ঢাকা, রবিবার, ১৪ পৌষ ১৪৩১, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

কমেছে সঞ্চয়পত্র বিক্রি, ব্যক্তিখাতের ঋণ প্রাপ্তিতে বাধার শঙ্কা

গৌতম ঘোষ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৪৫ ঘণ্টা, আগস্ট ২, ২০২২
কমেছে সঞ্চয়পত্র বিক্রি, ব্যক্তিখাতের ঋণ প্রাপ্তিতে বাধার শঙ্কা

ঢাকা: সঞ্চয়পত্র সুদের হার কমানো, টিআইএন বাধ্যতামূলক, বিক্রির সীমা আরোপ ও ডেটাবেইজ অনলাইন করাসহ কেনার বেলায় নানা শর্তের কারণে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমেছে ৫২ দশমিক ৪৪ শতাংশ। গত ২০২১-২২ অর্থবছর শেষে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি দাঁড়িয়েছে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকায়।

যা এর আগের ২০২০-২১ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল ৪১ হাজার ৯৫৯ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে এ খাত থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার পরিমাণ কমেছে ২২ হাজার কোটি টাকা।

ফলে সরকারকে বাজেটের ঘাটতি পূরণে বিকল্প পথ হিসেবে ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ গ্রহণের প্রবণতা বৃদ্ধি পাবে। আর এটা যাতে ব্যক্তিখাতের ঋণ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে যাতে বাধা হয়ে না দাঁড়ায় সেদিকে সরকারকে সতর্ক দৃষ্টি রাখার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

সঞ্চয়পত্র অধিদপ্তরের সর্বশেষ প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত অর্থবছরে ১ লাখ ৮ হাজার ৬৯ কোটি টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়। এ সময়ে সঞ্চয়পত্র ভাঙানো বা তুলে নেওয়ার বিপরীতে গ্রাহককে অর্থ পরিশোধ করা হয় ৮৮ হাজার ১৫৪ কোটি টাকা। সে হিসেবে গত অর্থবছরের নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে ১৯ হাজার ৯১৫ কোটি টাকা। আর একক মাস হিসেবে গত জুনে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ৭৪৯ কোটি ৬৩ লাখ টাকার।

এর আগের ২০২০-২১ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল ৪১ হাজার ৯৫৯ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে এ খাত থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার পরিমাণ কমেছে ২২ হাজার কোটি টাকা, শতকরা হারে ৫২ দশমিক ৪৪ শতাংশ। এ সময়ে জাতীয় সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের নেওয়া ঋণের পরিমাণ নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও ৩৭ দশমিক ৫০ শতাংশ কম। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে এ খাত থেকে মোট ৩২ হাজার কোটি টাকার ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ধরেছিল সরকার।

এবিষয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার কারনে সাধারণ মানুষের আয় কমেছে। ফলে মানুষ তাদের সঞ্চয় ভেঙ্গে খাচ্ছেন। এতে করে মানুষ সঞ্চয়পত্রসহ বিভিন্ন ব্যাংকে রাখা তাদের ডিপোজিট বা সঞ্চয় তুলে ফেলার প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। মূল্যস্ফীতি এর পেছনে কাজ করেছে বলে মনে হচ্ছে। এরফলে সরকারের ঘাটতি বাজেটের জন্য যে অর্থের প্রয়োজন হবে, যেটা অভ্যন্তরীণ সূত্র থেকে নেবে বলে প্রাকলন করেছিলেন। সেখানে এখন সরকারকে এ টাকাটা ব্যাংকিং খাত থেকে নিতে হবে। এজন্য লক্ষ্য রাখতে হবে ব্যাংকিং খাতে সরকারি এই যে ঋণ গ্রহণের চাপ এটা যাতে ব্যক্তিখাতের ঋণ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে যাতে বাধা হয়ে না দাঁড়ায় সে দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।

সঞ্চয়পত্র অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ব্যাংকগুলোর আমানতের সুদের হার কম এবং পুঁজিবাজারে দীর্ঘ মন্দার কারণে গত কয়েক বছর ধরে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছিল সঞ্চয়পত্র বিক্রি। এতে সরকারের ঋণের বোঝা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাচ্ছিল। এরপর সুদ ভর্তুকি কমিয়ে আনতে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে বিধিনিষেধ আরোপ করতে শুরু করে সরকার। এর অংশ হিসেবে মুনাফা কমিয়ে ক্রয় সীমায় নিয়ন্ত্রণ আরোপ ও সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) বাধ্যতামূলক করা হয়। এছাড়া বিক্রির সীমা আরোপ ও ডেটাবেইজ অনলাইন করায় একই ব্যক্তির অধিক অর্থ সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের পরিমাণ কমেছে। পাশাপাশি বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দায় আয়ের তুলনায় ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় এখাতে বিনিয়োগ কমে গেছে। বরং মানুষ উল্টো সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে। এছাড়া লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সহায়ক পলিসি না থাকায় সঞ্চয়পত্রের বিক্রি কমে ভাঙার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।  

এবিষয়ে সঞ্চয়পত্র অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মাকছুদা খাতুন বাংলানিউজকে বলেন, সঞ্চয়পত্রে মুনাফা কমিয়ে ক্রয় সীমায় নিয়ন্ত্রণ আরোপ ও বিক্রিতে কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) বাধ্যতামূলক করা হয়। এর প্রভাবে বিক্রি কমে আসে। এছাড়া মানুষের আয়ের তুলনায় ব্যয় বেড়ে গেছে। আমাদের সকল সিস্টেম এখন অনলাইন হয়ে গেছে। এই সুবিধা উপজেলাগুলোতে এখনও পৌঁছাতে পারেনি। আর যেখানে অনলাইন হয়েছে সেখানে ম্যানুয়াল সিস্টেম থেকে অনলাইন করতে হলে সঞ্চয় উঠিয়ে আবার রাখতে হচ্ছে। ফলে আমাদের বেধে দেওয়া লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারছি না। যদিও সরকার সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ কমাতে চাচ্ছে। এতে করে সরকারকে ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক থেকে অনেক বেশি ঋণ নিতে হবে। যা ব্যাক্তিখাতে প্রভাব পড়েতে পারে বলে মনে করছেন তিনি।

তিনি বলেন, গত অর্থবছরে আমাদের ১ লাখ ৮ হাজার কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে৷ এর বিপরীতে সঞ্চয় পত্র ভাঙা হয়েছে ৮৮ হাজার ১৫৪ কোটি টাকা। সে হিসাবে আমাদের নিট বিনিয়োগ হয়েছে ১৯ হাজার ৯১৫ কোটি ৭৫ হাজার টাকা। এখন মানুষ সঞ্চয় পত্র ভেঙে ফেলছে। এর অন্যতম কারণ হলো মানুষের সঞ্চয় কমেছে। বিশ্বজুরেই একটা অর্থনৈতিক মন্দা পরিস্থিতি বিরাজ করছে। ফলে মানুষ তার জমানো পুঁজি ভেঙে চাহিদা মেটাচ্ছে। আর্থিক সংকটের কারণে সঞ্চয়পত্রের বিক্রি কমে গেছে।

প্রসঙ্গত, সঞ্চয়পত্রে সুদহার কমিয়ে আনার পরও সঞ্চয়পত্রে মুনাফার হার এখন সর্বোচ্চ ১২ শতাংশ পর্যন্ত, যা ব্যাংকের আমানত সুদহারের চেয়েও অনেক বেশি। বর্তমানে ব্যাংকে আমানতে সুদহার ৬ শতাংশের ঘরে রয়েছে। এবারও ব্যাংকের মাধ্যমে সর্বোচ্চ ৮২ হাজার ১৫০ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে।

জানা গেছে, ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই থেকে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে লাগাম টানতে শুরু করে সরকার। ওই সময়েই প্রথম সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে গ্রাহকের ব্যাংক হিসাব বাধ্যতামূলক করা হয়। টিআইএন বাধ্যতামূলক ও সঞ্চয়পত্র থেকে মুনাফার ওপর উৎসে কর ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়। আর ওই বছরের ডিসেম্বর থেকে একক ব্যক্তি হিসাব, যৌথ ও প্রাতিষ্ঠানিক ক্রেতাদের ওপর সীমা কমিয়ে পুর্ণর্নিধারণ করা হয়। সর্বশেষ চলতি অর্থবছরে আরও শর্ত জুড়ে দেয় সরকার। এখন থেকে ৫ লাখ টাকার বা ততোধিক পরিমাণের সঞ্চয়পত্র ক্রয়ে ট্যাক্স রিটার্ন সনদ জমা দিতে হবে।

২০২০-২১ অর্থবছরে সরকার এ খাত থেকে ঋণ নিয়েছিল ৪১ হাজার ৯৫৯ কোটি টাকা। এর আগের ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২৭ হাজার কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে নেওয়া হয়েছিল ১৪ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা। বিনিয়োগে সব শ্রেণির গ্রাহকের আকর্ষণের শীর্ষে থাকা এ খাতে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রেকর্ড ৪৯ হাজার ৯৩৯ কোটি টাকা বিক্রি হয়েছিল।

বাংলাদেশ সময়: ১০৪৪ ঘণ্টা, আগস্ট ০২, ২০২২
জিসিজি/এসআইএস 
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।