ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬২৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৪, ২০২২
দুই বছর পর হালখাতা, ৬০ শতাংশ বকেয়ার আশঙ্কা

ঢাকা: বাঙালির বর্ষবরণের অন্যতম উৎসব হলো পহেলা বৈশাখের দিন পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী হালখাতা অনুষ্ঠান। এদিন ব্যবসায়ীরা লাল মলাটের নতুন খাতায় লিপিবদ্ধ করেন নতুন বছরের হিসাব।



সারা বছর ব্যবসায়ীরা এদিনের জন্য অপেক্ষা করেন। কারণ এদিন ছোট ব্যবসায়ীরা মহাজনদের পাওনা পরিশোধ করে থাকেন। গত দুবছর করোনা মহামারির জন্য হালখাতা অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে পারেননি ব্যবসায়ীরা। ফলে ৬০ শতাংশ বকেয়া পড়ে আছে প্রায় তিন বছর ধরে। করোনা আতঙ্ক কমে যাওয়ায় ও সব কিছু সচল হওয়ায় এবছর হালখাতা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন ব্যবসায়ী।

তবে সনাতনী পঞ্জিকা অনুযায়ী এবছর সরকারি হিসাবের এক দিন পর বছর শুরু হবে। আর সেদিনই পুরান ঢাকাবাসী হালখাতা অনুষ্ঠান উদযাপন করবে।

এদিকে হালখাতা উৎসবের জৌলুস না থাকলেও পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীরা ঐতিহ্য হিসেবেই পালন করছেন। কারণ ব্যবসায়ীরা আগের মতো আর বকেয়া পরিশোধ করেন না এদিন। তারপর গত দুই বছরে করোনা মহামারির ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারেনি ব্যবসায়ীরা। একই সঙ্গে রমজানে গ্রাহকরা হালখাতা অনুষ্ঠানে অংশ নেবে কম। ফলে ৬০ শতাংশ বকেয়া এ বছরও হিসাবের খাতার বাইরে থেকে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা।

বৃহস্পতিবার (১৪ এপ্রিল) হালখাতা উপলক্ষে পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজার, তাঁতীবাজার, ইসলামপুর ও শ্যামবাজারের বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সরেজমিন ঘুরে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, পুরান ঢাকার দোকানে দোকানে এখন উৎসবের আমেজ। ছোট কিংবা বড়, সব দোকানেই উৎসব উৎসব ভাব। দোকানে দোকানে রং করা থেকে শুরু করে মালামাল পরিষ্কারে নেমেছে মালিকসহ কর্মচারীরা। অনেক ব্যবসায়ী হালখাতা উপলক্ষে বিভিন্ন রং দিয়ে দোকানে সাজসজ্জা করছেন। ‘শুভ পহেলা বৈশাখ বা শুভ হালখাতা’সহ বিভিন্ন শব্দ দিয়ে তৈরি করা বোর্ড দিয়ে দোকান সাজাচ্ছে। এছাড়া পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার পাশাপাশি তারা পুরাতন খাতার সব লেনদেনের হিসাবও করছেন। অনেক দোকানের ব্যবস্থাপক আমন্ত্রণপত্রের ওপর পাওনাদারের নাম লিখছেন। অনেকে আবার মিষ্টির দোকানে হালখাতার দিনের জন্য মিষ্টির অর্ডার দিচ্ছেন। হালখাতা নামের উৎসব অনুষ্ঠানটি যেন সুন্দরভাবে সম্পন্ন করতে পারেন সেদিকেই এ এলাকার ব্যবসায়ীদের নজর।  

এবিষয়ে কোতোয়ালি রোডের বাংলাদেশ পোদ্দার ব্যবসায়ী সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক গগণ চন্দ্র ঘোষ বাংলানিউজকে বলেন, এ বছর আমরা একদিন পর পহেলা বৈশাখ ও হালখাতা অনুষ্ঠান উদযাপন করবো। আমরা সনাতনী পঞ্জিকা অনুসারে এ অনুষ্ঠানটি করে থাকি। সে অনুসারে এবছর সরকারি হিসেবে একদিন পর আমাদের বছর শুরু হবে। করোনার জন্য গত দুই বছর হালখাতা অনুষ্ঠান করিনি। এবছর অনুষ্ঠান হবে। ইতোমধ্যে গ্রাহকদের নিমন্ত্রণ দেওয়া হয়েছে। আগে তো কার্ড বিলি করা হতো এখন সব কিছু ডিজিটাল হয়ে গেছে। তবে রোজার কারণে সেটাতেও ভাটা পরবে। রোজার জন্য গ্রাহক কম আসবে। ফলে আমাদের পুরান হিসাবের ৬০ শতাংশ বকেয়াও উঠে আসবে না। গত দুই বছরের প্রায় শতভাগ বকেয়া মাঠে রয়েছে। এভাবে চললে পুঁজি হারিয়ে দেউলিয়া হয়ে যাবেন ব্যবসায়ীরা।  

স্বর্ণ ব্যবসায়ী মাধপ পাল বাংলানিউজকে জানান, এ মাসটির জন্য তারা আগ্রহ ভরে অপেক্ষা করেন। আমরা সনাতনী পঞ্জিকা অনুযায়ী বর্ষবরণ উৎসব করে থাকি। তাই আমাদের পহেলা বৈশাখ একদিন পরে হয়। সেদিনই আমরা হালখাতা অনুষ্ঠান করে থাকি। এদিনই নতুন খাতায় নতুন বছরের হিসাব তুলি। হালখাতার দিন সকালে গণেশ পূজা মধ্য  দিয়ে দিন শুরু হয় এবং সারাদিন গ্রাহদের মিষ্টিমুখ করিয়ে সন্ধ্যার পর অনুষ্ঠান শেষ হয়। তবে বৈশাখ মাস ব্যাপী আমাদের গ্রাহকরা আসেন তাদের পুরানো লেনদেনের হিসাব চুকাতে।

তিনি বলেন, কাস্টমার হচ্ছে তাদের লক্ষ্মী। সারা বছর যারা বাকি স্বর্ণালঙ্কার কেনেন তারা পহেলা বৈশাখে প্রায় সব টাকা পরিশোধ করেন। গত দুই বছর করোনা মহামারিতে হালখাতা অনুষ্ঠান করা হয়নি। দুই বছর পর এবার আমরা হালখাতা অনুষ্ঠান করবো। তাই প্রত্যাশা একটু বেশি। কিন্তু রোজার কারণে গ্রাহকদের কাছ থেকে তেমন কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না।  

ইসলামপুর রোডের ব্যবসায়ী সুব্রত কর্মকার বাংলানিউজকে বলেন, দুই বছর পর এবছর আমরা হালখাতা অনুষ্ঠান করবো শুক্রবার (১৫ এপ্রিল)। এজন্য দোকান ধোয়া মোছা চলছে। হিসেবের খাতা পরিবর্তন করা হচ্ছে। আমরা হালখাতা অনুষ্ঠানের জন্য প্রস্তুত। কিন্তু রোজা ও উচ্চ দ্রব্য মূল্যেরের কারণে এবছর আমাদের বকেয়া না পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।  

ইসলামপুরের পাইকারি কাপড়ের ব্যবসায়ী ও সমাজসেবক মো. নাসির উদ্দিন মোল্লা বাংলানিউজকে বলেন, দুই বছর পর হালখাতা অনুষ্ঠান করবো। তবে এবারের প্রেক্ষাপট একটু ভিন্ন রমজানের জন্য। তাই অনুষ্ঠানের সময় সূচিও পরিবর্তন করে সন্ধ্যায় করা হয়েছে। পহেলা বৈশাখের দিন আমরা হালখাতা উপলক্ষে সকাল ৮টায় দোকান খুলি। রোজার জন্য সন্ধ্যার পর মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। তারপর আমন্ত্রিত অতিথিদের রোজা ভাঙার জন্য ইফতারি ও মিষ্টি জাতীয় খাবার দিয়ে আপ্যায়ন করানো হবে। এদিনই বছরের সব দেনা-পাওনার হিসাব নিষ্পত্তি করে পুরনো জঞ্জাল সরিয়ে নতুনভাবে বছর শুরু করি।  

তিনি বলেন, হালখাতায় সাধারণত ছোট ব্যবসায়ীরা সারাবছর বাকিতে পণ্য নিলেও এদিনটিতে তা পরিশোধ করে থাকেন। গত দুই বছর এই অনুষ্ঠান আয়োজন না হওয়ায় কোনো ব্যবসায়ী বকেয়া পরিশোধ করেনি। এবছরও রমজান এবং ঈদের অযুহাতে বকেয়া পরিশোধ করবে না অনেক ব্যবসায়ী। গত প্রায় তিন বছরের হিসেব করলে আমাদের ৬০ শতাংশ বকেয়া অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে। তাই এতিহ্য রক্ষা করতে ব্যবসায়ীরা হালখাতা অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে। এতে আশা অনুরূপ কোনো কিছু হবে না বলেও জানান তিনি।

শ্যামবাজারের হৃদয় টেডার্সের স্বত্বাধিকারী সিরাজুল ইসলাম খান জানান, বৈশাখ আর পুরান ঢাকার মধ্যে কিছুটা আলাদা আমেজ থাকে। এ বাজারে কৃষি ও কাঁচাবাজার মালামাল বেশি। একজন ক্রেতা পাঁচ লাখ থেকে কোটি টাকা পর্যন্ত বাকি পরিশোধ করেন। তাদের বিভিন্ন হোটেলের খাবার খাওয়ানো হয়। মূল্যবান উপহার সামগ্রী দেওয়া হয়। ক্রেতার পরিবারের জন্যও উপহার দেওয়া হয়। কিন্তু গত দুই বছরে করোনায় ব্যবসার ১২টা বাজিয়ে দিয়েছে। এবছর আমরা শুধু নাম মাত্র হালখাতা অনুষ্ঠান করবো। যাদের নিয়ে অনুষ্ঠান করবো তারা আগেই বলে দিয়েছে বকেয়া পরিশোধ করতে পারবে না। তাই অযথা টাকা নষ্ট করে কোনো লাভ নেই।

শীতল পাটি বিক্রেতা জামাল উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, গত ২০ বছর ধরে তাঁতীবাজারে শীতল পাটি বিক্রি করি। গত দুইবছর এখানে হালখাতা অনুষ্ঠান হয়নি তাই পাটিও বিক্রি হয়নি। এবছর প্রায় ২০০ শীতল পাটি এনেছি। তবে বিক্রি নেই। পণ্যের দাম বেড়েছে। মানুষের ব্যবসা নেই তাই কেউ এখন আর পাটি কিনেন না। বড় একটি পাটির দাম পড়বে ৮০০ টাকা, মাঝারিটার দাম ৬০০ টাকা, এর থেকে একটু ছোটটার দাম ৪৫০ টাকা এবং ছোটটার দাম পড়বে ৩০০ টাকা।  

প্রসঙ্গত, সর্বজনীন উৎসব হিসেবে ‘হালখাতা’ বাংলা নববর্ষের প্রাণ। ইতিহাস অনুযায়ী, ১৫৮৪ সালে সম্রাট আকবরের বাংলা সন প্রবর্তনের পর থেকেই ‘হালখাতা’র প্রচলন হয়। পুরনো বছরের হিসাব বন্ধ করে নতুন হিসাব খোলা হয় যে খাতায়, তা-ই ‘হালখাতা’ নামে পরিচিত। অতীতে জমিদারকে খাজনা দেওয়ার অনুষ্ঠান হিসেবে ‘পুণ্যাহ’ প্রচলিত ছিল। বছরের প্রথম দিন প্রজারা সাধ্যমতো ভালো পোশাক পরে জমিদার বাড়িতে গিয়ে খাজনা পরিশোধ করতেন। তাদের মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করা হতো। জমিদারি প্রথা উঠে যাওয়ায় পুণ্যাহ বিলুপ্ত হয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৬২৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৪, ২০২২
জিসিজি/আরআইএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।