ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

নির্বাচন ও ইসি

১৯ কেন্দ্রে শূন্য ভোটের কারণ ইউপিডিএফ’র ‘জঙ্গলনীতি’

অপু দত্ত, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯২০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৯, ২০২৪
১৯ কেন্দ্রে শূন্য ভোটের কারণ ইউপিডিএফ’র ‘জঙ্গলনীতি’

খাগড়াছড়ি: দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন ‘নিজেদের অধ্যুষিত’ দাবি করা এলাকাগুলোয় শক্তির জানান দেয় পাহাড়ের আঞ্চলিক সংগঠক ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। খাগড়াছড়িতে তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় কোনো ভোটার কেন্দ্রে যেতে পারেনি।

ভোটাধিকার না প্রয়োগ করতে পারায় ১৯টি কেন্দ্র ছিল ভোট শূন্য। ছয়টি কেন্দ্রে ভোট হয়েছে, তবে ‘নাম কা ওয়াস্তে’। কারণ, কেন্দ্রগুলো মিলিয়ে মোট ভোট সংখ্যা মাত্র ২৩।

মূলত নির্বাচনের আগে থেকেই স্থানীয়দের ভোট কেন্দ্রে না যেতে নানা হুমকি দিয়ে ও ভয় দেখিয়ে আসছিল ইউপিডিএফ। প্রত্যন্ত গ্রামে ভোট কেন্দ্রে গেলে স্থানীয়দের জরিমানাসহ মারধর করা হবে- এমন হুঁশিয়ারি দিয়ে মাইকিংও করা হয়। গত শনিবার ও ভোটের দিন রোববার পাহাড়ে ফাঁকা গুলিও চালানো হয়। সংগঠনটির এমন সক্রিয়তার কারণে আতঙ্কগ্রস্ত ছিলেন নির্বাচন সংশ্লিষ্টরা।

এমন আচরণকে ইউপিডিএফের অভ্যন্তরীণ ‘জঙ্গলনীতি’ বলছেন সংশ্লিষ্টরা। ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বলছেন, পাহাড়ের মানুষকে জিম্মি করে অপরাজনীতি করছে সংগঠনটি। সরকারকে চ্যালেঞ্জ করে ইউপিডিএফ শক্তি দেখাচ্ছে।

ইউপিডিএফ নেতারা অবশ্য দাবি করছেন, সারা দেশের মতো পাহাড়েও স্থানীয়রা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট বর্জন করেছে। কাউকে ভয় দেখিয়ে কেন্দ্রে যেতে বাধা দেওয়া হয়নি।

এদিকে, বিবৃতি প্রকাশ করে ইউপিডিএফ প্রধান প্রসীত বিকাশ খীসা নির্বাচন বাতিল করে নতুন করে নির্দলীয় নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবী জানিয়েছেন।

এবার খাগড়াছড়ি জেলায় ভোট কেন্দ্র ছিল ১৯৬টি। ১৯ কেন্দ্রে একটি ভোটও পড়েনি। এক কেন্দ্রে ১ ভোটের খবর পাওয়া গেছে।

জেলার পানছড়িতেই শূন্য ভোট কেন্দ্রের সংখ্যা বেশি। উপজেলায় মোট ২৪টি কেন্দ্রের মধ্যে ১১টি কেন্দ্রে কোন ভোট পড়েনি। দক্ষিণ লতিবান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাত্র একজন ভোটার নিজের অধিকার প্রয়োগ করেছেন।

দীঘিনালা উপজেলায় ভোটকেন্দ্র ছিল আটটি। তিনটিতে একটি ভোটও পড়েনি; ২২ ভোট পড়েছে পাছ কেন্দ্রে। জেলার সবচেয়ে দুর্গম উপজেলা লক্ষীছড়ির পাঁচ কেন্দ্রেও কোনো ভোট পড়েনি। কেন্দ্রগুলো ইউপিডিএফ অধ্যুষিত এলাকার।

শূন্য ভোট পড়া কেন্দ্রের কয়েকজন প্রিসাইডিং ও সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বাংলানিউজকে বলেছেন, নির্বাচনের আগের দিন থেকে ভোট গ্রহণের সময়সীমা পর্যন্ত তারা চরম উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় সময় পার করেছেন। পাহাড়ি অনেক কর্মকর্তা ভয়ে রাতে কেন্দ্রে অবস্থান করেননি। ভোট কেন্দ্রের আশপাশের বাসিন্দারা বাড়িঘরগুলোয় তালা দিয়ে এলাকা ছেড়ে গেছেন। রাতে বিভিন্ন স্থান থেকে গুলির শব্দ শুনেছেন।

তারা আরও জানান, বিভিন্ন গ্রামে মাইকিং করে কেন্দ্রে ভোট দিতে না যেতে বলা হয়েছিল। স্থানীয় গ্রাম প্রধানদের ডেকে নিয়ে ভোট দিলে দশ হাজার টাকা জরিমানাসহ শারীরিক নির্যাতনের হুমকিও দেওয়া হয়। এছাড়া নির্বাচনের আগে থেকে নির্বাচনের দিন পর্যন্ত বিভিন্ন স্থান ফাঁকা গুলি চালানো হয়েছিল। অধিকাংশ কেন্দ্রে কোনো প্রার্থীর এজেন্ট ছিল না।

খোদ ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা এসব বিষয়ে মুখ খুলতে রাজী নন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে লক্ষীছড়ি ও পানছড়ির একাধিক নেতা জানান, পানছড়ির উপজেলা, সদর কিংবা আশপাশ ছাড়া দূরে কোথাও নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে পারেননি তারা। লক্ষীছীড়র দুর্গম বর্মাছড়িতে নৌকার সমর্থনে নির্বাচনী প্রচারণায়  গেলে গুলি চালানো হয়।

এসময় উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বিল্লাল হোসেনসহ ৪/৫ জনকে অপহরণ করার চেষ্টা করা হয়। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপর হলে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। দুর্গম কেন্দ্রগুলোয় নির্বাচনের কোনো প্রচারণা চালানো যায়নি। ইউপিডিএফের সামরিক বিভাগ নিজেদের অধ্যুষিত এলাকায় জঙ্গলনীতি জারি রাখায় আতঙ্কিত হয়ে ভোটাররা কেন্দ্রে আসতে পারেনি।

এর আগে গত ২৯ ডিসেম্বর পানছড়ির দূর্গম দুধকছড়া এলাকায় নির্বাচনী প্রচারণায় গেলে তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী উশৈপ্রু মারমার সমর্থকদের মারধর ও গাড়ি বহরে হামলা করা হয়। এসব ঘটনায় ইউপিডিএফকে (প্রসীত) দায়ী করেছেন ভুক্তভোগীরা।

খাগড়াছড়ি জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক দিদারুল আলম বলেন, ইউপিডিএফ রাষ্ট্র ও সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। তারা  সরকারকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে। শুরু থেকে নির্বাচন বানচালের জন্য তারা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটারদের হুমকি দেওয়া হয়েছে। নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে। যে কারণে কেন্দ্রগুলোয় ভোটাররা উপস্থিত হতে পারেনি। অনেকে ভয়ে বাড়ি ছেড়ে গেছে। তবে কিছু কেন্দ্রে তাদের (ইউপিডিএফ) বাধা পেরিয়ে জনগণ ভোট দিয়েছে।

নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে থেকে ইউপিডিএফ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোট হবে না দাবী করে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেয়। গত ১১ ডিসেম্বর ইউপিডিএফ’র ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের চার নেতাকে হত্যার পর খাগড়াছড়ির নির্বাচনী পরিবেশ নতুন মোড় নেয়। বিষয়টি স্বীকারও করেছেন ইউপিডিএফ নেতা অংগ্য মারমা।

বাংলানিউজকে তিনি বলেন, জঙ্গলনীতির বিষয়টি অমূলক। ২০১৪, ২০১৮ সালের নির্বাচন আমরা দেখেছি। সদ্য শেষ হওয়া পাতানো নির্বাচনের আয়োজন দেখে আগেই আমরা বর্জনের ঘোষণা দিয়েছি। তবে এটি সত্য আমাদের দলের চার নেতাকে হত্যার পর নতুন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আমাদের কর্মসূচি সাধারণ মানুষ বাস্তবায়ন করেছে। কাউকে হুমকি বা ভয়ভীতি দেখানো হয়নি। স্থানীয়রা এই সরকার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। সরকার আমাদের উপর দমন-পীড়ন চালাচ্ছে। ইচ্ছা মতো মামলা দিচ্ছে, মুখোশ বাহিনী দিয়ে আমাদের নেতাকর্মীদের হত্যা করছে। আমরা এসবের ধারাবাহিক প্রতিবাদ জানাচ্ছি এবং নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবী জানাচ্ছি।

উল্লেখ্য, ১৯৯৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর ঢাকায় তিনটি পাহাড়ি সংগঠন সম্মিলিতভাবে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) প্রতিষ্ঠা করে। এর আগে ১৯৯৭ সালে এক সম্মেলনে ‘পূর্ণস্বায়ত্তশাসনই পার্বত্য চট্টগ্রামের একমাত্র সমাধান’ ঘোষণা দিয়ে সংগঠনটির কার্যক্রম শুরু করে। পরবর্তীতে সংগঠনটি ভেঙে যায়। ২০১৭ সালে গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফ নামে সংগঠনটি নতুনভাবে আত্মপ্রকাশ করে।

বাংলাদেশ সময়: ১৯২০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৯, ২০২৪
এডি/এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।