ঢাকা: এক সাধারণ পরিবারের মেয়ে এশা (ছদ্মনাম), পড়াশোনা করছেন রাজধানীর স্বনামধন্য প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির বিবিএ ডিপার্টমেন্টে। ‘স্প্রিং ২৪’ সেমিস্টারের প্রায় ৭০ হাজার টাকার টিউশন ফি এখনো জোগাড় করতে পারেননি এই শিক্ষার্থী।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের আরেকটি মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির ‘পাহাড় সমান’ টিউশন ফি জোগাড় করা। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সেমিস্টার ফি নিয়ে মানসিক চাপ প্রয়োগ করার অভিযোগও উঠেছে।
এক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির অনেক শিক্ষার্থীই তাদের টিউশন ফি জমা দিতে পারেননি। কারণ হিসেবে জানা গেছে, পাহাড় সমান টিউশন ফি জোগাড় করাই সাধারণ পরিবারের শিক্ষার্থীদের জন্য হয়ে উঠেছে দুর্বিষহ বিষয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জেনেটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের এক শিক্ষার্থী বাংলানিউজকে বলেন, আমার বাবা নেই, মায়ের পক্ষে এই টিউশন ফি জোগাড় করা কঠিন হয়ে উঠেছে। যদি কর্তৃপক্ষ টিউশন ফি কিছুটা কম নিয়ে ইন্সটলমেন্টে পে করার সুযোগ দিত, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থীর জন্য সহজ হতো। এ ব্যাপারে রেজিস্ট্রার স্যারকে ইমেইল করেও মেলেনি কোনো উত্তর।
এই শিক্ষার্থী আরও বলেন, দেশে এখন এমনিতেই দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বমুখী, তার ওপর বিপুল টিউশন ফি। এখন শেষের দিকে এসে ভার্সিটি ছাড়তেও পারছি না।
জেনেটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের আরেক শিক্ষার্থী অভিযোগ করে বলেন, কর্তৃপক্ষ বলে ৬ মাসের সেমিস্টার। কিন্তু আমাদের সেমিস্টার ৫ মাসের মতো। টাকা নিচ্ছে ৬ মাসের। আমার মতো অনেক শিক্ষার্থীর পেমেন্ট করতে দেরি হওয়ায় তাদের মানসিক চাপ নিতে হচ্ছে, যেমন পোর্টাল বন্ধ করে দেওয়া, অভিভাবকদের মোবাইলে মেসেজ দিয়ে জানানো। পরীক্ষা দিতে দেবে না বলে নিয়মিত হুঁশিয়ারি তো থাকছেই।
অভিভাবকদের মেসেজ দেওয়া মানেই কিন্ত চাপটা পরিবারেও যাওয়া। এখন আমার ৭৮ হাজার টাকা একবারে ব্যবস্থা করা বেশ কঠিন। আবার লেট ফি তো যোগ হয়ই, যোগ করেন এই শিক্ষার্থী।
ইরেজি, বিবিএ ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থীরা ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষের ভয়ে নাম না প্রকাশ করার অনুরোধ করে বাংলানিউজকে বলেন, একে তো ৬ মাসের সেমিস্টার, দ্বিতীয়ত সেমিস্টার শেষে আবার নাকি ২ মাসের কোর্স সিজিপিএ উন্নতি করার, এ আবার আরেক মানসিক টর্চার। কে না চাইবে সিজিপিএ উন্নতি করতে? দেখা যাবে এক প্রকার বাধ্য হয়েই আমাদের এই কোর্স করতে হবে।
তারা আরও জানান, সিজিপিএ বাড়িয়ে নিতে, সেখানে ক্লাস করতে হবে আড়াই ঘণ্টা। এমন সব নিয়মে আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীরা হাঁপিয়ে উঠছি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিশ্ববিদ্যায়টির একজন শিক্ষক বলেন, নতুন কিছু নিয়ম হয়েছে, যার সাথে শুধু শিক্ষার্থীরাই না আমাদেরও মানিয়ে নিতে কিছুটা বেগ পেতে হচ্ছে।
গত ২০২২ সালে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে চার মাসের সেমিস্টার থেকে ৬ মাসে সেমিস্টার বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে চিঠি পাঠিয়েছিল।
ইউজিসির সিদ্ধান্ত মানতে বিশ্ববিদ্যালয়ে এক একজন শিক্ষার্থীকে গুনতে হচ্ছে এককালীন টিউশন ফি প্রায় ৮০ হাজার টাকার মতো। কেউ কেউ আছে যাদের গুনতে হচ্ছে ৮০ হাজেররও বেশি, কাউকে ৬০ থেকে ৬৫ হাজার আবার কারো ৭০ থেকে ৮০ হাজার টিউশন ফি।
খবর নিয়ে জানা গেছে, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ল’ এবং ফার্মেসি ডিমার্টমেন্টে ৬ মাসের সেমিস্টার আর বাকি সব ডিপার্টমেন্টে ৪ মাসের সেমিস্টার। সেখানে ইন্সটলমেন্ট সুবিধা দিয়েছে যেন শিক্ষার্থীরা ধীরে ধীরে পুরো টিউশন ফি দিতে পারে। আরেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইনডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটিতে সেমিস্টার ৪ মাসের এবং আছে ইন্সটলমেন্ট সুবিধা। অন্যদিকে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে ৬ মাসের সেমিস্টার কিন্তু আছে ইন্সটলমেন্টে টিউশন ফি দেওয়ার সুবিধা।
উচ্চমাত্রার টিউশন ফি বিষয়ে জানতে গত শনিবার (১৮ মে) আফতাবনগরে ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে গিয়ে রিসিপশন যোগাযোগ করা হলে পাবলিক রিলেশন অফিসারের (পিআরও) সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হয়।
বাংলানিউজের এই প্রতিবেদক ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির পিআরও মো. মহিউদ্দিনকে মোবাইফোনে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, ‘যা রিপোর্ট করার করেন। তবে ব্র্যাক ও নর্থ সাউথের সাথে মিল রেখে করবেন। রিপোর্ট যাই হোক স্বাগত জানাই। ’
উপাচার্যের সঙ্গে যোগাযোগের উপায় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভিসি স্যার অস্ট্রেলিয়া থেকে এসেছেন। তার অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেতে অনেক বেগ পেতে হয়। স্টাফরাও তার সঙ্গে দেখা করতে পারেন না। ভিসি স্যার অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিলেই কেবল দেখা করা সম্ভব।
এরপর এই কর্মকর্তা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে রেজিস্ট্রারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে তার নম্বরটি দেন। তবে সেই নম্বরে ৮ বার কল করেও রেজিস্ট্রারের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। এর মাঝে একবার রেজিস্ট্রার নিজে কল করে জানান, তিনি মিটিংয়ে ব্যস্ত আছেন, পরে যোগাযোগ করবেন। এরপর আর যোগাযোগ করেননি।
অনুসন্ধানে পাওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য:
ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির একজন কর্মী জানান, গত রোজার ঈদের আগে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে ভ্যাট দেওয়া প্রসঙ্গে এক চিঠি আসে ইউনিভার্সিটির রিসিপশনে, যা পরবর্তীতে কয়েক দফা একাউন্ট ডিপার্টমেন্টে জানানো হলেও তারা কর্ণপাত করেনি।
তবে হঠাৎ করেই ঈদের মাসে সরকার ইউনিভার্সিটির ব্যাংক এশিয়ার সকল হিসাব ফ্রিজ করে দেয়। পরে কারণ হিসেবে জানা গেছে, সরকারের মুনাফার ওপর ১৫% ভ্যাটের যে আইন তা লঙ্ঘন করেছে ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি। সব মিলিয়ে আনুমানিক ৬০ থেকে ৮০ কোটি টাকা মুনাফার ওপর ভ্যাট জমা হয়েছে, যা সরকারকে দেয়নি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি।
এরপর, সরকারকে ভ্যাটের প্রায় ৩০ কোটি টাকা দিয়ে ব্যাংকের হিসাব পুনরায় স্বাভাবিক করেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা। জানা গেছে, এখনো ইন্সটলমেন্টে মুনাফার ওপর ১৫% ভ্যাট দিয়ে যাচ্ছে ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি। তথ্যটি ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ সবার কাছে গোপন করে গেছে বলে জানা গেছে।
এখানে প্রশ্ন থেকে যায়, কতটা মুনাফা করলে ৬০ থেকে ৮০ কোটি টাকার মতো ভ্যাট ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির মতো প্রতিষ্ঠানকে গুনতে হয়? সেই ভ্যাটের চাপ কি ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি শিক্ষার্থীদের দিচ্ছে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌসকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে বাংলানিউজকে তিনি বলেন, ইউজিসির প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির কোডের প্রথম লাইনটিই হচ্ছে, ‘প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি হবে একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান’। আর আজ তারা এটিকে বানিয়েছে মুনাফা তৈরির কারখানা।
রোবায়েত ফেরদৌস আরও বলেন, কোনোভাবেই এটি কাম্য নয়, ইউজিসির উচিত হবে এই উচ্চমাত্রার টিউশন ফি রোধ করা এবং এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া। সাধারণ পরিবারের অনেক সন্তানেরা প্রাইভেটে পড়াশোনা করছেন, এই বিষয়গুলো ট্রাস্টি বোর্ডের ভাবা উচিত, যোগ করেন তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৩৬ ঘণ্টা, মে ২০, ২০২৪
এমজেএফ