ঢাকা: যাদের বাবা-মা নেই তাদের ভোটার হওয়ার ক্ষেত্রে বাধা কাটলেও জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) পেতে জটিলতা থেকেই গেল।
নির্বাচন কমিশন (ইসি) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিভিন্ন কারণে যারা পরিচয়হীন বা যারা নিজেদের বাবা-মায়ের নাম জানেন না কিংবা যারা তৃতীয় লিঙ্গের হওয়ায় পরিবার পরিচয় দিতে অস্বীকৃতি জানায়; এমন নাগরিকদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল বাবা-মায়ের নাম ছাড়াই ভোটার করে নেওয়ার।
সেই দাবিকে আমলে নিয়ে সম্প্রতি ভোটার তালিকা বিধিমালা-২০১২ সংশোধন করে এ সংক্রান্ত সুযোগ তৈরি করেছে ইসি। অর্থাৎ যাদের বাবা-মা নেই বা পরিচয় নেই, তাদের ভোটার হওয়ার ক্ষেত্রে আর মিথ্যা পরিচয় দেওয়ার প্রয়োজন পড়বে না। কেননা, বাবা-মায়ের নামোল্লেখ না করেই ভোটার হওয়া যাবে।
ভোটার তালিকা বিধিমালা-১২-এর নিবন্ধন ফরম-২-এর পর ৫৮ নম্বর ক্রমিকে আগে বাবা-মায়ের নাম, এনআইডি নম্বর অথবা ভোটার নম্বর উল্লেখ করা বাধ্যতামূলক ছিল। এখন বাবা-মায়ের নাম অজানা থাকলে সংশ্লিষ্ট ক্রমিকে ‘অপ্রাপ্য’ শব্দটি লিখলেই হবে।
পরিচয়হীনরা এভাবে ভোটার হতে পারলেও জটিলতা থেকেই যাচ্ছে এনআইডি পাওয়ার ক্ষেত্রে। কেননা, ভোটার তালিকার ভিত্তিতেই জাতীয় পরিচয়পত্র সরবরাহ করে থাকে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এক্ষেত্রে এনআইডির কোনো আইনে এ ধরনের পরিবর্তন বা সংশোধন আনা হয়নি। ফলে কোনো ব্যক্তি বাবা-মায়ের নামোল্লেখ না করে ভোটার হতে পারলেও এনআইডি পাচ্ছেন না।
ইসি কর্মকর্তারা বলছেন, ভোটার তালিকার ভিত্তিতে এনআইডি সরবরাহ করা হলেও, এনআইডির জন্য পৃথক আইন রয়েছে। এর ভিত্তিতে কী তথ্য এনআইডিতে প্রদর্শিত অবস্থায় থাকবে তা নির্ধারণ করা হয়। আগে বাবা-মায়ের সঙ্গে স্বামী-স্ত্রীর নামও উল্লেখ থাকতো। কিন্তু এতে জটিলতা সৃষ্টি হয় বলে এখন কেবল অন্যান্য তথ্যের সঙ্গে বাবা-মায়ের নাম প্রদর্শিত থাকে। কেননা, পরিচয় নির্ধারণে এই দুটির গুরুত্ব অনেক। ভোটার তালিকা বিধিমালা সংশোধন হওয়ায় সংশ্লিষ্ট পরিচয়হীন ভোটারের এনআইডিতে বাবা-মায়ের ঘরটি ফাঁকা থাকবে, নাকি কোনো ঘর থাকবে না অথবা বাবা-মায়ের ঘরে ‘অপ্রাপ্য’ শব্দটি উল্লেখ থাকবে এ নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেই। ফলে বাবা-মায়ের নামোল্লেখ না করে ভোটার হওয়া গেলেও জাতীয় পরিচয়পত্র মিলবে না।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, এনআইডি ছাড়া এখন কোনো সেবাই মেলে না। এমনকি বাসা ভাড়া নিতে গেলেও প্রয়োজন পড়ে নাগরিক এই পরিচয়পত্রের। ব্যাংক হিসাব খোলা, ঋণগ্রহণ, চাকরি ইত্যাদি কার্যক্রমের বাইরে রাখা হয় তাদের। ফলে জীবন-জীবিকা ব্যাপকভাবে ব্যাহত হয়।
‘হিজড়া’ সম্প্রদায়ের উন্নয়ন সংগঠন সুস্থ জীবনের চেয়ারম্যান পার্বতী আহমেদ বলেন, জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) তৈরি ও সংশোধন করতে গিয়ে নানা বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। আমাদের অনেকেরই পুরুষ আইডি কার্ড আছে। এখন সেটা নিয়ে কোথাও গেলে সেটা একসেপ্ট করে না। কারণ আইডি কার্ড একরকম, আর তাদের দেখতে আরেক রকম। এতে অনেক বৈষম্যের শিকার হয়েছি। চাকরির ক্ষেত্রে নিতে চায় না। নারী-পুরুষ চিহ্নিত করার জন্য সিভিল সার্জন অফিস ও মেডিকেলে কলেজ হাসপাতালগুলোতে আমাদের কাপড় খুলে দেখাতে হয়। সেখানে আমাদের মানসিকভাবে ও আত্মসম্মানে খুব আঘাত লাগে।
অন্যদিকে সেখানে অভিভাবকের প্রয়োজন হয়। এখন অভিভাবকরা তো আমাদের আরও ১০-১৫ বছর আগেই ছেড়েই দিয়েছে। পরিবার তো আমাদের রাখে না। তো কীভাবে অভিভাবক আনবো কোথায় পাবো পিতা-মাতা!
তিনি আরও বলেন, এসবের পাশাপাশি আমাদের অ্যাফিডেভিট করতে হয় প্রথম শ্রেণির হাকিম দিয়ে। তিনি আবার থানায় পাঠান। এজন্য অনেক হয়রানি হতে হয়।
এসব বিষয়ে প্রতিকার চান তারা। আসতে চান সমাজের মূল ধারাতেও। পার্বতী আহমেদ বলেন, সমাজে হিজড়া জনগোষ্ঠী নিয়ে যে নেতিবাচক মনোভাব আছে তা নিয়ে আমরা কাজ করছি। আমাদের যদি সুযোগ দেওয়া হয় অবশ্যই আমরা কাজ করে প্রমাণ দেখাব। সমাজের মূল ধারায় চলে আসব।
ববি হিজড়া বলেন, নির্বাচন কমিশন আমাদের দাবি প্রেক্ষিতে পুরুষ-নারীর পাশাপাশি ভোটার হওয়ার আবেদনে 'হিজড়া' শব্দটি অন্তর্ভুক্ত করেছে। পিতা-মাতা ছাড়া ভোটার হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। কিন্তু এনআইডিতে সে সুযোগ না থাকায় আমরা ভোটার হওয়ার সুযোগের কোনো সুফল পাচ্ছি না। এ নিয়ে সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানাই।
ইসি সচিব মো. জাহাংগীর আলমের কাছে এই ধরনের জটিলতা নিরসনে করণীয় কী জানতে চাইলে বলেন, এনআইডি মহাপরিচালক বিষয়টির বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিতে পারবেন। এমন সমস্যা নিয়ে কেউ এখনো আমাদের কাছে কোনো আবেদন করেছেন বলে জানা নেই।
এনআইডি অনুবিভাগের মহাপরিচালক একেএম হুমায়ূন কবীর বাংলানিউজকে বলেন, আমরা এখনই পরিচয়হীনদের এনআইডিতে পিতামাতার ঘরে অপ্রাপ্য শব্দটি অন্তর্ভুক্ত করতে চাই না। কারণ হলো এটি খুব স্পর্শকাতর বিষয়।
তিনি বলেন, আমাদের সামাজিক অবস্থা ইউরোপ-আমেরিকার মতো নয়, যে বাবা-মা ছাড়া কারো পরিচয় গ্রহণ করে। এক্ষেত্রে এনআইডিতে বিষয়টি উল্লেখ করলে অনেকের ক্ষেত্রে আরও সামাজিক জটিলতা বাড়তে পারে।
এই অবস্থান সরে এসে ইসিকে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে মনে করেন জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। তিনি বলেন, পিছিয়ে পড়া এ সমস্ত জনগোষ্ঠীর ডাটাবেজ তৈরি করতে হবে। কেননা, ডিজিটাল বাংলাদেশের মূল বিষয় হলো অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতি।
তিনি বলেন, প্রত্যেক নাগরিকের ব্যক্তি-পরিচয় পাওয়ার অধিকার রয়েছে। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমরা চাই না সমাজের একটি অংশকে বা বিচ্ছিন্ন অংশকে ভোটার তালিকা থেকে বাদ দিতে। অথবা এনআইডির বাইরে রাখলাম, এতে তার নাগরিক অধিকার ক্ষুণ্ন হয়।
স্পিকার আরও বলেন, এনআইডির তথ্য যেন তাদের বিব্রত না করে, সে বিষয়টিও খেয়াল রাখতে হবে। এই কাজটি সুচারুভাবে সম্পন্ন করতে হবে। অনগ্রসর অংশকে এগিয়ে নিতে বিশেষ বিধান আনতে হবে।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার মো. শাহ নেওয়াজ বলেন, নাগরিক পরিচয়পত্র পাওয়া সবার অধিকার। এক্ষেত্রে পিতা-মাতা না থাকলে কেউ এনআইডি পাবে না তা হতে পারে না। ইসির উচিত সংশ্লিষ্ট সকলের সঙ্গে আলোচনা করে একটি পথ খুঁজে বের করা।
২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা প্রণয়ন করে একটি ভোটার ডাটাবেজ গড়ে তোলে নির্বাচন কমিশন। পরে সেই ডাটাবেজের ভিত্তিতে নাগরিকদের জাতীয় পরিচয়পত্র সরবরাহ করার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে তৎকালীন ড. এটিএম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন।
ভোটার ডাটাবেজের ভিত্তিতে এনআইডি সরবরাহের জন্য জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন-২০১০ প্রণয়নও করা হয়। সর্বশেষ হালনাগাদের পর ইসির ডাটাবেজে বর্তমানে ভোটার রয়েছে ১২ কোটি ১৭ লাখের বেশি। এদের প্রায় সকলের রয়েছে এনআইডি। আর সরকারি-বেসরকারি ১৭১টি প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন সেবা দানের ক্ষেত্রে এনআইডি ডাটাবেজ থেকেই নাগরিকের পরিচিতি যাচাই করে নেয়।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৩০ ঘণ্টা, মার্চ ১৮, ২০২৩
ইইউডি/এএটি