ঢাকা: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক নাদির জুনাইদের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করেছেন এক নারী শিক্ষার্থী। এ ঘটনায় নাদিরের বিরুদ্ধে সুষ্ঠু তদন্ত ও তদন্তকালীন সব একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম থেকে তাকে অব্যাহতি দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন বিভাগের শিক্ষার্থীরা।
রোববার (১১ ফেব্রুয়ারি) সকালে দাবি নিয়ে বিভাগে অবস্থান পালন করেন শিক্ষার্থীরা। পরে মধুর ক্যান্টিন, ক্যাম্পাস শ্যাডো, মাস্টার দা সূর্যসেন হল, উপাচার্য কার্যালয় ঘুরে অপরাজেয় বাংলা পর্যন্ত মিছিল করেন বিভাগের ১৩তম, ১৪তম, ১৫তম, ১৬তম ও ১৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা৷ এসময় অপরাজেয় বাংলার সামনে মানববন্ধন করেন এই শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষার্থীদের দাবি, অধ্যাপক নাদির জুনাইদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সুষ্ঠু তদন্ত ও দৃশ্যমান পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে; তদন্তকালীন তাকে একাডেমিক কাজ থেকে অব্যাহতি; ভুক্তভোগীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা; আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের হয়রানি না করার নিশ্চয়তা দিতে হবে।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, শুধু ওই শিক্ষার্থী-ই নন। বরং বিভিন্ন ব্যাচের নারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তার এ ধরনের আচরণের ঘটনা রয়েছে। ভয়ে শিক্ষার্থীরা মুখ খুলতে পারেন না।
বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী সানি বলেন, একজন শিক্ষক কীভাবে তার নারী শিক্ষার্থীকে কুপ্রস্তাব দিতে পারেন! কীভাবে তিনি যৌন নিপীড়নমূলক আচরণ করতে পারেন! আমরা এর সুষ্ঠু তদন্ত চাই।
বিভাগের ১৪তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সামদানি প্রত্যয় বলেন, তার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানি ও মানসিক পীড়ার অভিযোগ এসেছে। এটি বিভাগে ওপেন সিক্রেট ছিল। আমরা একটি ভয়ের সংস্কৃতির মধ্যে বাস করতাম। যতদিন পর্যন্ত তদন্ত প্রতিবেদন না আসবে, ততদিন আমরা সব কার্যক্রম বর্জন করছি।
একই বর্ষের আরেক শিক্ষার্থী মাইশা বলেন, উনি প্রথম বর্ষে করোনার কারণে ভিডিওকলে সবার প্রেজেন্টেশন নিয়েছেন। আমার কল কানেক্ট হচ্ছে না দেখে আমাকে নিজ থেকে কল করেন। পরে প্রেজেন্টেশন খারাপ হওয়ায় ৩৪ মিনিট ফোনকলে আমাকে বকাঝকা করেন। এক ধরনের মানসিক সংঘাত থেকে বের হওয়া খুব কঠিন।
১৬তম ব্যাচের শিক্ষার্থী নাওয়ার সালসাবিল দুর্দানা বলেন, তিনি আমাদের ওপর মানসিক নির্যাতন চালাতেন। তিনি বস্তুনিষ্ঠভাবে নম্বর দেন না, বরং হোয়াটসঅ্যাপ এবং মেসেঞ্জারের চ্যাট দেখে নম্বর দেন।
১৫ ব্যাচের শিক্ষার্থী কিফাত বলেন, লিখিত কোনো সিদ্ধান্ত না এলে আমরা ক্লাসে ফিরব না।
যৌন নিপীড়নের অভিযোগ
গত ১০ ফেব্রুয়ারি সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. মো. মাকসুদুর রহমান বরাবর নাদির জুনাইদের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করেন একই বিভাগের এক নারী শিক্ষার্থী। শরীরের বিভিন্ন স্পর্শকাতর অঙ্গ নিয়ে মন্তব্য করার পাশাপাশি এসব এড়িয়ে গেলে রেগে যেতেন নাদির—এমন অভিযোগ এনেছেন ওই শিক্ষার্থী। অভিযোগপত্রের সঙ্গে কল রেকর্ডিং, স্ক্রিনশটসহ সহায়ক প্রমাণ যুক্ত করেছেন তিনি। অভিযোগপত্র পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন প্রক্টর।
রোববার (১১ ফেব্রুয়ারি) দুপুর ১২টা ৪০ মিনিটে নিজ হাতে উপাচার্য বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী। অভিযোগ গ্রহণ করে উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেন, অভিযোগপত্র পেয়েছি, সঙ্গে একটি পেনড্রাইভও পেয়েছি৷ এ ধরনের অভিযোগ পেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচলিত আইন অনুযায়ী যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় সে অনুসারেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অভিযোগপত্রে যা বলা হয়েছে
ওই নারী শিক্ষার্থী অভিযোগপত্রে বলেন, অধ্যাপক নাদির জুনাইদ কর্তৃক যৌন হয়রানির কারণে বিগত দেড় বছর প্রচণ্ড মানসিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে গেছেন তিনি। এক পর্যায়ে ঘুমের ওষুধ নিতে হয়েছে তার। গত বছরের শুরুতে কাউন্সিলিংও করেন ওই শিক্ষার্থী।
অভিযোগপত্রে তিনি বলেন, ‘এক পর্যায়ে তিনি তার বিয়ের প্রসঙ্গে কথা বলেন এবং স্পষ্টভাবে আমার দিকে ইঙ্গিত করেন। আমি খুব অবাক হই এবং খুব অস্বস্তিতে পড়ি। তবে আমি কৌশলে তাকে নাকচ করে দিই। ’
অধ্যাপক নাদির জুনাইদ বিভিন্ন দ্বৈত-অর্থবোধক কথা বলতেন জানিয়ে ওই শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমাকে ওনার সাথে বাজে জিনিস কল্পনা করতে প্ররোচিত করতেন। বলতেন, “ধরে নাও তোমার সাথে বিয়ে হলে, তোমার সাথে এটা করলে ওটা করলে কেমন হতো”, “মনে কর, আমরা সি-বিচ গিয়েছে, সান-বাথ...”। এছাড়াও বিভিন্ন দ্বৈত-অর্থবোধক কথাবার্তা বলতেন এবং সারাক্ষণ যৌন কথোপকথনে প্ররোচিত করতেন। ...এসময় আমি ফ্রি থাকলেই ঘন ঘন দেখা করতে চাইতেন এবং তার বাসায় আমন্ত্রণ জানাতেন। আমি প্রতিবারই বিভিন্ন অজুহাতে নাকচ করতাম। ’
অধ্যাপক নাদির এমন প্রশ্ন ছুড়ে দিতেন তাকে, যার বেশিরভাগ কথাই সাধারণত স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে হয়ে থাকে বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করেন ওই শিক্ষার্থী।
তার ভাষ্যে, যৌন প্রসঙ্গে সাড়া না দিলে ওই শিক্ষার্থীকে ‘অনুভূতিহীন’, ‘নির্বোধ’, ‘ডাক্তার দেখানো উচিত’—প্রভৃতি বিষয় বলতেন এই অধ্যাপক।
অভিযোগকারী শিক্ষার্থী জানান, অধ্যাপক নাদির জুনাইদের ‘ব্যক্তি-আক্রোশের’ শিকার হওয়ার ভয়ে গত দেড় বছর যাবত মুখ বুজে সব সহ্য করেছেন তিনি।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, নাদির জুনায়েদের কারণে ওই নারী শিক্ষার্থী বিভাগে মাস্টার্স করতে চাননি। পরিচয়ের শুরুতে সুন্দর আচরণ দিয়ে নারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। পরে অনেক শিক্ষার্থীকে বিয়ের প্রস্তাবও দিয়েছেন বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ রয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও নাদির শিক্ষার্থীদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করতেন। তার নামে কে কী বলছে তাই নাদিরের চিন্তার এবং কথার মূল বিষয় হয়ে ওঠে বলে অভিযোগপত্রে বলা হয়।
অভিযোগকে ষড়যন্ত্র বলছেন নাদির জুনাইদ
এদিকে যৌন হয়রানির অভিযোগকে ষড়যন্ত্র বলেছেন নাদির জুনাইদ। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, আগামী জুনে আমার বিভাগের চেয়ারম্যান হওয়ার কথা ছিল, সেটা ঠেকানোর এটা একটা কৌশল। এর আগে অভিযোগ উঠল আমি শিক্ষার্থীদের নম্বর কম দিয়েছি। কিন্তু ওই খাতা আমার হাতে ছিল না। বোর্ডে চারজন শিক্ষক ছিলেন। নম্বর দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রত্যেকেরই ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু অন্য কোনো শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠেনি।
যৌন হয়রানির অভিযোগের ব্যাপারে তিনি বলেন, বিশেষ উদ্দেশ্যে টার্গেট করে আমার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ তোলা হচ্ছে। আমি যাতে বিভাগের চেয়ারম্যান হতে না পারি সে চেষ্টা করা হচ্ছে। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ দেওয়া হতে পারে- এটা আগেই খবর পেয়ে আমি শাহবাগ থানায় একটি জিডিও করেছি। তবে অভিযোগ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যেভাবে গণমাধ্যমে নিউজ করা হচ্ছে, তাতে আমি মিডিয়া ট্রায়ালের শিকার হচ্ছি। সামাজিকভাবে হেয় হচ্ছি। দু-এক বছর পরে হয়তো এ অভিযোগ অসত্য প্রমাণিত হবে, তখন আমার এই ক্ষতি কে পূরণ করবে।
এদিকে নাদির জুনাইদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের দ্রুত তদন্ত ও বিচারের দাবিতে মানববন্ধন করেছে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন। রোববার সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে নিপীড়নবিরোধী মশাল মিছিল করে একদল শিক্ষার্থী।
বাংলাদেশ সময়: ২১০৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১১, ২০২৪
এইচএ/